
বিচারকাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে বিএনপি, জামায়াতসহ সব রাজনৈতিক দল। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থকগোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবেন—সরকারের এ সিদ্ধান্তকেও স্বাগত জানিয়েছে। দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের মতে, জাতিসংঘ ঘোষিত গণহত্যাকারী দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাহী আদেশে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে বিচারিক প্রক্রিয়ায় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তারা চেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ যে সীমাহীন অন্যায়, জুলুম ও লুটপাট করেছে তাতে দলটির বিরুদ্ধে জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে ফুঁসে উঠেছে। অতএব এই পদক্ষেপ যুক্তিযুক্ত এবং এতে নাগরিকদের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে। নেতাদের প্রত্যাশা—অতি দ্রুততার সঙ্গে বিচারিক প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার এবং দল হিসাবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ও গণমানুষের কথাগুলো বলেছিলাম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নজির আছে যেসব ফ্যাসিবাদী দল গণহত্যার জন্য দায়ী দল হিসাবে তাদের বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে এসে নিষিদ্ধ করা হয়। এর উদাহরণ সারা পৃথিবীতে আছে। সুতরাং দেরিতে হলেও অন্তর্বর্তী সরকার আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করবে এই ঘোষণা দেওয়ার জন্য স্বাগত জানাই।
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের মাধ্যমে আমাদের প্রাণের দাবির আংশিক পূরণ হয়েছে। তবে পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। জুলাই প্রোক্লেমেশন এখনো আসেনি। বিপ্লবের পূর্ণাঙ্গ ঘোষণা এখনো পাইনি। তবে আমাদের ধৈর্যের সঙ্গে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা জুলাইকে কোনোভাবেই হারিয়ে যেতে দেব না। বরং তা দেশ, জাতি, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যথাযথভাবে কাজে লাগাব।
আওয়ামী লীগের বিচার প্রসঙ্গে বলেন, আমরা শহিদ পরিবারের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছি। তারা সরকারের কাছে কোনো আর্থিক সহযোগিতা চান না। বরং তারা দ্রুততার সঙ্গে শেখ হাসিনাসহ তার দোসরদের বিচার চান। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে জনগণের দাবির আংশিক পূরণ হয়েছে। আশা করি বর্তমান বিপ্লবী সরকার জনগণের আবেগ-অনুভূতি ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে যৌক্তিক সব দাবি পূরণ করবে।
শনিবার রাতে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগ ও এর নেতাদের বিচারকাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আইন উপদেষ্টা আরও জানান, সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থকগোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে। এর পাশাপাশি উপদেষ্টা পরিষদ আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করে প্রকাশ করার সিদ্ধান্তও নিয়েছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, আওয়ামী লীগ যে মাত্রায় অপরাধ করেছে তাতে অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের প্রথম কার্যদিবসেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়া উচিত ছিল। সরকার তা করেনি। আমরা বারবার বিভিন্নভাবে এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করতে জনতাকে বৈশাখের প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যে লাগাতার আন্দোলন করতে হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থান অবরোধ করতে হয়েছে। তথাপিও উপদেষ্টা পরিষদ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
তিনি বলেন, মানুষের প্রত্যাশা ছিল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে। কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। এতে জনতার প্রত্যাশার একাংশ পূরণ হয়েছে। আমরা চাই অতি দ্রুততার সঙ্গে বিচারিক প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার শেষ করে রায় বাস্তবায়ন করা হবে এবং দল হিসাবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি এলডিপির প্রেসিডেন্ট ড. অলি আহমদ বলেন, প্রায় নয় মাস পর, জনতার প্রতিরোধ, তরুণ প্রজন্মের সাহসিকতা ও বিভিন্ন গণতান্ত্রিক শক্তির সম্মিলিত চাপে অবশেষে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই এবং এটিকে ভবিষ্যতের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসাবে দেখি।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, গণহত্যার বিচার সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গেই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ জড়িত এবং গতিপথ নির্ধারিত হবে। এটি আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী কৃতকর্মের নৈতিক পরীক্ষা যা ন্যায়বিচার, মানবিকতা এবং গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতার এক অগ্নিপরীক্ষা। তবে রাষ্ট্রকে অবশ্যই অভিযুক্ত হিসাবে আওয়ামী লীগের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের মাধ্যমে গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের বিচার ও দলীয় কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় সরকারকে অভিনন্দন জানাই। জাতিসংঘ ঘোষিত গণহত্যাকারী দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাহী আদেশে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না দিয়ে আমরা চাচ্ছিলাম বিচারিক প্রক্রিয়ায় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। আওয়ামী লীগ যে সীমাহীন অন্যায়, জুলুম ও লুটপাট করেছে তাতে এ দলটার বিরুদ্ধে জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে ফুঁসে উঠেছে, অতএব এই পদক্ষেপ যুক্তিযুক্ত এবং এতে নাগরিকদের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে বলে আমরা মনে করি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এতদিন ট্রাইব্যুনালে দল হিসাবে আওয়ামী লীগের বিচারের কোনো বিধান ছিল না। এ বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এই ঘটনাগুলো ইতিবাচক।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মুহাম্মাদ মামুনুল হক ও মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের সব রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্তকে সময়োচিত, বাস্তবধর্মী এবং দেশ ও জাতির স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করছি। এই সাহসী পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার অতীতের অবিচার ও নিপীড়নের বিচারিক পথ সুগম করল। বিগত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের জনগণের ওপর যে সীমাহীন নির্যাতন, হত্যা, গুম, গ্রেফতার ও দমন-পীড়ন চালিয়েছে, তা ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠাগুলো ধ্বংস, বিরোধী মত দমন এবং ইসলামপন্থিদের ওপর অমানবিক হামলা, নির্যাতন-নিপীড়নসহ ইত্যাকার অপরাধের বিচারকাজ নির্বিঘ্নে ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে হলে এ নিষেধাজ্ঞা অপরিহার্য ছিল।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়েছে। গণহত্যার বিচারপূর্বক নিবন্ধনও স্থগিত বা বাতিল করতে হবে। এবং দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি করে আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদী দল হিসাবে চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। তাহলেই এই বিপ্লব সম্পূর্ণ হবে।