Image description

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তে রাজনীতিতে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকা দলটির কার্যক্রম স্বাধীন দেশে প্রথমবার নিষিদ্ধ ঘোষিত হলো। গণতন্ত্রের নীতি সামনে রেখে গড়া দলটি গত দেড় দশকে যে দানবীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল তার মাসুল হিসেবে চরম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন এর নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগের টানা ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। দলটির কার্যক্রমের প্রতি মানুষের ক্ষোভ আর হতাশা থেকেই গড়ে উঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যা পরে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণ- আন্দোলনে রূপ নেয়। 

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বর্বর গণহত্যার দায়ে ৫ই আগস্টের পরই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আওয়াজ উঠে বিভিন্ন পক্ষ থেকে। গণহত্যা ও লুটপাটে জড়িত দলটির নেতাকর্মীদের বিচারে ইতিমধ্যে সরকারের তরফে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু সেই উদ্যোগের ধীরগতিতে হতাশ জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে অংশ নেয়া পক্ষগুলো। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষ অনেক নেতা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মেয়াদের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ দেশ ছাড়ায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। নতুন করে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় সারা দেশে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান থেকে পরে শাহবাগে টানা দুইদিনের অবস্থান কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন দল ও সংগঠন। তাদের জোরালো দাবি ও কর্মসূচির জেরেই শনিবার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ছিল নানা আলোচনা। নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া বিভিন্ন পক্ষ, জামায়াতসহ বিভিন্ন ইসলামী দল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের জোরালো দাবি জানিয়ে আসছিল। তবে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি সরাসরি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিরোধী ছিল। দলটির পক্ষ থেকে কয়েক দফা প্রধান উপদেষ্টাকে এ বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়। বিএনপি’র দাবি ছিল গণহত্যা ও লুটপাটে জড়িত আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচার নিশ্চিত করা এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা। সর্বশেষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি এমনটাই দাবি করে আসছিল। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে বিএনপি স্বাগত জানিয়েছে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার পরপরই আনন্দ মিছিল করে জামায়াতে ইসলামী। দলটির নেতাকর্মীরা রাতে শোকরানা নামাজও আদায় করেন। দলটির আমীর রাতে তাৎক্ষণিক জমায়েতে বক্তব্যও রাখেন। সরকারি সিদ্ধান্তের পর কিছুটা সময় নিলেও জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাকর্মীরা শেষ রাতে শাহবাগের অবস্থান তুলে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার সরকারি সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে অন্যান্য রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের মতো তাদের সহযোগী অন্যান্য দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি জানাচ্ছে এসব দল। 

ওদিকে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার পর রাজনীতিতে চলছে নানা আলোচনা। দেখা দিয়েছে চাঞ্চল্য। দলটির ভবিষ্যৎ কী হবে, রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন থাকবে কিনা, না থাকলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে এই দলটির নেতাকর্মীদের অবস্থান কী হবে- এমন নানা প্রশ্ন সামনে আসছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে কার্যত আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। সামনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দলটির শীর্ষ নেতাদের বিচার হবে। ব্যক্তির অপরাধের বিচারের সঙ্গে সংগঠনের বিচারের এখতিয়ারও এই ট্রাইব্যুনালকে দেয়া হয়েছে। দলটির শীর্ষ নেতারা গণহত্যার দায়ে দণ্ডিত হলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগও শাস্তির মুখে পড়বে। দলটির কার্যক্রম স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত হতে পারে। সম্ভাব্য এমন পরিস্থিতি মাথায় রেখে দলটির নেতাকর্মীরাও চিন্তিত। দল নিষিদ্ধ থাকলে জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বা দলটির নেতাদের অংশ নেয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে বিচার প্রক্রিয়া জোরালো হলে শীর্ষ অনেক নেতা এমনিতে নির্বাচনের অযোগ্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সামনের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ছাড়া নয়া এক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। মাঠের রাজনীতিতে এখন প্রধান দল বিএনপি এবং জামায়াত। নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি দলীয় অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। চরমোনাই’র পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন ইসলামী দলগুলোর একটি নির্বাচনী মোর্চা গঠনের চেষ্টা করছে। ভোটের মাঠে এই মোর্চা একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনের জোট সঙ্গীদের নিয়ে লড়বে- এমনটা বলা হচ্ছে। জামায়াত কোনো জোট গড়বে নাকি এককভাবে নির্বাচন করবে- তা এখনো স্পষ্ট নয়। এনসিপি’র অবস্থাও একই। এ ছাড়া অন্যান্য দলগুলোর মধ্যে জোট গড়ার প্রচেষ্টা রয়েছে। দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলেও  ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের অবস্থান কোনো না কোনোভাবে থেকে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। নির্বাচনের সময় দলটির নেতাকর্মীদের কৌশল ভোটের মাঠের পরিস্থিতিও বদলে দিতে পারে। বিশেষ করে রাজনীতির ময়দানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গন্তব্য কী হবে- এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইতিমধ্যে দলটির অনেক নেতাকর্মী বিভিন্ন দলে ভিড়তে শুরু করেছেন। 

যদিও আগামী নির্বাচন নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তার ঘোর কাটেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে পারেনি। গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার পর নতুন গুঞ্জন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে এমন কথাও বলছেন কেউ কেউ। রাজনীতিতে মাইনাস ফর্মুলার আলোচনাও জারি আছে। এমন অবস্থায় সামনে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।