
বরিশাল জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থি মানুষ অধ্যুষিত জেলা হিসেবে পরিচিত। ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে মূল লড়াইটাও হবে এ দুই ধারার প্রার্থীর মধ্যে। ইতোমধ্যে মাঠে তৎপর হয়েছেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর শতাধিক নেতা। দু-একটি আসনে আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) ও ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গেও হতে পারে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তবে এখনো সব এলাকায় কমিটি দিতে পারেনি তরুণ শিক্ষার্থীদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এরপরও ভোটের মাঠে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছেন তাদের অনুসারীরা ।
জেলার ১০ উজেলা নিয়ে গঠিত ছয়টি সংসদীয় আসনের চারটিতে এতদিন বিএনপির প্রভাব বেশি ছিল। বিপ্লবের পরের বাংলাদেশে সেই সমীকরণ বদলে যেতে পারে। বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থী ও তরুণ-যুবকরা প্রভাব ফেলতে পারেন ভোটের বাক্সে। আবার ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে। এতে পাল্টে যেতে পারে নির্বাচনের মাঠ। এসব বিষয় মাথায় রেখেই অন্তত ছয় মাস আগে জেলার সব আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াত। এবি পার্টি ও ইসলামী আন্দোলনেরও একক প্রতিদ্বন্দ্বীর কথা শোনা যাচ্ছে। তবে প্রার্থী ঘোষণা নিয়ে বেশ জটিলতা দেখা যাচ্ছে বিএনপিতে। মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে একাধিক হেভিওয়েট নেতা তৎপর থাকায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
বরিশাল-১ (আগৈলঝাড়া-গৌরনদী)
আসনটি এক সময় আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। দলটির নেতাদের অপকর্ম ও ক্ষমতাচ্যুত সরকারের দুঃশাসনের কারণে সেই চিত্র পাল্টে গেছে। ভোটও বিভক্ত হয়ে যাবে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থিÑএ দুই ধারায়। সেই মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দীন স্বপন, দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ারের (অ্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবাহান, বিএনপি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির বরিশাল বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান এবং কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম স্বজল। তাদের মধ্যে জহির উদ্দীন স্বপন ২০১৮ সালে বিএনপির প্রার্থী হয়েছিলেন। তবে গত ১৫ বছরের আওয়ামী আমলে হামলা-মামলার পরও মাঠে থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন শুধু ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবাহান।
বিএনপি নেতা স্বপন বলেন, ‘আওয়ামী লীগে সন্ত্রাসী বাহিনীর কারণে এতদিন এলাকায় থাকতে পারিনি। ৫ আগস্টের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা পাশে দাঁড়িয়েছেন। দল আমাকে মূল্যায়ন করবে বলে আশাবাদী।’
ইঞ্জিনিয়ার সোবাহান বলেন, ‘শেখ হাসিনার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মাঠে ছিলাম। আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। দল আমার ত্যাগের মূল্যায়ন করবে বলে আশা করছি।’
বিএনপির চার নেতা মনোনয়ন প্রত্যাশী হলেও স্বস্তিতে আছে জামায়াত। এই দলের পক্ষ থেকে এবার প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে জেলা জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা কামরুল ইসলাম খানকে। আরো মাস ছয়েক আগেই তাকে মনোনয়ন দেওয়ায় সুবিধা হয়েছে প্রচারে। নিয়মিত দলীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি নির্বাচনি তৎপরতাও চালিয়ে যাচ্ছেন। সাধারণ মানুষের অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছেন বলেও তার দাবি।
জামায়াত নেতা কামরুল বলেন, জনগণ যেভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাকে সমর্থন করছে, তাতে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে আমার বিজয় কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না।
তবে এ আসনে এখন পর্যন্ত এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ অন্য কোনো দলের নেতার তৎপরতা চোখে পড়েনি।
বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া)
বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতা এস শরফুদ্দিন আহম্মেদ সান্টু, কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশবিষয়ক সহসম্পাদক কাজী রওনাকুল ইসলাম টিপু, সদস্য দুলাল হোসেন, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইদ মাহমুদ জুয়েল, কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা কর্নেল (অব.) আনোয়ার হোসেন, কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক লায়ন আক্তার সেন্টু এবং জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান।
অপরদিকে জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির মাস্টার আবদুল মান্নানকে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তবে এ আসনে এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের কোনো নেতাকর্মীকে নির্বাচনি মাঠে নামতে দেখা যায়নি।
বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী)
এ আসনে ব্যাপক তৎপরতা দেখা যাচ্ছে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও এবি পার্টিসহ আওয়ামীবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের। এবারও বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী কেন্দ্রীয় দুই হেভিওয়েট নেতা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন। তাদের সঙ্গে মুলাদী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুস সত্তার খান ও ব্যারিস্টার মনিরুজ্জামান আসাদ নিজ নিজ এলাকায় প্রচার চালাচ্ছেন।
অপরদিকে জামায়াতের একক প্রার্থী হিসেবে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন বরিশাল মহানগর শাখার আমির ও বাবুগঞ্জের কেদারপুর ইউনিয়নের অধ্যক্ষ জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর। তিনি নানাভাবে নির্বাচনি প্রচার চালাচ্ছেন।
এছাড়া এবি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ এ আসনে প্রার্থী হচ্ছেন। তিনি বাবুগঞ্জের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। এমনকি মাঠ পর্যায়েও ব্যাপক সাড়া মিলছে বলে জানান তার কর্মী-সমর্থকরা।
আবার ইসলামী আন্দোলনের বরিশাল বিভাগীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা কমিটির সভাপতি উপাধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলামও প্রার্থী হচ্ছেন। তবে এ আসনে এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদসহ অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নেই।
বিএনপি নেতা সেলিমা রহমান বলেন, ‘সুখে-দুঃখে জনগণের পাশে ছিলাম, আছি এবং থাকব। দল যাকেই মনোনয়ন দেবে, তার পক্ষেই নির্বাচন করব।’
অ্যাডভোকেট জয়নুল বলেন, ‘দলের দুর্দিনে হামলা-মামলার শিকার হওয়া নেতাকর্মীদের পাশে ছিলাম। বাবুগঞ্জ ও মুলাদী উপজেলার সব পর্যায়ের নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমার পক্ষে কাজ করছেন। মনোনয়নের ব্যাপারেও আমি আশাবাদী।’
অধ্যক্ষ জহির বলেন, জামায়াত নির্বাচনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। ইতোমধ্যেই তিনি বাবুগঞ্জের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মন জয় করেছেন। মতবিনিময় করতে গিয়ে পাচ্ছেন অভূতপূর্ব সাড়া।
ব্যারিস্টার ফুয়াদ বলেন, বাবুগঞ্জসহ বরিশালের উন্নয়নে কাজ করছেন তিনি। মানুষ এখন আর চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, দখলদার ও লুটপাটকারীদের পছন্দ করে না। তাই তিনি জনগণের রায় পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।
বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ)
সংসদীয় আসনটি বরাবরই বিএনপির ঘাঁটি ছিল। এবারও দখলে রাখার চেষ্টায় মাঠে নেমেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক সংসদ সদস্য মেজবাহ উদ্দীন ফরহাদ, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান, জেলা উত্তর বিএনপির সদস্য অ্যাডভোকেট এম হেলাল উদ্দীন, সাবেক ছাত্রনেতা আবদুল খালেক হাওলাদার, বরিশাল জেলা (উত্তর) বিএনপির আহ্বায়ক দেওয়ান মো. শহিদুল্লাহ।
