২০২৪ সালের প্রথম সাত মাসে দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী ছিল টানা ১৫ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ। ক্ষমতার দম্ভে ধরাকে করেছে সরা জ্ঞান। প্রতিপক্ষ তো রাখেইনি, নিজেদের সতীর্থ জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলকেও কোণঠাসা করে রেখেছিল। অথচ ৫ আগস্টের পর দলটির নেতাদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
অজ্ঞাত স্থানে থাকা গুটি কয়েক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা গেলেও বেশিরভাগই আছেন আত্মগোপনে। আন্ডারগ্রাউন্ড দলের মতোই ফেসবুক পেজে কর্মসূচি ঘোষণা করলেও এটি বাস্তবায়নে হাতে গোনা কয়েকজন কর্মীর বাইরে কারো দেখা মিলে না।
চব্বিশের শুরু হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শিরোনামে গোজামিলের ইশতেহার দিয়ে একতরফা নির্বাচন করে দলটি। জনগণের অংশগ্রহণ না থাকলেও ‘ডামি’ প্রার্থী দিয়ে নিজেরা নিজেরাই নির্বাচন করেন। মনোনয়নেও ত্যাগীদের বাদ দিয়ে ব্যবসায়ী ও টাকার কুমিরদের প্রাধান্য দেয়। ফলে মুখ ফিরিয়ে নেন প্রকৃত রাজনীতিকরা। ভোটার সংকটের ওই নির্বাচনে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পদদলিত করে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতা আরোহণ করে আওয়ামী লীগ।
বহির্বিশ্বের অব্যাহত চাপ, নিজেদের অর্থপাচারের প্রভাব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা কারণে শুরুতেই বেকায়দায় পড়ে দলটি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দল গড়ায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও। জাতীয় নির্বাচনের মতো বিরোধী দলহীন সিটি করপোরেশন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়ায় আওয়ামী লীগ। পরিবারতন্ত্র, পেশিশক্তি ও অর্থের প্রভাবে বেশিরভাগ উপজেলায় প্রকৃত আওয়ামী লীগ নেতারাও দলবিচ্ছিন্ন হয়ে যান। জনসমর্থন তলানিতে গেলেও প্রশাসন নির্ভর সরকার পড়ে যায় বেকায়দায়।
দেশি-বিদেশি নানা চাপের মুখে পর্যুদস্ত সরকারের সাত মাসের মধ্যেই কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সামাল দিতে ব্যর্থ হয়। দাম্ভিক সরকার প্রধানের ভুলে ভুলে ভয়ংকর পতন ও পলায়ন নিশ্চিত হয়। ছন্নছাড়া আওয়ামী লীগের ভুল শুধরে দল গোছানোর পরিবর্তে নেতৃত্বের গোঁড়ামি ও একতরফা দোষারোপের রাজনীতি দিয়ে জনধিকৃতের মধ্যেই শেষ হচ্ছে বছর। তবে দলটির নেতাদের প্রত্যাশা, তারা নিজেদের ভুল শুধরে ঘুরে দাঁড়াবেন।
৫ চ্যালেঞ্জ নিয়ে ২০২৪ যাত্রা
২০২৪ সালের শুরুতেই আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের নতুন বছরে পাঁচটি চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়েছিলেন। নির্বাচনী বৈতরণি পার, অর্থনৈতিক ধাক্কা সামাল দেওয়া, রিজার্ভ সংকট কাটানো, সেবায় দুর্নীতিরোধ ও দেশি-বিদেশি চাপ সামলানো। আওয়ামী লীগ নেতারা বছরের শুরুতে দাবি করেছিলেন, তারা এসব চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করতে পারবেন। কারণ তাদের একজন শেখ হাসিনা আছেন। ‘ডামি’ প্রার্থীদের কল্যাণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী বৈতরণি পার করতে পারলেও বাকি চ্যালেঞ্জগুলো সামাল দেওয়ার পরিবর্তে জিইয়ে রাখেন। বিশেষ করে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। যার কারণে আরও কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়। যার পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই জলঘোলা
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ভোটগ্রহণ হয়। বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ অনেকগুলো দল বর্জন করে। মিত্রদের নিয়ে করা ওই ডামি নির্বাচনে ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসন পায় আওয়ামী লীগ। মিত্র জাতীয় পার্টি ও বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলেন। ৯ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন ভোটের ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করে। ১০ জানুয়ারি জয়ী সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন।
নির্বাচনে জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হলেও তাদের জোর করে নির্বাচনে আনার অভিযোগ করেন দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পায়নি বলেও অভিযোগ করেন।
ওই নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি এতটাই কম ছিল যে কোথাও কোথাও মাইকিং করেও ভোটার আনা যায়নি। ভোট উৎসবের পরিবর্তে নীরবে ভোট বর্জনের প্রতিবাদ ফুটে ওঠে। ভোটগ্রহণ শুরুর তিন ঘণ্টা পরেও ভোট দেয়ার হার কোথাও ছিল ৩ শতাংশ, কোথাও ৫ কিংবা ৮ শতাংশ। এছাড়াও দিনভর ভোটকে কেন্দ্র করে অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন স্থানে নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ, হামলা, গুলি, ককটেল বিস্ফোরণ, জাল ভোট, ব্যালট বাক্সে আগুন, ব্যালট পেপার ছিনতাই, এজেন্টদের কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা ও নৌকার পক্ষে প্রকাশ্যে সিল মারার ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে শক্তি হারিয়েছে তৃণমূল
