
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে এখনো অনড়। এমন পরিস্থিতিতে আগামী শুক্রবার লন্ডনে একান্ত বৈঠকে বসছেন ড. ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষকেরা এই বৈঠককে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন। কেউ কেউ বলছেন, এই বৈঠক থেকে দেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনের পথ উন্মুক্ত হতে পারে। নির্বাচনের সময় নিয়ে মতভিন্নতা দূর হতে পারে। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, দুই পক্ষ কোনো বিষয়ে নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকলে দূরত্ব আরও বাড়তে পারে। তাই সবার নজর এখন শুক্রবারের ওই বৈঠকের দিকে।
বিএনপি আশা করছে, বৈঠকটি দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট কাটাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল মঙ্গলবার এমন আশাবাদ জানিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, সাম্প্রতিককালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও অবস্থানে এই বৈঠক একটি বড় ঘটনা। এটি একটি বড় টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে।
সংকট নিরসনে আশা জাগানো ড. ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকটি হবে সেন্ট্রাল লন্ডনের দ্য ডরচেস্টার হোটেলে। শুক্রবার লন্ডনের সময় সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত এই বৈঠকের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো শুরু থেকে জরুরি সংস্কার শেষে ডিসেম্বরে নির্বাচন দাবি করছে। তবে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কিছু দল রাষ্ট্র সংস্কার, জুলাই হত্যাযজ্ঞসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। নির্বাচনের সময় ও সংস্কারের ব্যাপ্তি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ ও মতপার্থক্য প্রকাশ্য এবং নেপথ্যের নানামুখী তৎপরতায় দূর হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে শুক্রবার লন্ডনে বৈঠকে বসছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ড. ইউনূসের সরকারি সফরে লন্ডনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর থেকে তারেক রহমানের সঙ্গে সেখানে তাঁর বৈঠকের সম্ভাবনা নিয়ে নেপথ্যে যোগাযোগ শুরু হয়।
উভয় পক্ষ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বৈঠকটি যাতে ভালোভাবে শেষ হয়, যেন ইতিবাচক কিছু পাওয়া যায়—এগুলো সামনে রেখে কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য কমিয়ে আনার ও প্রয়োজনীয় দর-কষাকষির কাজটি গত প্রায় দুই সপ্তাহে এগিয়ে রেখেছেন দুই নেতার ঘনিষ্ঠ কয়েক ব্যক্তি।
এ বৈঠকের বিষয়ে গতকাল বিএনপির মহাসচিব বলেন, জাতীয়ভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ বৈঠকের গুরুত্ব অনেক বেশি। বৈঠকটি হলে অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে এবং অনেক কিছু সহজ হয়ে যেতে পারে। নতুন মাত্রা সৃষ্টি হতে পারে। তবে তিনি বলেন, মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমান কীভাবে সেই সম্ভাবনার দিকে বৈঠকটিকে নিয়ে যাবেন, তা এখন তাঁদের ওপর নির্ভর করবে।
বৈঠকটির পূর্বনির্ধারিত কোনো আলোচ্যসূচি নেই জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, সামগ্রিক বিষয় নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলাপ হবে। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির গত সোমবারের সভায় মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে উঠতে পারে, এমন বিভিন্ন ইস্যুতে দলের অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। দলের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে সম্পূর্ণ এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে।
জাতির উদ্দেশে ৬ জুন দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা আগামী এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেন। তবে বিএনপি পরদিন ডিসেম্বরে ভোটের দাবিতে অনড় থাকার কথা বলেছে।
বিএনপির ভেতরের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিলে ভোট হলে কী কী অসুবিধা, আর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট হলে কী কী সুবিধা, তা লন্ডনের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে ব্যাখ্যা করা হতে পারে। অন্য সব বিষয়ে বড় মতভেদ না থাকলে সময়ের ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে আগামী রমজান মাসের আগে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট অনুষ্ঠানে দলটি রাজি হতে পারে।
এদিকে মুহাম্মদ ইউনূসের ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, প্রধান উপদেষ্টা সংস্কারের কয়েকটি প্রস্তাবে তারেক রহমানের সম্মতি আদায়ের চেষ্টা করতে পারেন। ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে ভারসাম্য আনা, দুবারের বেশি একই ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ বন্ধ করা ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা যায় কি না—এসব বিষয় আলোচনায় আনতে পারেন তিনি।
বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, দলটি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কাটছাঁটে রাজি থাকলেও সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন না করার বিষয়ে অনড় থাকবে। এর বাইরে বৈঠকে উপদেষ্টা পরিষদ ও অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক পক্ষপাত ও জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রভাবের দিকগুলো দলের পক্ষ থেকে তোলা হতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টা এপ্রিলের শুরুতে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার পর স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও এনসিপির কয়েকজন নেতা আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগ্রহ জানান।
আগামী শুক্রবারের বৈঠকের ঠিক দুই মাস আগে ১৩ এপ্রিল তারেক রহমানের সঙ্গে তাঁর লন্ডনের বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ও নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। এ বৈঠকের বিষয়ে জামায়াতের একজন ঊর্ধ্বতন নেতা আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিএনপি বিভিন্ন ইস্যুতে ভবিষ্যতে কী অবস্থান নেয়, তার ওপর দেশের রাজনৈতিক ও অন্যান্য পরিস্থিতি অনেকটা নির্ভর করবে। জামায়াত এ কারণে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবভিত্তিক পন্থায় এগোতে চায়।
জামায়াত আগামী রমজানের আগে নির্বাচনের কথা বলেছে। দলের আমির গত রোববার মৌলভীবাজারের বড়লেখায় এক সমাবেশে বলেন, একান্ত কোনো কারণে নির্বাচন পেছালে, সেটি অবশ্যই এপ্রিল অতিক্রম করা উচিত নয়।
ড. ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের লন্ডনের বৈঠকের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বীর আহমেদ বলেন, নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির টানাপোড়েন চলছে। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকলেও তারেক রহমান দলের সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা। তাঁর সম্মতি ছাড়া সমাধান আসবে না। এ কারণে বৈঠকটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, বৈঠকটি কেমন হয়, দুই নেতা সেখানে কী ভূমিকা নেন, তার ওপর এর সাফল্য নির্ভর করবে।
অধ্যাপক সাব্বীর আহমেদ আরও বলেন, ‘শুধু মুখ দেখাদেখি হলে, আর কথাবার্তা একজন বললেন অন্যজন শুনলেন, এমন হলে ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম। যদি তাঁরা খোলামনে মতবিনিময় ও ভাববিনিময় করতে পারেন, তাহলে বৈঠকটি ফলপ্রসূ হওয়ার সুযোগ আছে।’ তিনি বলেন, দুই নেতা বিভিন্ন ইস্যুতে নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকলে সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব আরও বাড়তে পারে।