অপরদিকে বেশ আগেই মনোনয়ন পাওয়া জেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক মাওলানা আবদুল জব্বার আছেন ফুরফুরে মেজাজে। তিনি রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছেন; এতে ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছেন।
বরিশাল-৫ (সদর)
বরিশালের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু সদরের আসন। এই মাঠ বরাবরই বিএনপির নিয়ন্ত্রণে ছিল। আওয়ামী জমানায় অবৈধভাবে দখল করে দুঃশাসন চালিয়েছে ফ্যাসিবাদী দলটি। এবার সেটি ভোটের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করতে চান বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার, কেন্দ্রীয় বিএনপির বরিশাল বিভাগীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট বিলকিস আক্তার জাহান শিরিন, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাছের মোহাম্মদ রহমতুল্লাহ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবায়েদুল হক চাঁন ও জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবুল কালাম শাহীন।
এদিকে আসনটিতে প্রভাব বিস্তার করতে সরব জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের নেতারা। এখানে মনোনয়ন পেয়েছেন জামায়াতের সহ-সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট মুয়ায্যম হোসাইন হেলাল।
আর ইসলামী আন্দোলনের সম্ভাব্য প্রার্থী সংগঠনের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মু. ফয়জুল করীম। বিগত বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন।
অ্যাডভোকেট মজিবর বলেন, ‘বরিশাল বিএনপির ঘাঁটিÑএটা সবাই জানেন। এখানে জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থীকেই সমর্থন করবেন ভোটাররা। দল আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় নেতাকে মনোনয়ন দিলে আমি আশাবাদী।’
জামায়াত নেতা হেলাল বলেন, ‘দেশের মানুষ পরিবর্তন চায়। আওয়ামী-বিএনপির ৫৩ বছরের অদল-বদল রাজনীতির পরিবর্তে নতুন ধারার রাজনীতির জন্যই মানুষ জামায়াতকে বেছে নেবে। চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসমুক্ত মানবিক বাংলাদেশ গড়তে জামায়াতের বিকল্প নেই। জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে মানুষ ভুল করবে না বলে আশা করছি।’
মুফতি ফয়জুল করীম বলেন, ‘এখনো প্রার্থী ঠিক হয়নি। নির্বাচন জোটগত হবে, নাকি স্বতন্ত্র হবেÑতার ওপর নির্ভর করেই প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হবে। তবে আমরা নির্বাচনের মাঠেই আছি।’
বরিশাল-৬ (বাকেরগঞ্জ)
জেলার সীমান্তবর্তী এই আসনেও বইছে নির্বাচনি হাওয়া। এখানে দীর্ঘদিন রাজত্ব করেছে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি। এবারেব প্রেক্ষাপট আলাদা। পুনরুদ্ধারে মরিয়া বিএনপি, আর নতুন করে আধিপত্য বিস্তার করতে চায় জামায়াতসহ ইসলামপন্থিরা। এবার বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক এমপি ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হোসেন খান, কেন্দ্রীয় নেতা ও জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম খান রাজন, কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক নুরুল ইসলাম খান মাসুদ এবং যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি নেতা সোলায়মান সেরনিয়াবাত। ইতোমধ্যে তারা নিজ নিজ এলাকায় প্রচার শুরু করেছেন।
অ্যাডভোকেট নজরুল বলেন, প্রচার চালাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। দলের মনোনয়নের ব্যাপারেও আমি আশাবাদী।
অপরদিকে প্রত্যন্ত এলাকার এই আসনে জামায়াতের মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা শাখার সেক্রেটারি মাওলানা মাহমুদুন নবী। দল আগেই তার নাম চূড়ান্ত করায় বেশ কিছুদিন থেকে চালাচ্ছেন প্রচার। সন্ত্রাস-চাঁদাবাজমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছেন বলে তার দাবি।
সাধারণ ভোটারদের কেউ কেউ বলছেন, বড় দুই দল দেখা হয়েছে। তাদের কাছে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি জাতির। এবার নতুন বাংলাদেশে নতুন কাউকে দেখতে চাচ্ছেন তারা।
আবার কেউ বলছেন, শহীদ জিয়ার আদর্শ ধারণ না করায় গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন জাতীয়তাবাদী অনেক নেতা। তবে আওয়ামী লীগের দমন-পীড়ন সহ্য করে যারা এলাকায় ছিলেন, তাদের যেন দল মূল্যায়ন করে, অন্যথায় ভোট পাওয়া কষ্টকর হবে।