Image description

মাসুম খলিলী


মধ্যরাতে ভেসে ওঠা ফেইসবুকের খবরটা আমাকে জানায়নি। ফজরের নামাজ পড়ে  সবে মাত্র গা এলিয়ে দিয়েছি এমন সময় ফোনটা এলো। এতো ঘনিষ্ঠ কণ্ঠ নাম্বার সেভ না থাকলেও কে বলছেন প্রশ্ন করাটা বিব্রতকর মনে হলো। তিনি জানালেন ওবায়েদ ভাই আর নেই। ওবায়েদ মানে ড. আবু জাফর মোহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ। আমার ৫ দশকের বন্ধু- গাইড। আমার স্ত্রী জানতেন খবরটা আমার জন্য কতটা শক্ড় হবে। এ জন্য হয়তো  ঘুম ভাঙিয়ে জানায়নি।


সে ১৯৭৮ সালের গোড়ার কথা। আমি সাতকানিয়া  সরকারি কলেজ থেকে ইন্টার শেষ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। যাওয়া-আসা করি শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখনো ওবায়েদ ভাই উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র আর সম্ভবত চট্টগ্রামে  শিশু কিশোর সংগঠন ঝিঙে ফুলের আসরের পরিচালক। এর এক বছর পর ওবাযেদ ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকপ্রশাসনে ভর্তি হন। লোক প্রশাসন এক সময় রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের শাখা ছিল। আমি ছিলাম অভিন্ন রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের শেষ ব্যাচের  ছাত্র আর ওবায়েদ ভাই ছিলেন পৃথক হওয়া লোক প্রশাসন বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ প্রফেসর মুহাম্মদ আনিসুজ্জামান ছিলেন রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান। এক বছর পর তিনি লোকপ্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহন করেন। ওবায়েদ ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরই আনিস স্যারের প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন। স্যারের পরিকল্পনা ছিল ওবায়েদ ভাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক করবেন। কিন্তু তার এক্সট্টা কারিকুলার নানা কর্মকাণ্ড ও কমিটমেন্ট একাডেমিক মনোনিবেশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।


অনার্স শেষ করার আগেই ওবায়েদ ভাই চলে যান ঢাকায়। বৃহত্তর কর্তব্য কাধে নিতে হয় উনাকে। প্রথমে প্রকাশনা বিভাগের দায়িত্ব। পরে জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন ফুলকুড়ি  আসরের প্রধান পরিচালকের দায়িত্ব নিতে হয়। এ সময় ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের নেতা আব্দুল মালেক শহীদের স্মৃতি উপলক্ষে একটি বৃহৎ  প্রকাশনার সিদ্ধান্ত হয়। তখন ওবায়েদ ভাইয়ের পরামর্শে চট্টগ্রাম  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকায় আসি। শামসু ভাই এতে আপত্তি করেননি। ঢাকায় এসে প্রথমে কলাবাগান মেসে এবং পরে কাঠাল বাগানের ঢালে ফ্রি স্কুলের স্ট্রীটে এক বাসায় ওঠে। এ ফ্লাটের একটি অংশে ছিল ফুলকুড়ির অফিস আরেকটি অংশে ওবায়েদ ভাই, আমি ও ফরিদী নুমান থাকতাম। পাশেই আরেক বাসায় থাকতেন জব্বার ভাই কবির ভাই ও মিলন ইসলাম। আরেক পাশেই ছিল কবি আবিদ আজাদের শিল্পতরু প্রকাশনীর অফিস।


কবি আল মাহমুদ ছিলেন ফুলকুঁড়ি আসরের উপদেষ্টা।  আমি তখন দৈনিক সংগ্রামে পূর্ণকালীন সাংবাদিক হিসাবে যোগ দিয়েছি। সেই সাথে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু সম্পাদিত নতুন ঢাকা ডাইজেস্টে সহকারী সম্পাদক হিসাবে কাজ করি। তখন ফ্র্রি স্কুল স্ট্রিটে আমার রুম ছিল ঢাকা ডাইজেস্টের প্রোডাকশন সেন্টারের মতো। মাঝে মধ্যে কবি আল মাহমুদকে এখানে এনে আমরা লেখায় বসিয়ে দিতাম। শিল্পকলা একাডেমির  কাজ শেষ করে মাহমুদ ভাই কোন সময় আমাদের এখানে কোন সময় শিল্পতরু অফিসে আড্ডা দিতেন। এই ধরনের আড্ডায় অন্যতম মধ্যমনি ছিলেন ওবায়েদ ভাইু। ওবায়েদ ভাইকে কবি এতো স্নেহ করতেন যে তিনি হয়ে ওঠেন আল মাহমুদের পরিবারের একটি অংশ। পরিবারের যে কোন ভালো মন্দে তিনি থাকতেন পাশে।


