Image description

ঔপনিবেশিক আমলে পুলিশ আইন তৈরি করা হয়েছিল জনগণকে দমন-পীড়নের জন্য। আইনটির পদে পদে সমস্যা রয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সবকিছুতে পরিবর্তন আনলেও রাজনীতিকরা ব্রিটিশ আমলে প্রণীত দমন-পীড়নমূলক আইনটি পরিবর্তন করেনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও রাজনীতিকরা কোনো সংস্কার করেননি। ফলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি পুলিশ। এর খেসারত জনগণকে এখনও দিতে হচ্ছে। জনগণ বাংলাদেশ পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও জনতার পুলিশ হিসেবে দেখতে চায়। কিন্তু এই বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে রাখতে করতে রাজনীতিকদের সদিচ্ছার বড় অভাব রয়েছে। এখন পুলিশ সংস্কার করতে হলে তাদের সদিচ্ছাই সবচেয়ে বেশি জরুরি।

 

পুলিশ সপ্তাহ ২০২৫-এর শেষ দিনে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে বাংলাদেশ পুলিশ অডিটরিয়ামে ‘নাগরিক ভাবনায় জনতার পুলিশ : নিরাপত্তা ও আস্থার বন্ধন’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের বক্তব্যে এমন মতামত উঠে এসেছে। অনুষ্ঠানে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, শিক্ষক, সাংবাদিক, ধর্মীয় নেতা, লেখক, খেলোয়াড়, সংগীতশিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, অর্থনীতিবিদ, সাহিত্যিক, শ্রমিকনেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকরা উপস্থিত ছিলেন। পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে সব রেঞ্জ ডিআইজি, মহানগর পুলিশের কমিশনার ও পুলিশ সুপাররা উপস্থিত ছিলেন।

মতবিনিময় সভায় বক্তারা বলেন, জনগণ সব সময় প্রভাবমুক্ত ও পেশাদার পুলিশ চেয়ে আসছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে রাজনৈতিক নেতারা সেটা চাননি। ফলে জনগণকে দমন করার মানসিকতা থেকে পুলিশ বের হতে পারেনি। এ সংস্কৃতি বদলাতে হবে, পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমূক্ত করতে সংস্কারের এখনই উপযুক্ত সময়। এ জন্য স্বতন্ত্র পুলিশ কমিশন গঠন করা জরুরি। বক্তারা আরও বলেন, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের পর পুলিশ সংস্কারে কমিশন গঠিত হয়; কিন্তু এর প্রতিবেদনে প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই উঠে আসেনি। সভায় একাধিক বক্তা পুলিশ সংস্কার

কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে সমালোচনা করেন। তারা জনবান্ধব পুলিশ গড়তে মতামত তুলে ধরেন।

তিন দিনব্যাপী পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানের শেষদিনে নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের আগে সকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন পুলিশ কর্মকর্তারা। সর্বশেষ বিকালে আইজিপির সঙ্গে মাঠপর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সুপার থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের মতবিনিময় সভা হয়। নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে পুলিশের সাবেক দুজন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা ও আবদুল কাইয়ুম বক্তব্য দেন। সভার মুখ্য আলোচক ছিলেন লেখক ও চিন্তক সলিমুল্লাহ খান। পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম সভাপতিত্ব করেন। নিউ এইজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীর, ব্যবসায়ী সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্ট্যাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সাজ্জাদ সিদ্দিকী, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য অধ্যাপক চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য জাহেদ উর রহমান মতবিনিময় সভায় কথা বলেন। সমাপনী বক্তব্য দেন মতবিনিময় সভা-সংক্রান্ত উপকমিটির সভাপতি ও পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত আইজি গোলাম রসুল।

সভায় সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশ যখন স্বাধীন হলো তখন কিন্তু রাজনীতিবিদরা আর সব কিছুই পরিবর্তন করলেন, পেনাল কোড সিআরপিসি পরিবর্তন করলেন না, অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট পরিবর্তন করলেন না, যেগুলো যুগের দাবি ছিল। রাজনৈতিক এই সদিচ্ছা ১৯৭১ সালের পরেও দেখা যায়নি। বর্তমান পুলিশ সংস্কার কমিশন সম্পর্কে তিনি বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে যে সমস্ত কথা বলা আছে, সরি টু সে, যে কাজটি করেছেন, সেটা আমি সাত দিনে করে দিতে পারতাম।

কমিশনের সুপারিশের সমালোচনা করে নূরুল হুদা বলেন, আবার কমিশন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলছে। যখন নিরীক্ষার কথা ওঠে তখন ভয় হয়। সবই যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষাই দরকার, তা হলে এই কমিশনের দরকার ছিল কী? কমিশন ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের কথা কিছুই বলেনি। কিছু আইন ১৯৬১ সালে দরকার ছিল, সেটা এখন প্রয়োজন নেই।

মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, এখন অফিসারদের ভালো পরামর্শ দিতে গিয়ে জানা গেল তিন-চার বছর চাকরি করলেই বাড়ি বানিয়ে ফেলতে পারে। এই যে অবস্থা, এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের। হিউজ দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতি এখনও যে হচ্ছে না এর গ্যারান্টি নাই। আমি খোলাখুলি বলতে চাই না, জানা যায়। এটা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে।

