
রাজনীতির নয়া মেরুতে বাংলাদেশ। জটিল হচ্ছে আগামীর রাজনীতিও। গতানুগতিক রাজনীতির ধারাবাহিকতায় ঘটেছে ছন্দপতন। ৩৬ জুলাই ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর রাজনীতির নয়া বন্দোবস্তে এমন দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে।
৭১ পরবর্তী জনগণের গণআন্দোলনে ক্ষমতার মসনদ থেকে এভাবে কোনো প্রধানমন্ত্রী, এমপি, মন্ত্রী এবং দলটির ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ সকল অনুসারীর জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম বলছেন রাজনৈতিক বিশেজ্ঞরা। ইতোমধ্যে জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালে গণহত্যা চালানোর দায়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এবং দলটির নিবন্ধনও স্থগিত করা হয়েছে।
গণহত্যার দায়ে দলটির শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির দাবিতে এখন উত্তাল দেশ। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে আসা অনেকটাই অসম্ভব মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ক্লিন ইমেজের ব্যক্তিদের নিয়ে আওয়ামী লীগে যে লেয়ার তৈরি করা হয়েছিল, দেশ থেকে আবদুল হামিদের পালিয়ে যাওয়া এবং আইভী রহমানের গ্রেপ্তারের পর সেই পথও এখন বন্ধ।
এ ছাড়াও দেশের রাজনীতিতে জুলাইয়ের বিপ্লবী নেতা ও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাকর্মীদের চাওয়া চাহিদার মধ্যে তৈরি হয়েছে ভিন্নতা। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের যেকোনো বড় ইস্যুতেই বড় দলগুলো থেকে বাধা তৈরির ঘটনাগুলো স্পষ্ট হচ্ছে। হাসিনা পতনে বিপ্লব পরবর্তী তরুণরা চব্বিশের ঘোষণাপত্র ঘোষণা করতে চেয়েছিল, সেখানে বড় দলগুলো এবং সরকারের একটি অংশ থেকে সরাসরি আপত্তি আসলে অনেকটাই থমকে যায়।
অবশেষে আবারও জুলাই আবহে গত সপ্তাহ থেকে শাহবাগ থেকে যমুনায় লাখো মানুষের গণআন্দোলন শুরু হলে, গত রবিবার রাতে সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে যেমন বাধ্য হয়, তেমনি ৩০ দিনের মধ্যে ঘোষণাপত্র দেওয়ার ডেডলাইনও ঘোষণা দেওয়া হয়। যদিও এ নিয়ে বড় দলগুলো আগামীর রাজনীতির সৌন্দর্য কথা চিন্তা করে সরাসরি নিষিদ্ধের পক্ষে ছিলেন না।
বড় দল বিএনপি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার পক্ষে সরাসরি না থাকা সত্ত্বেও তরুণদের দাবি আদায় হওয়ায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেমন মেরুকরণ হচ্ছে, তেমনি পুরানো রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি করা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে বলেও মনে করছেন রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ মহল। ইতোমধ্যে একটি দাবি আদায়ের পর ছাত্রজনতা সংবিধান বাতিল, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অযোগ্য ও সন্ত্রাসী দল হিসেবে ঘোষণা, নির্বাচনের আগেই বিচার নিশ্চিত, গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিতে নতুনভাবে মাঠে নামছে। এতে যদি তারুণ্যশক্তি জয় লাভ করে, তাহলে আগামীতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জটিল সমিকরণ তৈরি হবে। বড় দলগুলোকে জনগণের অনেক শক্ত প্রতিবাদের মুখোমুখি হতে হবে।
অতীতে দেখা যেত ভোট আসলে জোট বাড়ে, নতুন দল আসে। এবার জুলাই বিপ্লবের পর ভোটের আগেই ডজনের ওপরে রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। জুলাই বিপ্লবে এক দফার ঘোষক নাহিদ ইসলাম এবং অন্যতম আরও কয়েকজন সমন্বয়কদের নিয়ে দুটো দল গঠন হয়েছে। এগুলো নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে শক্তিশালী এলায়েন্স তৈরি করে বড় দলগুলোকে চ্যালঞ্জের মুখেও ফেলবে ধারণা করা হচ্ছে।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে বিএনপির অন্তত অর্ধডজন নেতার ভাষ্য জানতে চাইলে তারা বলেন, বিএনপি নির্বাচন প্রসঙ্গ নিয়ে শক্তভাবে মাঠে নামলেও সেখানে বড় ভাবে ধাক্কা খেয়ে এখন নরমে গরমে থাকার নীতি গ্রহণ করেছে দলটি। কোনো পালটা বিষয়ে যাবে না তারা। দলটির শীর্ষ এক উপদেষ্টা নাম প্রকাশে অনিশ্চুপ হয়ে বলেন, বিএনপি অতীতের চাইতেও কঠিন সময়ে রয়েছে। বিএনপি এখন দায় বহনের সময় পার করছে।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধসহ এখন তরুণ রাজনৈতিক নেতারা যত কাজ করছেন, ভবিষ্যতে তার দায়ভার গ্রহণ করতে হবে বিএনপিকে। বিএনপিকে অবশ্যই এই সময়ের সকল কাজের কাফ্ফারা আদায় করতে হবে মনে করছেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবির জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নয়া মেরু তৈরি হচ্ছে এটা এখন বলাই যায়। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তরুণরা যারা রাজনীতিতে আসছে তাদের ভাবনা চিন্তা সবার মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। তরুণরা তারুণ্যের ভাষায় যে কাজটা করতে চাচ্ছে, সেটা আবার বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদরা খুব সহজে গ্রহণ করতে চাচ্ছে না।
