
ফরিদপুরের নগরকান্দায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক বৈশাখী ইসলাম ওরফে বর্ষা (১৮) ও তার বাবার ওপর হামলার ঘটনায় ছয়জনকে আটক করেছে পুলিশ। স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা এই হামলা চালিয়েছেন বলে ফেসবুক লাইভে অভিযোগ করেন বর্ষা। এমন অভিযোগ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদেরও। তবে এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে নগরকান্দা উপজেলা বিএনপি।
ঘটনার সূত্রপাত:
নগরকান্দার ফুলসূতী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণি পড়ুয়া বৈশাখী ইসলাম ওরফে বর্ষার ছোট বোনকে উত্ত্যক্ত করার ঘটনায় স্থানীয়দের কাছে অভিযোগ জানায় বর্ষার পরিবার। শুক্রবার (৩০ মে) দুপুর ১২টার দিকে স্থানীয়দের নিয়ে উভয় পক্ষের সালিশ বৈঠক বসার কথা ছিল। তবে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও অপর পক্ষ না আসায় ওই সালিশ হয়নি। এ অবস্থায় বর্ষা ও তার বাবা বাবু শেখ নগরকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ জানাতে যান।
এলাকাবাসীর ভাষ্য :
বৈশাখী ইসলাম বর্ষার এক বোন যৌন হয়রানির (ইভটিজিং) শিকার হন একই এলাকার এক ছেলের দ্বারা। বিষয়টি এলাকাবাসীকে জানালে এ ব্যাপারে সালিশ বৈঠক ডাকা হয়। সালিশ বৈঠক না হওয়ায় শুক্রবার বৈশাখী বিষয়টি নিয়ে থানায় অভিযোগ করেন।
ঘটনার দুই প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা :
প্রত্যক্ষদর্শী দুজন জানান, বৈশাখী ইসলাম বর্ষার ওপর হামলার খবর পেয়ে নগরকান্দা থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে যান। একই সময় ফরিদপুর থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থলে যান। এসময় পুলিশ এ হামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আটক করে থানায় নিয়ে আসার চেষ্টা করে। এসময় পুলিশ এলাকাবাসীর প্রতিরোধের মুখে পড়ে। স্থানীয়রা পুলিশ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের কাঠের লাঠি দিয়ে মারধর করে। পরে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে আটক ব্যক্তিদের থানায় নিয়ে আসে। বৈশাখীর ওপর হামলার প্রতিবাদে ফরিদপুর-ভাঙ্গা মহাসড়ক অন্তত কয়েক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। পরে সেনাবাহিনী এসে হামলাকারীদের বিচারের আশ্বাস দিলে সড়ক ছেড়ে দেন তারা।
বৈশাখী ইসলাম বর্ষা ফেসবুকে লাইভে যা বলেন :
ঘটনার পর তাৎক্ষণিক বৈশাখী ইসলাম তার নিজ ফেসবুক আইডি থেকে পরপর দুটি লাইভ করেন। দুটি লাইভ বক্তব্যের একটি এক মিনিট ৯ সেকেন্ড ও অপরটি ২৭ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের। ফেসবুক লাইভে বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমি বৈশাখী ইসলাম। আমি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। আমি একটা ইভটিজিংয়ের কেস নিয়ে প্রতিবাদ করাতে বিএনপির লোকজন আমাকে রাস্তায় ফেলে মারধর করছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের কি জুলাই আন্দোলন করা ভুল ছিল, যার কারণে রাস্তায় ফেলে বিএনপির লোকজন আমাকে মারছে। তারা আমাকে, একজন মেয়ে বলে, ইচ্ছামতো চুল ধরে টেনে লাথি মেরেছে। আমার বাবাকে খুঁজছে মারার জন্য। আমি খুব বাজে অবস্থায় আছি। আমি কী করব, বুঝতে পারছি না।’
বর্ষার মা ফাতেমা বেগমের অভিযোগ :
বর্ষার মা ফাতেমা বেগম জানান, ‘ইউএনওর সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি জানানোর পরে তিনি নগরকান্দা থানায় যেতে বলেন। এরপর তারা নগরকান্দা থানায় যান ও লিখিত অভিযোগ করেন। পরে ৬ জন পুলিশের একটি দল তাদের নিয়ে ভবুকদিয়ায় যায়। ভুবকদিয়া বাজারে পৌঁছানোর পরপরই বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ওই এলাকার সেকেন গাজী, সাগর গাজী, ইমরান, জামাল ব্যাপারীসহ তাদের লোকেরা পুলিশের উপস্থিতিতেই বর্ষা ও তার বাবার ওপরে হামলা চালায়।
পরিবার সূত্র জানায়:
বর্ষার পরিবারের ইভটিজিংয়ের ঘটনা নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম-সম্পাদক বদিউজ্জামান তারা মোল্লার উপস্থিতিতে সালিশ হওয়ার কথা ছিল। তবে তারা মোল্লা নির্ধারিত সময়ে সেখান থেকে আরও পাঁচ কিলোমিটার দুরে নাড়ুয়াহাটি নামকস্থানে আরেকটি সালিশে উপস্থিত থাকায় তিনি এই সালিশে উপস্থিত থাকতে পারেননি।
স্থানীয়রা যা বললেন :
স্থানীয় ফরহাদ মাতুব্বরের ভাই মুরাদ মাতু ডাঙ্গী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের একাংশের আহ্বায়ক। বিগত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে মুরাদ হাওলাদার স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা জামাল হোসেন মিয়ার সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন। তবে হামলার পর পুলিশের ব্যাপক অভিযানে ফরহাদ ও তার লোকজন আত্মগোপনে চলে গেছেন বলে জানা যায়।
