
ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান থেকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসেই ব্যাপক প্রস্তুতির মাধ্যমে দল গোছানোর কাজ শুরু করে। দলটির তরুণ নেতাকর্মীরা দিনরাত পরিশ্রমের মাধ্যমে এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশনের সব শর্ত পূরণ করেছে। দু’টি মহানগর, ৩৩টি জেলা এবং দেড় শতাধিক উপজেলা সমন্বয়ক কমিটিও দিয়েছে দলটি। কমিটি ঘোষণা ছাড়াও অন্যান্য শর্ত পূরণ করতে টানা পরিশ্রম করে দলটির বিভিন্ন ইউনিট ও সেলের নেতাকর্মীরা। গত রোববার নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য একেবারে শেষ সময়ে আবেদন জমা দিয়েছে দলটি। এ ছাড়া আগামী নির্বাচনে তারা দলীয় প্রতীক হিসেবে জাতীয় ফুল ‘শাপলা’ পেতে চায়।
শেষ মুহূর্তে নিবন্ধনের জন্য আবেদন সম্পন্ন করতে পেরে উচ্ছ্বসিত দলটির নেতাকর্মীরা। তাদের প্রত্যাশা, কঠোর পরিশ্রমের পরে নিবন্ধনের জন্য যে আবেদন তারা করতে পেরেছেন তা যেন নির্বাচন কমিশন গ্রহণ করেন। এর মাধ্যমে এনসিপি একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে দেশের মানুষের সেবা ও প্রকৃত সংস্কার করে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে ভূমিকা রাখতে পারবে বলেও বিশ্বাস তাদের। নিবন্ধনের আবেদন শেষে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা শাপলা, কলম ও মোবাইল এই তিনটি মার্কা চেয়ে আবেদন করেছি, তবে প্রথম পছন্দ শাপলা। আশা করছি, সাধারণ মানুষের প্রতীক হিসেবে শাপলা মার্কা পাবো এবং এটিই আগামী দিনে জনগণের কাছে আমাদের বার্তা বহন করবে। নিবন্ধনের শর্তগুলো পূর্ণ করে আবেদন করা হয়েছে এবং শিগগিরই নিবন্ধন পাবো বলে আমরা আশাবাদী।
নেতাকর্মীদের উচ্ছ্বাস নিয়ে দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ নয়া দিগন্তকে বলেন, রোববার আমরা নির্বাচন কমিশনে যে আবেদন জমা দিয়েছি এর মাধ্যমে আমাদের সাংগঠনিক একটা ভিত্তি দাঁড়িয়ে গিয়েছে। আমরা ৩৩টি জেলা এবং দেড় শতাধিক উপজেলা কমিটি দিতে পেরেছি। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সাংগঠনিক কাঠামোটা কিন্তু দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ফলে নেতাকর্মীরাও বেশ উচ্ছ্বসিত। তারা দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছে, তাদের পরিশ্রমের ফলে একটা জায়গায় আমরা পৌঁছাতে পেরেছি।
তবে এনসিপি প্রতীক হিসেবে জাতীয় ফুল শাপলা চাওয়ায় এ নিয়ে বেশ বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছে। প্রতীক হিসেবে শাপলা নিয়ে আলোচনা চলছে বেশ জোরেসোরে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এর পক্ষে বিপক্ষে বেশ সরব উভয়পক্ষই। কেউ কেউ বলছেন, শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক। এটি কোনো রাজনৈতিক দলের নির্বাচনের প্রতীক হতে পারে না। এটি একক কোনো দলের সম্পত্তি নয় বরং এটি সবার। সুতরাং কোনোভাবেই এটি রাজনৈতিক দলের প্রতীক হতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের দফতর সম্পাদক মল্লিক ওয়াসি উদ্দিন তামি বলেন, দলীয় স্লোগানকে জাতীয় স্লোগান বানানোকে যেভাবে বিরোধিতা করেছিলাম, জাতীয় প্রতীককে দলীয় প্রতীক বানানোকেও সে রকম বিরোধিতা করছি। রাষ্ট্র, সরকার আর রাজনৈতিক দলের খিচুড়ি পাকানোটা নয়া বন্দোবস্ত নয়, বরং নয়া ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি শোনায়।
