
আগামী বছর এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল শুক্রবার (০৬ জুন) সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এ ঘোষণা দেন।
নির্বাচনের সময়সীমা উল্লেখ করতে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনসংক্রান্ত চলমান সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করে আমি আজ দেশবাসীর কাছে ঘোষণা করছি যে আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন উপযুক্ত সময়ে আপনাদের কাছে নির্বাচনের বিস্তারিত রোডম্যাপ প্রদান করবে।’
প্রধান উপদেষ্ঠার এমন ঘোষণার পর দেশের রাজনৈতিকাঙ্গনে দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ সন্তোষ প্রকাশ করলেও বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এ ঘোষণায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তাদের বক্তব্য, বিভিন্ন কারণে এপ্রিলে নির্বাচন সম্ভব নয়। ফলে চলতি বছর ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবিতে অনড় তারা। বিশেষ করে বিএনপির একাধিক নেতা বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার এমন ঘোষণাতে জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।’ তাছাড়া এটিকে কেউ কেউ ‘রাজনৈতিক ভাব্যতার সীমা অতিক্রম’ বলেও মন্তব্য করেছেন।
ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে অনড় বিএনপি
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর গতকাল রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যোগ দেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। পরে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে নির্বাচন নিয়ে দলীয় অবস্থানের কথা জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে হলে আর সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত নির্বাচন প্রয়োজন। তাদের মতে, এই বিলম্বের পেছনে রয়েছে একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রভাব।
এতে আরও বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় ঐক্যের কথা বলছে, কিন্তু বাস্তবে তারা নির্দিষ্ট একটি পক্ষের প্রভাবের বাইরে যেতে পারছে না। এতে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের মতামত উপেক্ষিত হচ্ছে এবং নির্বাচনী নিরপেক্ষতা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে যথেষ্ট প্রশ্ন ও শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
এছাড়া দলটির মহাসচিব আজ ঈদের নামাজ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমাদের শুরু থেকেই দাবি ছিল— ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে। দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাও সেটাই। কিন্তু যেভাবে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি দেশের বাস্তবতা ও জনগণের সুবিধার কথা মাথায় রেখে করা হয়েছে বলে মনে হয় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এপ্রিল মাসে প্রচণ্ড গরম, বৃষ্টি এবং ঝড়ের ঝুঁকি থাকে। এছাড়া ওই সময় রোজা এবং পাবলিক পরীক্ষাও চলবে। এরকম পরিস্থিতিতে নির্বাচন আয়োজন কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। প্রচারণা চালাতেও সমস্যা হবে, বিশেষ করে রমজান মাসে। ফলে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের বিকল্প নেই।’
জামায়াতের সন্তোষ প্রকাশ
নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে দেশের অন্যতম আরেকটি প্রধান রাজনৈতিক দল জামায়েত ইসলামী। শুক্রবার (৬ জুন) দলটির আমির শফিকুর রহমান গণমাধ্যমে এক বিবৃতি পাঠিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
জামায়াত আমির বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মাদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন। তাঁর এই ঘোষণায় জাতি আশ্বস্ত হয়েছে। ঘোষিত সময়ের মধ্যেই তিনি একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে জাতি আশা করছে।’
সিপিবি বলছে, ‘এ বছরই নির্বাচন জরুরি’
দেশের আরেকটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) মনে করছে, চলতি বছরের মধ্যেই নির্বাচন করা জরুরি। এ নিয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘উনি (প্রধান উপদেষ্টা) কী কারণে এপ্রিল মাসে নিয়ে যেতে চাইলেন, আমাদের কাছে বোধগম্য নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘জনগণ এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক দল যা চায়, তার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। আমরা পরিষ্কার করে বলেছি, অবশ্যই ২০২৫-এর মধ্যে নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। নির্বাচন এ বছরের মধ্যেই অনুষ্ঠিত করাটাই জরুরি মনে করি। ’
এনসিপির শর্তসাপেক্ষে সম্মতি
দেশের রাজনীতিতে নবাগত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলেছে, আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে যদি জুলাই সনদ, জুলাই ঘোষণাপত্র ও সংস্কার বাস্তবায়নের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে ঘোষিত এই সময়ে নির্বাচনের বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি নেই।
নির্বাচনের ঘোষিত সময়সীমার বিষয়ে প্রতিক্রিয়ায় গণমাধ্যমকে এ কথা জানান দলটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্রের আনুষ্ঠানিকতা শেষে জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দিক থেকে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য আসবে। তারপরও প্রধান উপদেষ্টা আগামী বছরের এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচনের যে সময়সীমার কথা বলেছেন, যদি এই সময়কালের মধ্যে জুলাই সনদ, জুলাই ঘোষণাপত্র ও সংস্কার বাস্তবায়নের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে ঘোষিত সময়ে নির্বাচনের বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি নেই।’
গণঅধিকার পরিষদ চায় জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারির মধ্যে
নির্বাচন ইস্যুতে দেশের আরেক রাজনৈতিক দল গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি এবং ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত রোজা থাকবে। এরপর ঈদ। আবার ঈদের পর এপ্রিল মাসে পাবলিক পরীক্ষা আছে। সব মিলিয়ে মনে হয়, জানুয়ারিতে কিংবা ফেব্রুয়ারির শুরুতে নির্বাচনের ঘোষণা এলে ভালো হতো।’
গণসংহতির ইতিবাচক মূল্যায়ন
গণসংহতি আন্দোলন প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকে ‘ইতিবাচক অগ্রগতি’ হিসেবে দেখছে। তাদের মতে, বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন বিষয়ে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা ঘোষণার মাধ্যমে সরকার জনগণের প্রত্যাশার দিকেই এগোচ্ছে।
ইসলামী আন্দোলনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম জানান, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় রাজনৈতিক অস্থিরতা কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। এ জন্য তিনি তাঁকে ধন্যবাদ জানান।
নাগরিক ঐক্যের মতে, অনিশ্চয়তা কিছুটা কেটেছে
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণার ফলে একটি বড় ধরনের অনিশ্চয়তা কেটে গেছে। ডিসেম্বর নিয়ে যে সংশয় ছিল, সেটি এখন কিছুটা হলেও নিরসন হয়েছে।’