রাজনীতির পুরানো ব্যবস্থা থেকে তরুণরা সরে আসছে। তরুণরা ১৮ বছরের দুঃশাসনসহ রাজনীতিতে অপছন্দনীয় বিষয়গুলো দূর করে নতুনভাবে সাজাচ্ছে। আমরা এখন সামগ্রিকভাবে দেখছি তরুণরা জনগণের সমর্থন পাচ্ছে। একইভাবে চ্যালেঞ্জিং কাজগুলোতেও সফল হচ্ছে।
সাবেক এই কূটনীতিক আরও বলেন, সব মিলিয়ে রাজনীতিতে যে মেরুকরণ হচ্ছে, এটি এখন উড়িয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আগের প্রজন্মের রাজনীতিবিদরা চ্যালেঞ্জিং কাজগুলো অনেক হিসাব নিকাশ করে করতে চাইলেও তরুণরা সেগুলো দ্রুতই করতে চায়। প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সবটাতেই ভিন্নতা এসেছে। চিন্তা এবং কাজের অনেক গতিও বৃদ্ধি পেয়েছে। যার কারণে তারুণ্যের গণবিপ্লবে পুরানো রাজনৈতিক দলের অনিয়ম এবং খারাপ আচরণগুলো ভেঙে গেছে বলেও তিনি যোগ করেন।
যার ফলে তারুণ্যের কাজগুলো অনেক ধারালো এবং মজবুত হচ্ছে। অতীতে রাজনীতির গতিবিধি দেখে কিছু ধারণা করা গেলেও এখন সেগুলো করা দুস্কর। আজ আগামীকালের ভাষা বুঝা এখন অনেকটাই মুশকিল। তবে তরুণদের প্রাধান্য না দিলে পুরানো রাজনৈতিক দলগুলো যে বড় চ্যালেঞ্জে পড়বে আগামীতে এবং রাজনীতির মেরুতে যে তাদের শক্তভাবে পড়তে হতে পাওে, সেটা কিছুটা অনুমান করা যায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানি ড. দিলারা চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, ছাত্র-জনতা গণবিপ্লবে আওয়ামী লীগের যে পতন হয়েছে, এরপর থেকেই আমরা জুলাই চেতনার আলোকে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা শুনে আসছি। তার আলোকে পুরানো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তরুণদের মতামতের কিছু ভিন্নতা দেখছি। এক্ষেত্রে তরুণরা কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করছেন।
একদিকে যেমন সফল হচ্ছেন, অন্যদিকে রাজনৈতিক নানা মেরুকরণের বিষয়গুলো যুক্ত হচ্ছে তরুণদের জন্য। ছাত্র-জনতার দাবির প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ হয়েছে। একই সঙ্গে জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয় ও ডেডলাইন দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। সংবিধান পরিবর্তন, গণপরিষদ নির্বাচন আরও বড় বড় বিষয়ে পরিবর্তন আনার জন্য চ্যালেঞ্জিং ঘোষণা দিয়েছে তরুণরা।
সব মিলিয়ে এখানে অনেকের আদর্শগত বিষয়গুলোও এখন স্পষ্ট হচ্ছে । বড় দলের সঙ্গে তরুণদের ভাবনা এবং মৌলিক কর্ম সম্পাদন বাস্তবায়নের দূরত্ব দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বড় দলগুলো নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, আবার তরুণরা প্রশংসিতও হচ্ছে।
এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, বলা যায় দেশের চলমান রাজনীতি এখন একটা ছন্দহীন অবস্থার মধ্যে রয়েছে। আগে যে রকম রাজনীতির গতিবিধি লক্ষ্য রেখে কিছুটা ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা যেত, এখন সেটা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে বলা চলে। বর্তমানে অমুক দলের লোকবল বেশি, জনপ্রিয়তা বেশি, তারাই ক্ষমতায় আসবে আবার ওই দলের লোকবল কম, জনপ্রিয়তা কম, তারা কিছুই করতে পারবে না এটার হিসাব বলাও এখন মুশকিল।
জনগণ এখন তারুণ্যকে সাড়া দিচ্ছে, এই সাড়া দেওয়াটা আগামীর রাজনীতির জন্য যেমন শুভ লক্ষণ, তেমনি রাজনৈতিক সমীকরণ নির্ধারণ করা জটিল পথের দিকে এগোচ্ছে সেটাও স্পষ্ট। দেশের রাজনীতি গতানুগতিক ধারার ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, নতুন সংবিধান প্রণয়ন ছাড়া নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রয়োজন নেই। বিগত সময়ের সংবিধান মানবাধিকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। নতুন সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে আস্থা ও সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব। আমাদের মৌলিক সংস্কারের দিকে এগোতে হবে।
মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য না হয়ে অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে একমত হওয়া ফলপ্রসূ হবে না। বিচার কার্যক্রমের একটি অংশ ইতোমধ্যে এগিয়েছে। এখন প্রয়োজন বিচারিক রোডম্যাপকে স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা। এতে জনগণের মধ্যে আস্থা জন্মাবে।