
লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকের পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কবে দেশে ফিরবেন, সেটি নিয়ে নতুন করে আগ্রহ, কৌতুহল ও আলোচনা শুরু হয়েছে। দেশে ফিরে তারেক রহমান ঢাকায় কোথায় থাকবেন, সেই বাড়ির প্রস্তুতির খবরও প্রকাশিত হচ্ছে গণমাধ্যমে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তিনি কবে দেশে ফিরবেন আর ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দশ মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও কেন তার দেশে ফেরা হলো না?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পাশাপাশি তারেক রহমানের দেশে ফেরার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী- তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা।
গত বছরের ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর তারেক রহমান প্রায় সব মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।এছাড়া ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলাসহ আরও যেসব মামলায় সাজা হয়েছিল, আদালতের রায়ে তার সবগুলো থেকেই তিনি খালাস পেয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, এই মুহূর্তে তারেক রহমানের দেশে ফিরতে কোনো ধরনের বাধা নেই।
দেশে ফিরবেন কবে
আইনি এবং রাজনৈতিক সব বাধা দূর হলেও দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর দেশের বাইরে থাকা তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন- এ বিষয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ বা পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়নি।
দলীয় সূত্র এবং তার ঘনিষ্ঠরা জানান, তারেক রহমান দেশে ফিরেই আগামী নির্বাচনে দলকে নেতৃত্ব দেবেন। সেই হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশের ফিরবেন- এমন ধারণাই দেওয়া হচ্ছে।
তারেক রহমানের একজন উপদেষ্টা মাহদী আমিন বলেন, কোনো সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি। তবে নির্বাচনের আগে তিনি দেশে আসবেন। এ ব্যাপারে তারেক রহমান নিজেই সিদ্ধান্ত নেবেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি খুব দ্রুতই ইনশাআল্লাহ নির্বাচন হবে আগামী বছর রমজানের আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে। সুতরাং অবশ্যই তার আগে তিনি ফেরত আসবেন। যথোপযুক্ত আইনি এবং রাজনৈতিক পরিবেশ যখন সৃষ্টি হবে, যেটা বাংলাদেশের জন্য ভালো, সবার জন্য ভালো উনি অবশ্যই নির্বাচনের আগে সেই সময়টাতে আমাদের মাঝে উপস্থিত হবেন।’
সম্প্রতি লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের নির্বাচন ইস্যুতে বৈঠক হয়েছে। সেই বৈঠক থেকে বাংলাদেশে আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় উল্লেখ করে যৌথ ঘোষণা এসেছে।
লন্ডনে ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তারেক রহমানের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির। তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন বিষয়ে হুমায়ুন কবির সুনির্দিষ্ট দিন তারিখ উল্লেখ না করে বলেন, ২০২৫ সালের মধ্যেই দেশে ফিরে দলকে নেতৃত্ব দেবেন তারেক রহমান।
হুমায়ুন কবির বলেন, ‘দেখি আমরা প্রথমে নির্বাচনের তারিখটা ঘোষণা হোক। তারপরে ইনশাআল্লাহ একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হি উইল বি কামিং ব্যাক ইন টু থাউজেন্ড অ্যান্ড টোয়েন্টি ফাইভ। বাংলাদেশের মানুষ ওনাকে এই বছরেই পাবে ইনশাআল্লাহ।’
নিরাপত্তার ইস্যু কেন
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ১০ মাস পেরিয়েছে। এতদিনেও কেন তারেক রহমান দেশে ফিরছেন না, সেটি নিয়ে অনেকের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে।
কারণ দেশে ফেরার ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে মামলা এবং সাজা নিয়ে আইনগত যে সমস্যা ছিল, সেটি দূর হয়েছে। এখন তারেক রহমান দেশে আসছেন না কেন- এ প্রশ্নে হুমায়ুন কবির বলেন, তারেক রহমানের নিরাপত্তার ইস্যুটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, আইনি প্রক্রিয়া আর নিরাপত্তা- দুটি আলাদা বিষয়।