এ সময় ওবায়েদ ভাইয়ের সম্পাদনায় অঙ্গীকার নামে একটি সাহিত্য সংস্কৃতি পত্রিকা প্রকাশ করি। কবি আল মাহমুদ ছিলেন এর উপদেষ্টা। নিয়মিত লেখক ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান ও আবদুল মান্নান সৈয়দ। আর কবি বুলবুল সরওয়ার ও আমি পত্রিকার অন্যতম দুই ‘কান্ডারি’। স্বল্পস্থায়ী অঙ্গীকার প্রকাশনী থেকে আমরা আল মাহমুদের আলোচিত আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘যেভাবে বেড়ে ওঠি’ প্রকাশ করি। এ সময় বুলবুল ঢাকা মেডিক্যালের ছাত্র, আমি সংগ্রামের রিপোর্টার আর ওবায়েদ ভাই বৃহত্তর আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। ওবায়েদ ভাইয়ের নেতৃত্বে আমি ও বুলবুল এ সময় কিশোর মাসিক’ কিশোর কণ্ঠ’ প্রকাশের সাথে যুক্ত হই। এ কাজে পরামর্শক ছিলেন অগ্রজ মাসুদ আলী ও হামিদ ভাই।


এর পর অনেক সময় পেরিয়ে যায়, বুলবুল খ্যাতনামা ডাক্তার ও লেখক হয়, রিপোর্টার হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা কিছুটা বাড়ে। ওবায়েদ ভাই বৃহত্তর ছাত্র আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত থেকে ব্যস্ততম এক সময় পার করেন। এর মধ্যেও পুরনো আড্ডার আয়োজন সুযোগ পেলেই হতো। এ সব আড্ডায় বুলবুল সরওয়ার, হামিদুল ইসলাম, সোলায়মান আহসান, মরহুম শফিউল আলম রতন, এস এম মিলন ইসলাম, ফরিদী নুমানসহ আরো অনেকেই থাকতাম।
ওবায়েদ ভাই ছিলেন দিলদরাজ মানুষ, রতন নুমান আবিদ লসকর তাসবির বলতেন আজ ওবায়েদ ভাইয়ের সৌজন্যে খাওয়া হবে। তিনি অবলীলায় রাজী হয়ে যেতেন। তিনি নিজের বয়সের চেয়ে ১০ বছর হয়তো এগিয়ে ছিলেন। আমরা বয়সে কেউ কেউ কিছুটা বড় হলেও ওবায়েদ ভাইকে সেভাবেই দেখতাম। তিনি হয়ে ওঠতেন ছোট বড় অনেকের গাইড। 


সেই সোনালী সময়ের স্মৃতিময় দিনগুলোর অনেকেই এখন নেই। কবি আল মাহমুদের সাথের দিনগুলো এখন কেবলই স্মৃতি। ছেলে মেয়ে নাতি নাতনিদের কাছে এসব স্মৃতি আওড়িয়ে গিন্নিকে মাঝে মাঝে পুলকিত হতে দেখি। অবাক হয়ে বড় নাতি নানুর কাছে জানতে চায় কবি দাদু কি আমাদের এই বাসায় এসেছিলেন। ওর কাছে কবির পরিচয় হলো মুখস্ত করা তার ছড়াগুলো।


আমাদের পুরণো আড্ডার শফিউল আলম রতন অনেক আগেই দুনিয়ার সফর শেষ করেছেন। মল্লিক ভাইও চলে গেছেন বেশ আগে। আসাদ বিন হাফিজও নেই। আরেক বন্ধু বেলাল ভাইয়ের বিদায় ছিল একেবারে ট্রাজিক। এসএম মিলন ইসলাম সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় থাকলেও যোগাযোগে সবচেয়ে কাছে রয়েছে বলে মনে হয়। সে সময়ের অনেক কিছু স্মৃতিতে এখন ভীড় করছে। এসবের অনেকটা কেন্দ্রেই ছিলেন ওবায়েদ ভাই। বিচিত্র প্রতিভার এক মানুষ ছিলেন তিনি। 