পরিবারতন্ত্রকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ঢাকায় দলের কোমর ভাঙে বহু আগেই। সব শেষ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তৃণমূলের শক্তি নষ্ট করে দলটি। জাতীয় নির্বাচনের কালো দাগ না কাটতেই বেশ কয়েকটি সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও চার ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। নিজেদের মধ্যে হানাহানি কমাতে এবং ভোটকে অংশগ্রহণমূলক করতে ইচ্ছেমতো আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে দলীয় প্রতীক তুলে দেয়। নিজেরা আইন করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নাজিল করলেও ফের নিজেদের সুবিধার্থে সেটি মানেনি। তারপরও জমজমাট হয়নি এই নির্বাচন। ভোটার উপস্থিতিতে কমের দিকে রেকর্ড করেছে। প্রার্থী দিতে গিয়ে আত্মীয়-স্বজনের আধিক্য, এমপিদের দৌরাত্ম্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতোই এটিও আওয়ামী লীগের কপালে লাগিয়েছে কলঙ্কের তিলক। পাশাপাশি নিজ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বাধিয়েছে সংঘাত। হাইব্রিড, অনুপ্রবেশকারী, স্বজন ও টাকার কুমিরদের কাছে মাঠ ছেড়ে দেন আওয়ামী লীগের প্রকৃত নেতাকর্মীরা। এতে দুর্বল হয়েছে আওয়ামী লীগ।
লু’র সফর এবং রাজনীতিতে শঙ্কা
১৪ মে তিন দিনের জন্য ঢাকা সফর করেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। এই কর্মকর্তার দফায় দফায় সফর নিয়ে আওয়ামী রাজনৈতিক শিবিরে ভয় ও বিরোধীদের মধ্যে আশার সঞ্চার করে। আলোচনায় উঠে আসে লু যেখানে গেছেন, সরকার পতন করে দিয়ে আসছেন। বাংলাদেশেও তাই হবে। এ নিয়ে জাগো নিউজের সংবাদেও ছিল শঙ্কা। সেই সফর নিয়ে লু বলেছিলেন, ‘দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে নতুন করে আস্থা গড়ে তুলতে আমার এ সফর। গত বছর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অনেক উত্তেজনা ছিল। এখানে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আমরা কঠোর পরিশ্রম করেছি। এখন আমরা নতুন একটি অধ্যায় প্রত্যাশা করছি।’ লু’র এই নতুন অধ্যায় যে পতনের মধ্য দিয়ে হবে কে জানতো!
ভারত-চীন সফরে নেতিবাচক প্রভাব
জুনের শুরুতে যথারীতি বাজেট প্রস্তাব করেও তোপের মুখে পড়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। বিরোধীদের পাশাপাশি সরকারের শরিক ১৪ দলীয় জোটও ওই বাজেটে অসন্তোষ প্রকাশ করে। জোটের শীর্ষ নেতারা বলেছিলেন, ‘এই বাজেট দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট সমাধানের পরিবর্তে জিইয়ে রাখবে। মানুষের মধ্যে স্বস্তি আসবে না।’
এরই মধ্যে ৯ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর জুনের ২১-২২ তারিখে ফের পূর্ব নির্ধারিত দ্বিপাক্ষিক সফর করেন শেখ হাসিনা। সেই সফরে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে তেমন ফলপসূ আলোচনা হয়নি। সেখান থেকে মূলত সংকটের শুরু। এরপর ৮ জুলাই থেকে ৯ জুলাই চীন সফর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আলোচনা আছে, সে সফরে প্রত্যাশিত ফল পাননি বলে একরকম মেজাজ খারাপ করেই দেশে ফিরেন তিনি। দেশে অব্যাহত নানা সংকট, সঙ্গে বিদেশি চাপ। এসব নিয়ে বেশ বেকায়দায় ছিল সরকার। পরে সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে মেজাজ হারান শেখ হাসিনা। পতনের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয় সে থেকেই।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও পটপরিবর্তনের ইতিহাস
যখন একের পর এক ঘটনা প্রবাহে চাপে পড়ছে সরকার, এরই মধ্যে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেদিন থেকে চার দফা দাবিতে লাগাতার কর্মসূচি দেয় সংগঠনটি। ২ থেকে ৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। ৭ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাকায় গণপরিবহন বন্ধ এবং রাস্তা অবরোধ কর্মসূচি চালায়। পরে সারাদেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি নামে অবরোধ কর্মসূচি দেয়। এরপর থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন স্পটে তাদের কর্মসূচি ছিল। এসব কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে তারা পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আক্রমণের শিকার হন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৪ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ঢাকায় গণপদযাত্রা করে বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বরাবর স্মারকলিপি দেয়। সেদিনও দফায় দফায় বাধা দেয় পুলিশ।
এদিন শেখ হাসিনার চীন সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনের বিষয়টি অবতারণা করলে ‘গরম মেজাজে’ নেতিবাচক উত্তর দিয়ে আগুনে ঘি ঢালেন। সরকারি চাকরি প্রাপ্তি নিয়ে সাংবাদিক প্রভাষ আমিনের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? তাদের নাতিপুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে? এটা আমার দেশবাসীর কাছে প্রশ্ন।’
