
আওয়ামী লীগের নেতার দেশের ভেতর-বাইরে বেশ সক্রিয়। চালাচ্ছেন নানা অপতৎপরতা। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নেতাকর্মীদের উসকে দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। শুধু তাই নয়, পার্শ্ববর্তী একটি দেশে বসে নিয়মিতভাবে গোপন বৈঠকও করছেন তারা।
এমনকি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও নেতাকর্মীদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলছেন। উদ্দেশ্য-দেশকে অস্থিতিশীল করে বর্তমান সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক গতি ব্যাহত করা। এক্ষেত্রে যে কোনো সময় বড় ধরনের নাশকতা ঘটিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে পারে-এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
তাদের আরও অভিমত-নাশকতার কাজে ব্যবহার করা হতে পারে আওয়ামী নেতাকর্মীদের হাতে থাকা সাড়ে ৫ হাজার অস্ত্র। ফ্যাসিবাদ সরকারের ১৫ বছরে ইস্যু করা এসব অস্ত্র অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জমা পড়েনি। ফলে এগুলো ইতোমধ্যেই অবৈধ হয়েছে।
এছাড়া পুলিশের কাছ থেকে লুট হওয়া এক হাজার ৩৭৫ অস্ত্র এবং দুই লাখ ৫৭ হাজার ৮৪৯ রাউন্ড গোলা-বারুদ এখনো উদ্ধার হয়নি। এর বড় অংশই চলে গেছে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ক্যাডারদের হাতে-এমনটি মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগের পলাতক গডফাদাররা অনেকদিন ধরেই দেশে নাশকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছিলেন। তাদের অপতৎপরতা থেমে নেই। অব্যাহতভাবেই তারা দেশের পরিস্থিতি অস্থির করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। গোপন বৈঠকের পাশাপাশি তারা অনলাইনে বেশি তৎপর। দেশের বাইরে থেকে পলাতক নেতারা নির্দেশ দিচ্ছেন অনলাইনে। তাদের বিরুদ্ধে সাইবার আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের প্রয়োগ খুব একটা হচ্ছে না। আগামী দিনগুলোতে এই অ্যাক্টকে অধিকতর কার্যকর করার প্রক্রিয়া চলছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মী অস্ত্র জমা দেননি, তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই মাঠপর্যায়ে এর প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক মাসুদ কামাল যুগান্তরকে বলেন, গত ১৭-১৮ বছরে আওয়ামী লীগ অনেক টাকা লুটপাট করেছে। তাদের পক্ষে ওই টাকা ব্যয় করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা খুব একটা কঠিন ব্যাপার না। কিন্তু সরকারকে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে-এটা সরকারের ব্যাপার। এগুলো নিয়ন্ত্রণ না করে পলাতক নেতাদের ওপর দোষ চাপিয়ে দায় এড়ানো যাবে না।
এক প্রশ্নের জবাবে মাসুদ কামাল বলেন, যেসব অস্ত্র লুট হয়েছে সেগুলো নিশ্চয়ই ভালো মানুষের হাতে পড়েনি। দুষ্কতকারী এবং সন্ত্রাসীদের হাতেই পড়েছে। সুতরাং দেশে অন্যায়-অপরাধ তো হবেই। আমি মনে করি আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার কারণে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে না। এ কারণেই নানা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সূত্র জানায়, দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে একের পর এক চক্রান্ত শুরু করে পরাজিত রাজনৈতিক শক্তি। নানা ইস্যুতে গড়ে তোলা হয় একের পর এক অন্দোলন। এসব অন্দোলনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেপথ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতারা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা টেলিফোন বা গ্রুপ কলে উসকে দিয়েছেন এসব অন্দোলন।
শেখ হাসিনার পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় ভেস্তে যায় আওয়ামী লীগের প্রাথমিক লক্ষ্য। এরপর শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র। শক্তি বৃদ্ধির নির্দেশনা দেওয়া হয় দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে। এরই অংশ হিসাবে সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল করে তারা। ২০ এপ্রিল খুলনা ও শরীয়তপুরে তারা বড় মিছিল করে।
এছাড়া মিছিল করেছে-বরিশাল, যশোর, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, রাজধানীর মিরপুর, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, পল্লবী, যাত্রাবাড়ী, মহাখালী এবং লালবাগসহ বিভিন্ন স্থানে।
শক্তির জানান দিতেই রোববার গাজীপুরে জাতীয় নগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহর ওপর হামলা করা হয়। এর আগে ৮ ফেব্রুয়ারি বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ওপর হামলা চালায় সাবেক মন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা আ ক ম মোজাম্মেল হকের ক্যাডাররা। এতে এক ছাত্র গুলিবিদ্ধ হন।