একদিন কোন এক অনুষ্ঠানে ওবায়েদ ভাই ছিলেন উনার আব্বার সাথে। পেছন থেকে একজন বলেন ওবায়েদ ভাইয়ের সাথে উনার বড় ভাইয়ের অনেক মিল। পাশে থেকে একজন শুধরে দেয় উনি ওবায়েদ ভাইয়ের বাবা। আজ ওবায়েদ ভাই নেই, পিতার জন্য এটি সইয়ে নেয়া বেশ কঠিন। আর আমরা বন্ধুরাই যেখানে ওবায়েদ ভাইয়ের বিদায়কে কল্পনায় আনতে পারছি না। সেখানে তার ছেলে মেয়েরা ভাবী কিভাবে মানছেন? 


চন্দরপুরা অফিসের একদিনের কথা মনে পড়ে। মফিজ ভাই বৈঠকে সভাপতিত্ব করছেন। পাশে বসে ওবায়েদ ভাই দিব্বি ঘুমিয়ে নিচ্ছেন। হঠাৎ মফিজ ভাইয়ের হুংকার আ জ ম বলতো আমরা  বৈঠকে কি নিয়ে আলোচনা করছিলাম। চোখ মুছতে মুছতে ওবায়েদ ভাই ঠিকই বৈঠকের সবকিছু বলে দিলেন। একসাথে ঘুমানো আর সিরিয়াস বৈঠকের সব আলোচনা মনে রাখা কিভাবে সম্ভব মিলাতে পারতাম না। আমরা শুধু বলতাম ওবায়েদ ভাই মানে এক্সট্রা জিনিয়াস কিছু। 


ওবায়েদ ভাই ছিলেন ব্যস্ততম মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক করার বিষয়ে আনিস স্যারের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তবে তিনি একজন শিক্ষাবিদের চেয়ে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছেন নিজের ৬ দশকের জীবনে। কত হাজার শিশু কিশোরকে মানুষ হবার পথ দেখিয়েছেন ওবায়েদ ভাই সেটি সর্বশক্তিমানই জানেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে  এমন এক মানুষকে হারিয়েছি যিনি ছিলেন আমার প্রায় ৫ দশকের ছাত্র ও কর্মজীবনের একজন বন্ধু ও গাইড। 
আজ দুনিয়ার সফর শেষের এই সময়ে ওবায়েদ ভাইয়ের অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম দুই জায়গায়ই ওবায়েদ ভাই দায়িত্ব পালন করতেন। ঢাকায় সাহিত্য সংস্কৃতি বিভাগের প্রধান। চট্টগ্রামে মহানগর আন্দোলনের দ্বিতীয় ব্যক্তি এবং ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সির ট্রাস্টি হিসাবে কাজ করেন। ওবায়েদ ভাই ঢাকায় এলে সুযোগ পেলে দেখা করতাম, একসাথে নির্বাক বন্ধু  বুলবুল সরওয়ারকে দেখতে যেতাম। এবার ১ মে চট্টগ্রাম গিয়ে ফোন দিয়েছিলাম। ওবায়েদ ভাই বললেন উনি ঢাকায় এসেছেন। আবার পরদিন চট্টগ্রামে চলে যাবেন। ফোনের এই কথাই আমাদের শেষ কথা। এর কয়েক দিন পর ফেসবুকে দেখি ওবায়েদ ভাই হাসপাতালে ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে। ভেবেছিলাম ওবায়েদ ভাই সুস্থ হয়ে ওঠবেন। আবার একসাথে দেখা হবে। আড্ডা হবে। কিন্তু আমাদের কার কখন সময় শেষ হবে তা তো কেবল পরোয়ারদিগারই জানেন। 
ওবায়েদ ভাইয়ের চলে যাওয়া হবে মা-বাবা ছেলেমেয়ে ভাবীর জন্য অনেক কষ্টের। সবকিছুর নিয়ন্তা নিশ্চয় আল্লাহ। তিনি সবাইকে শোক সহ্যের ক্ষমতা দেবেন। আর দুনিয়ার জীবনে  ছোটখাটো কোনো ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করে জান্নাতের বাগানে যেন ওবায়েদ ভাইকে পরিবারের সবার সাথে মিলিত করেন সেই প্রার্থনা রাব্বুল আলামিনের কাছে।