Image description

প্রায় সপ্তাহজুড়ে চলা ঘোলাটে রাজনৈতিক পরিস্থিতির আপাতত অবসান হয়েছে বলে রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ আরো কয়েকটি স্টেকহোল্ডারের সাথে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, তা অভ্যন্তরীণ আলোচনার মধ্য দিয়ে কিছুটা কমে এসেছে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে সরকারকে চাপে রাখার অংশ হিসেবে দু’টি ইস্যুতে রাজধানীতে টানা যে বিক্ষোভ চালিয়েছে, সেটিও আপাতত বন্ধ করা হয়েছে। জানা গেছে, সেনাপ্রধানের তরফ থেকে নির্বাচন, মানবিক করিডোরসহ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দেয়া বক্তব্য সরকার আমলে নিয়েছে। একই সাথে বিএনপিকেও আশ্বস্ত করার প্রচেষ্টা চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, সরকার দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যেও হতে পারে। এ দিকে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপিকেও উত্তেজনা তৈরি না করে ঐক্যের ভিত্তিতে এগিয়ে যেতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

 
 

গণ-অভ্যুত্থানের ৯ মাসের মাথায় অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একধরনের দূরত্ব এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিবদমান পরিস্থিতিতে গত এক সপ্তাহ ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা ঘটনার উদ্ভব হয়। ঢাকার দক্ষিণে মেয়র পদে ইঞ্জিনিয়ার ইশরাকের শপথ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের নেতা সৌম্য হত্যার প্রতিবাদে রাজধানীতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে বিএনপির নেতাকর্মীরা। আদালতের রায় এবং নির্বাচন কমিশনের গেজেট প্রকাশের পরও ইশরাকের শপথ না পড়ানোর জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে দায়ী করা হয়। ফলে ইশরাকের পক্ষে মাঠে নেতাকর্মীরা আসিফ মাহমুদ এবং ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করা আরেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের পদত্যাগ চেয়ে রাজপথে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে ছাত্রদের রাজনৈতিক দল এনসিপি বিএনপির এই অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করে। তারা পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে নির্বাচন কমিশনে বিক্ষোভ করে কমিশন সদস্যদের পদত্যাগ দাবি করে। এই নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে পাল্টাপাল্টি রাজনীতি চলে।

 

জানা গেছে, বিএনপি ইশরাক ও ছাত্রদল নেতা হত্যার প্রতিবাদে নেতাকর্মীদের মাঠে নামায় মূলত সরকারকে এই বার্তা দিতে যে, বিএনপি চাইলে সরকারকে যেকোনো সময়ই অসহযোগিতা করতে পারে। বারবার নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের দাবি জানিয়ে এলেও সরকার সে দিকে কর্ণপাত না করায় দলটি বেশ কিছু দিন ধরে তাদের ক্ষুব্ধ অবস্থান প্রকাশ করে আসছিল। নির্বাচন ইস্যুতে সরকারের অবস্থান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যদি নির্বাচনের দাবিতে কোনো দিন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে ঘেরাও করতে হয়, তা হবে জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।’ পরিস্থিতি ঘোলাটে না করে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দাবি জানান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দলটির স্থায়ী কমিটি এরপর সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে নেতাকর্মীদের মাঠে নামায়। এতে অচল হয়ে পড়ে রাজধানী।

 
 

জানা গেছে, হঠাৎ করে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির এই শক্ত অবস্থানের পেছনে কিছু সন্দেহ ও সংশয় কাজ করেছে। এক দিকে নির্বাচনের রোডম্যপ চেয়েও না পাওয়া, অন্য দিকে সরকারের কিছু সিদ্ধান্তে অথবা কথাবার্তায় দলটির মধ্যে নির্বাচন বিলম্ব করার কিংবা সরকার দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারে এমন শঙ্কা তৈরি হয়। এর মধ্যে রাখাইনে মানবিক করিডোর দেয়ার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা না করায় বিএনপি দারুণ ক্ষুব্ধ হয়। দলটি মনে করে, যেখানে সরকারের নির্বাচন, সংস্কার ও আওয়ামী লীগের বিচার ফোকাস করা উচিত, সেখানে তারা এমন সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের দিকে হাঁটছে যেগুলো দেশকে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে।

 
 

কিছুদিন ধরে বিএনপিসহ আরো বিভিন্ন শ্রেণীপেশার এই চলমান বিক্ষোভের মধ্যে সেনাবাহিনীও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। নানা গুজবও এ সময় ছড়িয়ে পরে। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে এমন অপপ্রচার সোস্যাল মিডিয়াতে চালানো হয়। এ রকম অবস্থায় গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনবাহিনীর প্রধান অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সাথে বৈঠক করেন।