হুমায়ুনের ভাষ্য, ‘ওনার মতো লিডারের সিকিউরিটি কনসার্ন (নিরাপত্তার উদ্বেগ) স্বাভাবিকভাবে আছেই। এটা এশিয়া মহাদেশের রাজনীতিতে নাথিং নিউ। পলিটিক্স ইন দ্য এশিয়া প্যাসিফিক অর সাউথ এশিয়া এনি হোয়্যার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড এই ধরনের সিনিয়র পলিটিক্যাল লিডারের নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়তো আছেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘উনি আসবেন, অবশ্যই আসবেন। আসার আগেতো একটা প্রস্তুতির বিষয় আছে। সরকারেরও একটা নিশ্চিত এনভায়রনমেন্ট ক্রিয়েট করতে হবে, একটা স্পেস ক্রিয়েট করতে হবে, যেখানে পলিটিক্যাল লিডারস আর সেইফ, সিকিওর।’
বিএনপির রাজনীতিতে তারেক রহমানই এখন প্রধান নেতা। আগামী নির্বাচনে তার নেতৃত্বেই দলটি নির্বাচন করবে এবং ধারণা করা হচ্ছে দল ক্ষমতায় এলে তিনিই হবেন বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু দেশে নিরাপত্তাহীনতা কেন এবং সমস্যা কোথায়- এ প্রশ্নে হুমায়ুন কবির বলেন, সিনিয়র পলিটিক্যাল লিডারের নিরাপত্তা ইস্যু সবসময় থাকবে।
হুমায়ুন বলেন, ‘গত পনের বছর উই হ্যাভ আ রগ ফর্ম অফ গভর্মেন্ট। যারে মনে হয় তুলে নেওয়া হয়েছে, যারে মনে হয় হত্যা করা হয়েছে। মানে এটা একটা অ্যাবনরমাল সিস্টেম। আমরা দেখেছিতো হাউ পলিটিসাইজ ওয়াজ পুলিস ফোর্স। আপনার মিলিটারির একটা এলিমেন্টও পলিটিসাইজ (দলীয়করণ) করা হইছে। তো এইগুলোকে একটু ক্লিয়ার আপ করতে তো স্বাভাবিকভাবে একটা স্পেস সরকারেরও দরকার আছে। সো দে আর ডুইং দ্যাট। আশা করছি, শিগগিরই সেই জায়গাটা তৈরি হবে।’
২০০৮ সালে তারেক রহমান লন্ডনে যান। এরপর থেকে সেখানেই আছেন তিনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এক-এগারোর সরকারের সময় তারেক রহমান বিদেশে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। যে সময় তিনি (তারেক রহমান) গিয়েছিলেন সে সময়তো তাকে জোর করে পাঠানো হয়েছিল। আর চিকিৎসাও একটা লক্ষ্য ছিল।’
তিনি বলেন, ‘আমি বলবো তাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে খালেদা জিয়ার ওপর একটা প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল ওই সময়ের সেনা নেতৃত্ব। সেই সেনা নেতৃত্বতো এখন নাই। সুতরাং সেই সমস্যাটা আমি আর দেখি না।’
মহিউদ্দিন আহমদের ভাষ্য, ‘তারপরেও একটা আশঙ্কা থাকতে পারে। কারণ আমাদের দেশের রাজনীতিটা হচ্ছে প্রতিহিংসাপরায়ণতায় ভরা। তার প্রতি যে আচরণ সে সময় করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো ইনভলব ছিল। তারা হয়তো ভাবতে পারে তারেক ফিরে এলে তিনি যদি প্রতিশোধ নেন। তো এরকম একটা চিন্তা থাকতে পারে। কারণ আমাদের রাজনীতিতে এটা হরদম চলছে।’
‘তারেক রহমানের ফেরাটা নির্বাচনি শোডাউনের অংশও হতে পারে’- এমন মন্তব্য করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে ধোয়াসা এখনো কাটেনি। তারেক রহমান ফেরার আগে নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। এখনতো তিনি মুক্ত। যেকোনো সময় তিনি আসতে পারেন। হয়তো তিনি আসবেন। ইলেকশনের ব্যাপারে একটা ফয়সালা হলে। কনফার্ম একটা ডেট হলে হয়তো তিনি আসবেন।’
মহিউদ্দিনের ভাষ্য, ‘ওনার আসাটাও হয়তো আমার মনে হয় নির্বাচনি শোডাউনের একটা পার্ট হবে। হয়তো সেইভাবে প্রস্তুতি নিয়েই আসবেন। কারণ শোনা যাচ্ছে উনি আসলে লাখ লাখ লোক এয়ারপোর্টে আসবেন। হয়তো এরকম একটা পরিকল্পনা আছে উনি ওইভাবে আসবেন।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফেরার পর কোথায় থাকবেন, সেই বাড়ির প্রস্তুতির খবর সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেরিয়েছে। বাড়িটি ঘিরে পুলিশ প্রহরা দেখা গেছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাও বলছেন, দলীয় পরামর্শ নয়, কবে কোন সময় বাংলাদেশে ফিরবেন- এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন তারেক রহমান নিজেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী তাদের দলের নেতা তারেক রহমানের দেশে ফেরার প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাংলাদেশে যে উনার প্রয়োজন, দলের প্রয়োজন, দেশের প্রয়োজন- এটাতো উনিও অনুভব করেন, আমরাও অনুভব করি। তবে অনেক টেকনিক্যাল ইস্যু আছে। ওইগুলো বলা যাচ্ছে না। আমাদেরকেতো সবদিক থেকে বিবেচনা করেই উনার আসার বিষয় ঠিক করতে হবে। অনেকগুলো বিষয় থাকতে পারে এখানে। সবগুলো বিবেচনায় এনে উনার সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।’