এদিকে ফরিদপুরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যুগ্ম-সদস্যসচিব বৈশাখী ইসলাম বর্ষা ও তার বাবা বাবু শেখের ওপরে হামলার পরে সন্ধ্যায় জড়িতদের গ্রেফতার করতে গেলে অভিযুক্তরা সংঘবদ্ধ হয়ে পুলিশসহ ভুক্তভোগীদের ওপরে ফের হামলা চালায়। এতে এক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
চিকিৎসকের বক্তব্য :
নগরকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত চিকিৎসক কুন্তল সাহা জানান, এ ঘটনায় হান্নান শরীফ নামে আহত পুলিশের এক সদস্যকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বিবৃতি:
ফরিদপুরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপত্র কাজী জেবা তাহসিন বলেন, ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে ও প্রতিকার চেয়ে লিখিত বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। লিখিত বিবৃতিতে কাজী জেবা তাহসিন উল্লেখ করেছেন, বিএনপির এক ক্যান্ডিডেট ও তার ছেলে প্রকাশ্য দিবালোকে বর্ষাকে চুল ধরে টেনে মারধর ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। এই নির্মম ও কাপুরুষোচিত হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
ফরিদপুর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক কাজী রিয়াজ বলেন, পুলিশের ওপর হামলা আমরাই প্রতিরোধ করেছি। আমাদের ওপরও হামলার ঘটনা ঘটে। থানার দ্বিতীয় কর্মকর্তা আমিরুল ও থানা পুলিশের গাড়িচালক আব্দুল হান্নান শরীফ লাঞ্ছিত ও আহত হয়েছেন। পরে ওই এলাকায় রাতে সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ যৌথ অভিযান শুরু করেছে। ফলে অত্র এলাকা পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে।
পুলিশের হাতে আটক ৬:
ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পুলিশ ছয়জনকে আটক করেছে। আটকরা হলেন, ওই এলাকার আরিফ হোসেন (২৪), মো. আজিজুল শেখ (১৬), শরিফ শেখ (২০), সজিব শেখ (২৩) এবং সাজ্জাদ শেখ (১৭)।
যা বললেন বিএনপির নেতারা:
নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বদিউজ্জামান মোল্লা জানান, ওই সমন্বয়ক ও যে ছেলের সঙ্গে এ ঘটনা তারা দুই পরিবারই আওয়ামী লীগ ঘরনার পরিবারের সদস্য। ঘটনার সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই।
নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, এটি ভাবুকদিয়া গ্রামে দুই পরিবারের অভ্যন্তরীণ ঘটনা। এর সঙ্গে বিএনপি কিংবা রাজনৈতিক কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
আহত পুলিশ সদস্য ও পুলিশের বক্তব্য:
নগরকান্দা থানা পুলিশের গাড়িচালক আব্দুল হান্নান শরীফ (৫৬) বলেন, সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমরা আসামি ধরে আনতে গেলে স্থানীয় প্রায় দেড় শতাধিক লোকজন পুলিশের গাড়ি ঘিরে ফেলে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য। স্থানীয়রা আমার হাত ও মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে গাড়ির চাবি ছিনিয়ে নিয়ে যায়, গাড়ির পর্দা ছিড়ে ফেলে। তবে তারা আসামি ছিনিয়ে নিতে পারেনি। তাদের গ্রেফতার করে থানায় আনা হয়েছে।
ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নগরকান্দা সার্কেলের অতিরিক্ত দায়িত্বরত) আসিফ ইকবাল বলেন, একটি মেয়েকে উত্ত্যক্তের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা ঘটে। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে ও যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। এ ছাড়া উত্ত্যক্তকারী যুবক শরীফ বেপারীসহ কয়েক জনকে আটক করা হয়েছে ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় অভিযান চলছে।
নগরকান্দার ইউএনও মো. কাফী বিন কাদির বলেন, বিষয়টি জানতে পেরেছি। আমি ভবুকদিয়া এলাকায় একটি বড় ঘটনার মধ্যে ঝামেলাতে আছি। এ বিষয়ে পরবর্তীতে কথা বলে বিস্তারিত তথ্য জানানো সম্ভব হবে। এছাড়াও বিষয়টি নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধিন।
এর আগে শুক্রবার (৩০ মে) বিকেলে নগরকান্দা উপজেলার ভবুকদিয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ফরিদপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যুগ্ম-সদস্য সচিব বৈশাখী ইসলাম বর্ষা (১৮) ও তার বাবা বাবু শেখের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। ঘটনার প্রতিবাদে ফরিদপুর-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। বর্ষা ওই এলাকার বাবু শেখের মেয়ে। তিনি ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের শিক্ষার্থী।