মতবিনিময় অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচক ছিলেন লেখক ও গবেষক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। তিনি বলেন, পুলিশকে জনগণের বিপক্ষে দাঁড় করানো যাবে না। পৃথিবীতে যত রাষ্ট্র আছে সেখানে পুলিশ আছে। পুলিশ সমাজেরই অংশ। আমাদের দেশে পুলিশের জনপ্রিয়তায় যে ভাটা পড়েছে তা উদারচিত্তে আলোচনা হওয়া উচিত। পুলিশের সঙ্গে জনগণের দূরত্বের গোড়ায় যেতে হবে।

বিচারব্যবস্থার কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরে সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘আমাদের যে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা, সেখানে কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করলে সেটা আদালতের হাতে চলে যায়। প্রায়ই আমরা পুলিশের থেকে শুনেছি, আমাদের দেশের ফৌজদারি ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করা যায় না। আদালত জামিন দিয়ে দেন, অপরাধী মুক্ত হয়ে যায়। কোনো ক্ষেত্রে নিরপরাধ শাস্তি পায়, অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়।’ তিনি আরও বলেন, সুপ্রিমকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন, বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা যাবে না। কিন্তু সুপ্রিমকোর্টের সিদ্ধান্ত থাকা সত্ত্বেও এটা বাস্তবে প্রয়োগ হয় না।

নূরুল কবীর বলেন, রাষ্ট্র যখন নিপীড়ক হয়ে ওঠে, তখন পুলিশকে জনতার পুলিশ হতে দেয় না। পুলিশকে জনতার পুলিশ হতে হলে কতগুলো বিষয় মাথায় রাখতে হবে। ন্যায় বা অন্যায় দেখার মতো বুদ্ধিমত্তা থাকতে হবে।

পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করার পরামর্শ দেন ব্যবসায়ী সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর।

সাবেক আইজিপি আবদুল কাইয়ুম বলেন, আমরা সবাই স্বাধীন হতে চাই। কিন্তু স্বাধীনতা ভালো লাগে না। অনেকে গোলামি করতে চায়। এ দ্বিচারিতার অবসান হওয়া উচিত। পদোন্নতি-পদায়নের জন্য মন্ত্রীদের বাসায় গিয়ে গোলামি করতে চায়। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুলিশের ‘অপব্যবহার’ বন্ধ করার পাশাপাশি স্বাধীনভাবে কাজ করার মাধ্যমে পুলিশের ভাবমূর্তি বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন অধ্যাপক সাজ্জাদ সিদ্দিকী। তিনি বলেন, পুলিশ সংস্কারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবচেয়ে বেশি জরুরি। আমরা পুলিশকে সেবক হয়ে উঠতে দিচ্ছি কিনা, তা চিন্তা করতে হবে।

নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য জাহেদ উর রহমান বলেন, এর আগে পুলিশ সপ্তাহগুলোতে দেখা গেছে, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিলের দাবি উঠত। ওই আইনে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি মানসিক নির্যাতনের কথাও উল্লেখ রয়েছে। অথচ পুলিশই এই আইন বাতিল চেয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সেটা করতে না পেরে এই আইনের প্রয়োগে কিছু শর্ত যুক্ত করার কথাও বলেছিল পুলিশ।

অধ্যাপক চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস বলেন, পুলিশ যদি সত্যের পথে থাকে, তা হলে নতুন বাংলাদেশে তাদের আস্থার জায়গা হবে। পুলিশকে অসহায় মানুষের মাঝে দাঁড়াতে হবে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুলিশের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পুলিশ যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তা হলে পুলিশের ভাবমূর্তি বাড়বে।

আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, পুলিশের প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি তখনই ইতিবাচক হয়, যখন তারা দেখে এই বাহিনী কেবল আইন প্রয়োগ করছে না, বরং জনগণের অধিকার রক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ বজায় রাখার দায়িত্বও গ্রহণ করছে। জনতার পুলিশ মানে শুধু একটি পরিচয় নয়- এটি একটি দর্শন, যা নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে জনমনে আস্থা, শ্রদ্ধা ও সম্মান গড়ে তোলে। তিনি বলেন, ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে- অস্ত্র নয়, জনগণের আস্থা অর্জনই পুলিশের প্রকৃত শক্তি। তাই পুলিশকে ‘ভয়ের প্রতীক’ নয়, বরং হয়ে উঠতে হবে ‘ভরসার আশ্রয়’।

সমাপনী বক্তব্যে অতিরিক্ত আইজিপি গোলাম রসুল বলেন, আমরা জনতার মুখোমুখি থাকব না, পাশাপাশি থাকব। আমরা সাধারণ মানুষের কাছে যেতে চাই; জনগণের পুলিশ, সাধারণ মানুষের পুলিশ হতে চাই।

নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় দর্শক সারিতে আরও ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী, গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরায়েজী, কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর, পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য (শিক্ষার্থী প্রতিনিধি) মো. জারিফ রহমান, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার আশফাক নিপুন, সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মানজুর আল মতিন, গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার প্রমুখ।