সরকারি তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের এক নেতা ফেসবুকে লিখেছেন, জাতীয় শাপলা ফুলের দলীয়করণ ইতিহাসের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। জাতীয় প্রতীক শাপলা, যা আমাদের অহঙ্কার, আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও পরিচয়ের অটুট প্রতীক, তা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য একটি দলের সম্পদ বানানো ন্যায়বিচারের চরম অবমাননা এবং দেশের জনগণের প্রতি কুরুচিপূর্ণ তাণ্ডব। এনসিপির এই কর্মকাণ্ড আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতীয় ঐক্যকে কলঙ্কিত করার শামিল, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
শাপলা জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রতীক হিসেবে পাবার বৈধতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আতিকুর রহমান। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো বা কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী জাতীয় নির্বাচনে কোন কোন প্রতীক ব্যবহার করতে পারবেন তা রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার-১৯৭২ এর আলোকে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতীকগুলো গেজেট’ শীর্ষক গেজেটে উল্লেখ করা হয়েছে। পূর্বে ১৪০টি প্রতীক জাতীয় নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত থাকলেও ২০০৮ এবং ২০১৭ সালে ১৯৭২ এর অর্ডারটিতে সংশোধনী আনা হয়েছে এবং বর্তমানে স্বীকৃত নির্বাচনী প্রতীক ৬৪টি করা হয়েছে। সাথে সাথে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য নির্ধারিত প্রতীক ২৫টি করা হয়েছে। এর পূর্ণাঙ্গ তালিকা ওপরে উল্লেখিত গেজেটেই আছে। এর বাইর থেকে মনমতো কোনো প্রতীক কোনো রাজনৈতিক দল বা স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যবহার করতে পারবে না। তবে এই গেজেটে প্রতীক হিসেবে ‘শাপলা’ ব্যবহার করার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। অর্থাৎ, ৬৪টি প্রতীকের মধ্যে শাপলা নেই। তাই জাতীয় নাগরিক পার্টি তাদের দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা ব্যবহার করতে পারবে না।
তিনি আরো লিখেছেন, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন কমিশনের নীতিমালা অনুযায়ী ‘রাষ্ট্রীয় প্রতীকের সাথে সাংঘর্ষিক কিংবা বিভ্রান্তিকর প্রতীক ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।’ এখন আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় প্রতীকে পানিতে ভাসমান শাপলা অবশ্যই দেখেছি। সেই সূত্রানুসারে নির্বাচনী প্রতীক শাপলা করাও নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। দ্য বাংলাদেশ নেমস অ্যান্ড ইমব্লেমস আদেশের ৩(১) নং ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় প্রতীক যে রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। আবার এই আদেশের শিডিউলে জাতীয় প্রতীককে সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে। তাই এই আদেশও এটা বলে যে জাতীয় নাগরিক পার্টি তাদের দলীয় প্রতীক হিসেবে ‘শাপলা’ ব্যবহার করতে পারে না। এই ধরনের প্রতীক নির্ধারণ নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রীয় বিধানের পরিপন্থী।
তবে শাপলা-ই প্রতীক হিসেবে বরাদ্দ হবে এমনটি ধরে নিয়েই নির্বাচনকেন্দ্রিক কাজ করতে চায় দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ নেতাকর্মীরা। এ ক্ষেত্রে তাদের আইনগত কোনো বাধাও নেই বলে মনে করেন তারা। নিবন্ধনের আবেদন শেষে তাই তারা পিকআপে করে ‘শাপলা-শাপলা’ বলে স্লোগানও দেন। নেতাকর্মীদের অনেকেই ‘ধানের শীষে ঘাপলা-মার্কা এবার শাপলা’ স্লোগানও দিয়েছেন। প্রতীকের ব্যাপারে নাহিদ ইসলাম বলেন, আমাদের জাতীয় প্রতীকের মধ্যে শাপলার সাথে পাটপাতা, তারকা এবং ধানের শীষও রয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলোই ইতোমধ্যে বিভিন্ন দলের মার্কা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তাই শাপলা ব্যবহারে কোনো আইনগত বাধা নেই।