এরপর দিন গত বুধবার সেনাপ্রধান ঢাকা সেনানিবাসের সেনা প্রাঙ্গণে অফিসার্স অ্যাড্রেসে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত বলে নিজের মতামত জানান। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, দেশের ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারণের অধিকার একটি নির্বাচিত সরকারেরই রয়েছে। সেনাপ্রধান মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোর সংক্রান্ত আলোচনার বিষয়েও কথা বলেন। তিনি বলেন, রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকার থেকেই আসতে হবে এবং তা বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই হতে হবে। এখানে জাতীয় স্বার্থ দেখতে হবে। যা করার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করেই করতে হবে। যা-ই করা হোক না কেন, পলিটিক্যাল কনসেনসাসের (রাজনৈতিক ঐকমত্য) মাধ্যমে সেটা হতে হবে। ‘মব ভায়োলেন্স’ বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার সঙ্ঘবদ্ধ বিশৃঙ্খলা বা আক্রমণের বিরুদ্ধেও কঠোর বার্তা দেন জেনারেল ওয়াকার।

তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সেনাবাহিনী এখন আরো কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে। সঙ্ঘবদ্ধ জনতার নামে বিশৃঙ্খলা বা সহিংসতা আর সহ্য করা হবে না। সংস্কার প্রসঙ্গে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, কী সংস্কার হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে, এ বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নেই। এ বিষয়ে তাঁর সাথে কোনো পরামর্শ বা আলোচনা করা হয়নি। গণ-অভ্যুত্থানের পর যে সেনাপ্রধানের মধ্যস্থতায় বর্তমান সরকার গঠিত হয়েছে, তার পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য নতুন বার্তা হিসেবে আলোচিত হচ্ছে।

জানা গেছে, সরকারের তরফ থেকে আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে যে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে, সেটির সুনির্দিষ্ট একটি ঘোষণা ঈদের পর আসতে পারে। একইসাথে বিএনপির সাথে দূরত্ব ঘোচানোরও উদ্যোগ নিতে কয়েকজন উপদেষ্টাকে দায়িত্ব দেয়া হতে পারে, যেটি শুরুতে থাকলেও মাঝখানে হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জানা গেছে, ড. ইউনূস নিজেও দ্রুত নির্বাচন চান। তিনি যে প্রাথমিক রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন, সেটির বাইরে তিনি শুরু থেকে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়ার প্রক্ষিতে সেই নির্বাচন ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যেও হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার ও জুলাই চার্টার ঘোষণার বিষয়টি দ্রুত শেষ করে নিয়ে আসতে পারে।

দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সোশ্যাল মিডিয়াও বেশ সরগরম হয়ে ওঠে। এর মধ্যে কারো কারো মন্তব্য বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এক্স হ্যান্ডেল এবং ফেসবুক দুই মাধ্যমেই অনেকে তাদের মন্তব্য ও বক্তব্য প্রকাশ করেন। বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক মার্কিন উপ রাষ্ট্রদূত জন ড্যানিলোভিচ এক্স এ মন্তব্য করেছেন, ‘যদিও কেউ কেউ বাংলাদেশে বেসামরিক-সামরিক সংঘাতের প্রচারণা চালাচ্ছে, তবে বর্তমান অনিশ্চয়তার মূল কারণ জুলাই/আগস্ট জোটের মধ্যে ক্ষমতার জন্য দৌড়ঝাঁপ। বাইরের পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিকোণ থেকে, এর সমাধানের উপায় বেশ স্পষ্ট। সেটি হলো একটি ঐকমত্য সংস্কার প্যাকেজের চুক্তি; জুলাই সনদ ঘোষণা; নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা; এবং নির্বাচিত সরকারে স্থানান্তর। এই সবকিছু ২০২৬ সালের জানুয়ারির মধ্যে সম্পন্ন হতে পারে তবে কেবল যদি সবাই তাদের ভূমিকা পালন করে।’

ড্যানিলোভিচ আরো লিখেন, ‘অভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং কাদা ছোড়াছুড়িতে কেবল প্রাক্তন সরকার এবং তার পৃষ্ঠপোষকদেরই লাভবান করবে, যারা ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের এবং তাদের অপরাধের জন্য দায়ী হওয়া এড়াতে সুযোগ খুঁজছে। যদি এটি আমার ওপর নির্ভর করত, আমি প্রধান উপদেষ্টা এবং এনসিপি, বিএনপি এবং বিজেআই-এর প্রধানদের একটি ঘরে আমন্ত্রণ জানাতাম এবং এগিয়ে যাওয়ার পথে একমত না হওয়া পর্যন্ত দরজা বন্ধ করে দিতাম। এখন যেহেতু একজন নতুন পোপ নির্বাচিত হয়েছেন, সম্ভবত তারা বাংলাদেশী স্টাইলের কনক্লেভের জন্য সিস্টিন চ্যাপেল ব্যবহার করতে পারেন।’