এই এক বক্তব্য আন্দোলনে ফুঁসে উঠে পুরো দেশের ছাত্র সমাজ। সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হলে হলে স্লোগান তোলে- ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার।’
হল থেকে ক্যাম্পাস হয়ে রাজপথে নেমে আসেন ছাত্রছাত্রীরা। এরপর একের পর এক কর্মসূচি দিয়ে রাজপথ চলে যায় শিক্ষার্থীদের দখলে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার এটিকে পেশিশক্তি দিয়ে মোকাবেলা করতে গিয়ে আরও সংকট তৈরি করে।
১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এর জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত।’
ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন আন্দোলনকারীদের শেষ দেখে ছাড়বেন বলেও জানান। ওই দিনই ছাত্রলীগ হামলে পড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর। বিভিন্ন জায়গায় হামলা করে রক্তাক্ত করে। পরদিন (১৬ জুলাই) সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অপারেশনের নামে শিক্ষার্থীদের ওপর হিংস্র পশুর মতো পূর্ণ শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে পুলিশ। রংপুরে পুলিশের গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ শহীদ হন। চট্টগ্রামে ছাত্রদল ও শিবির নেতাকর্মীসহ তিনজনসহ সারাদেশে ছয়জন নিহত হয়।
১৭ জুলাই গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি দেওয়া হয়। সেদিনও শিক্ষার্থীদের ওপর নগ্ন হামলা চালায় পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। অস্ত্রের মুখে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন দমাতে পারলেও পরে নেমে পড়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানুষ হত্যায় মেতে ওঠে। তাদের হেলিকপ্টার থেকেও গুলি ছোড়া হয়। ঘরের ভেতরে মায়ের কোলের শিশু সন্তান, ছাদে খেলতে থাকা কিশোর কেউ রেহাই পায়নি তাদের মারণঘাতী গুলি থেকে। এসব ঘটনায় দেশবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। আন্দোলনে সংযুক্ত হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ।
গণ-আন্দোলনের অবস্থা টের পেয়ে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলে শিক্ষার্থীরা আরও ক্ষুব্ধ হন। সরকারপ্রধানের কথায় নমনীয়তা না থাকলেও চেহারা ও পোশাক ছিল বিধ্বস্ত। যার কারণে আন্দোলন আরও বেগবান হয়। সরকারও পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি দিয়ে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে আন্দোলন দমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে গণহত্যা চালিয়েও দমাতে পারেনি।
দম্ভের অবসান
‘শেখ হাসিনা পালায় না’, ‘আমি পালাবো না’ নানা সময়ে এমন দম্ভোক্তি করলেও গণ-আন্দোলনের মুখে বাধ্য হয়ে ৫ আগস্ট দেশ ত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ নেতারাও যে যার মতো পালিয়ে যান বা আত্মগোপনে চলে যান। বেশ কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতারও হন।
এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আওয়ামী লীগ আজ আন্ডারগ্রাউন্ডে। দুই-একজন নেতার হদিস পাওয়া গেলেও তারা কথা বলতে চান না। কেউ বললেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন। গেল ছয়মাসে দলটির আনুষ্ঠানিক কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। এরমধ্যে নানা কারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে।
ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা নেতাদের
আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সুসংগঠিত ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল। এই দলের নেতাকর্মীরা হীরার টুকরার মতো, এটা কাটলে আরও উজ্জ্বল হয়। এখন হয়ত প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারছে না বা করতে দেওয়া হচ্ছে না। ৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পরেও আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হয়েছে। এরশাদ শাসনামলে, ওয়ান ইলেভেনসহ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের ২৩ বছরের বাইরে বিগত ৩০ বছরের সরকারে যারা ছিল, সবার চেষ্টা ছিল আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার। কিন্তু সম্ভব হয়নি। এবারও সম্ভব হবে না।
নিজেদের ভুল স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘ভুল, ব্যর্থতা বা অন্যায় তো ছিলই। এটা তো স্বীকার করতে হবে। তবে সফলতাও ছিল। দোষেগুণে মানুষ। এখন দেখার বিষয়, দোষটা বেশি না গুণ? নানা সফলতা তো এখন ম্লান হয়ে গেছে। এক ভুল দিয়ে তো সব বিচার করা যাবে না। তবে ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে।’তবে তিনি মনে করেন, ‘স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ বেশ কিছু ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হওয়া দরকার। আমি যা করেছি, তুমিও তাই করলে তো সেই একই হলো। পরিবর্তনে তো লাভ হলো না।’