এছাড়া ভারতে অবস্থান করে সম্প্রতি গাইবান্ধার আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথোপকথনে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ২২৭টি মামলা হয়েছে। তাই ২২৭ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়ে গেছি।’ এটি যে শেখ হাসিনার বক্তব্য তা ফরেনসিক বিশ্লেষণে প্রমাণ পেয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। শেখ হাসিনার এ ধরনের বক্তব্য দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করতে নেতাকর্মীদের উসকে দেওয়া হচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছেন।
এর আগে বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতার সঙ্গে শেখ হাসিনার টেলিফোন কথোপকথন এবং তার বক্তৃতা ভাইরাল হয়েছে। তার একটি ভার্চুয়াল বক্তব্যের পর ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী নেতাদের বাড়িঘর, অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
সাবেক আইজিপি আব্দুল কাইয়ুম যুগান্তরকে বলেন, যারা অস্ত্র জমা না দিয়ে সরকারের নির্দেশ অমান্য করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এই অস্ত্রগুলোর বিষয়ে সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। লাইসেন্সগুলো বাতিল হওয়া দরকার। ইতোমধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। যারা অস্ত্র জমা দেয়নি তাদের মধ্যে অনেক দুষ্কৃতকারী থাকতে পারে। ওই দুষ্কৃতকারীরা যে কোনো সময় নাশকতা ঘটাতে পারে। তারা কোথায় আছে তা জানা দরকার।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব ইউনিটকে আরও জোরালো অভিযান চালাতে হবে। এ ক্ষেত্রে জনসাধারণসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। না হলে সুযোগ সন্ধানী মহল ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করবেই।
একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগের পলাতক গডফাদাররা বড় ধরনের নাশকতার মাধ্যমে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চায় বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। তারা পার্শ্ববর্তী একটি দেশে বসে নিয়মিতভাবে গোপন বৈঠক করছেন। আমরা বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা পলাতক থাকলেও দেশের ভেতরেই অবস্থান করছে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। এদের মাধ্যমেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। আওয়ামী লীগের যেসব নেতার হাতে অবৈধ অস্ত্র আছে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। চিহ্নিত নেতারা পলাতক থাকায় তাদের গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। তবে অস্ত্রগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এছাড়া পুলিশের কাছ থেকে লুট হওয়া অস্ত্র তাদের হাতে গেছে কিনা সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, যারা অস্ত্র জমা দেননি তারা এখন অবৈধ অস্ত্রধারী। তাই তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করা উচিত। পাশাপাশি লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান আরও জোরদার করা উচিত। তিনি বলেন, পরাজিত রাজনৈতিক শক্তি সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করতেই পারে। সরকারকে এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অপশক্তিকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে সারা দেশে অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল ১৯ হাজার ৫৯৪টি। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জমা পড়ে ১৪ হাজার ৮৩টি অস্ত্র। এখনো জমা হয়নি ৫ হাজার ৫১১টি অস্ত্র। জমা না হওয়া বেশিরভাগ অস্ত্রই আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা এবং এমপি-মন্ত্রীদের নামে লাইসেন্স করা।
এসব অস্ত্র ইতোমধ্যেই অবৈধ হয়ে গেছে। অপরদিকে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে ঢাকাসহ সারা দেশে থানা, ফাঁড়ি, বক্সসহ বিভিন্ন ইউনিট থেকে লুট হওয়া এক হাজার ৩৭৫টি অস্ত্র এবং ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৪৯টি গোলাবারুদ এখনো উদ্ধার হয়নি।
এসব অস্ত্র এবং গোলাবারুদ উদ্ধারে সারা দেশে অভিযান চলছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর। তিনি যুগান্তরকে বলেন, পুলিশের অস্ত্র বাহিরে থাকবে এটা কাম্য নয়। কোথাও যেন এসব অস্ত্রের ব্যবহার আর না হয়- সেজন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। যে ব্যবহার করবে তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। যতদিন পর্যন্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার না হয় ততদিন পর্যন্ত আমাদের উদ্ধার কার্যক্রম চলবে। এটা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কারও কাছে লুট হওয়া অস্ত্রের তথ্য থাকলে তা পুলিশকে জানানোর অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, অস্ত্র উদ্ধারে অনেকে সহযোগিতা করেছেন।
তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমরা অভিযান চালিয়ে এরই মধ্যে অনেক অস্ত্র ও গোলা-বারুদ উদ্ধার করেছি। আওয়ামী লীগ আমলের লাইসেন্সকৃত অস্ত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, নির্ধারিত সময়ে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। যারা জমা দেননি তাদের অস্ত্রগুলো অবৈধ অস্ত্র হয়ে গেছে।