রাজনীতিতে এখন পাল্টাপাল্টি সমাবেশ চলছে। রাজপথে শক্তি প্রদর্শনের মহড়া চলছে, যা নজরে এসেছে বাংলাদেশে সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধি দলের। তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ নিয়ে জানতে চেয়েছে, অহিংস সমাবেশ নির্বাচনের আগে সহিংসতায় রূপ নেবে কি না? সেই আশঙ্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য জেনেছে। জবাবে রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেছেন, ভোটের আগে সহিংস হওয়ার নজির দেশের ইতিহাসে আছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সফরে আসা ইইউর প্রাক-নির্বাচনি অনুসন্ধানী দলের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতারা এ তথ্য জানান। ইইউর প্রতিনিধি দল শনিবার দিনভর নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে।
এদিন দুপুরে ঢাকার শেরাটন হোটেলে ইইউর প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দেড় ঘণ্টা বৈঠক করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বৈঠকে ইইউর পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন রিকার্ডো শেলেরি। প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বৈঠকে অংশ নেন দলের কার্যনির্বাহী সদস্য তারানা হালিম। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, আমরা সবাই আলাদাভাবে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছি। পরে একটি লিখিত বক্তব্য ইইউর প্রতিনিধি দলের কাছে দেওয়া হয়েছে। তারা জানতে চেয়েছে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে কি। জবাবে সংঘাত প্রসঙ্গে আমরা বলেছি, ভোটের আগে কিংবা পরে আওয়ামী লীগের অতীত ইতিহাসে ভায়োলেন্স নেই। সহিংসতা বিএনপি করেছে।
বিএনপির এক দফা নিয়ে কী মনে করে আওয়ামী লীগ? জবাবে আমরা বলেছি, তাদের দফাই ঠিক নেই। তাদের দফা পরিবর্তন হচ্ছে দফায় দফায়। তারানা হালিম বলেন, আমরা বলেছি, নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আলাদা হয়েছে। কয়েকটি উপনির্বাচনে আমরা পরাজিত হয়েছি। একটি উপনির্বাচন গোলযোগের কারণে বাতিল হয়েছে। এগুলো সুষ্ঠু নির্বাচনের নমুনা। তিনি জানান, বৈঠকে দলের সভাপতিম-লীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান সংবিধান নিয়ে কথা বলেছেন। জিয়াউর রহমানের সময় মার্শাল ল নিয়ে কথা বলেছেন প্রতিনিধি দলের সদস্য ও আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত। বক্তব্যে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে বিধি মেনে নিজের নির্বাচনি প্রচারণার প্রসঙ্গও টানেন।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া। আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ একটি জায়গা থেকে তথ্য না দিয়ে এবং তথ্য নিজেরা অধিক যাচাই করে বাংলাদেশ ইস্যুতে বিবৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ইইউকে।
এদিকে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ইইউ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সোয়া এক ঘণ্টার বৈঠকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে অংশ নেন দলটির পাঁচ নেতা। পরে বৈঠকে অংশ নেওয়া দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ সময়ের আলোকে বলেন, তারা মূলত নির্বাচনি পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। তাদের কাজও এটা। ঘরোয়া বৈঠকের মতো আমরা খোলামেলা আলোচনা করেছি। আলাপের বড় অংশ ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যা যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বলে আসছে।
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের ফাঁকে গুলশানের একটি বাড়িতে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনা করেন ইইউ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। বৈঠকে জাতীয় পার্টির পক্ষে ছিলেন দলের চেয়ারম্যান এবং সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এবং পার্টির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মাসরুর মাওলা। পরে মাসরুর সময়ের আলোকে বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। বর্তমানে এক দফা নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির যে অনড় অবস্থান তাতে সংলাপ প্রয়োজন। সংলাপ ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়। নইলে ভায়োলেন্স হতে পারে। আলোচনার মূল উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকেই নিতে হবে। বড় দুই দল আন্দোলনের মাঠে আছে, আমাদের অবস্থান কী? সেটাও তারা জানতে চেয়েছে।
শনিবার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৈঠক হয় রাজধানীর গুলশানে সংস্থাটির নিজস্ব কার্যালয়ে। ঘণ্টাব্যাপী আলোচনায় জামায়াতের নায়েবে আমির আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের নেতৃত্বে দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাসুম, প্রচার সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবদুর রব অংশ নেন। পরে মতিউর রহমান আকন্দ সময়ের আলোকে বলেন, মূলত নির্বাচনোত্তর পরিবেশ নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। বর্তমান পরিবেশ নির্বাচনের জন্য সহায়ক কি না-জানতে চেয়েছে ইইউ। ভোটের আগে ভায়োলেন্স প্রসঙ্গে তারা জনাতে চেয়েছে। আমরা বলেছি, ভোটারদের বড় একটি অংশ ভোট দিতে না পারলে ভায়োলেন্সের শঙ্কা তো রয়েছেই। এটা অতীতেও দেখা গেছে। জবাবে ইইউ প্রতিনিধিরা কী বলেছেন? মতিউর রহমান বলেন, দেশের রাজনৈতিক অতীত ইতিহাস তারাও জানে। তারা কূটনৈতিক ভাষায় উত্তর দিয়েছেন। জামায়াতপন্থি শিক্ষক আবদুর রব সময়ের আলোকে বলেন, ইইউ দেশের গণতন্ত্র, রাজনৈতিক অবস্থা, রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা, ভবিষ্যতে কী হবে না হবে- সবকিছু নিয়েই তারা আলোচনা করেছেন।
জামায়াত বের হয়ে যাওয়ার পর শনিবার বিকাল ৪টায় গুলশানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কার্যালয়ে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিনিধি দলে ছিলেন এবি পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ ও ব্যারিস্টার যুবায়ের আহমেদ ভূইয়া, সিনিয়র সহকারী সদস্য সচিব আমিনুল ইসলাম এফসিএ এবং সহকারী সদস্য সচিব ব্যারিস্টার নাসরীন সুলতানা মিলি। বৈঠক প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ সময়ের আলোকে বলেন, তারা অনেক কিছুই জানতে চেয়েছেন। তবে মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাম্প্রতিক সমাবেশ ঘিরে প্রশ্ন করেছেন। তারা জানতে চেয়েছে, ‘এই বড় গেদারিং এখন অহিংস আছে। এটা কি ভোটের আগে সহিংস হয়ে উঠতে পারে?’ জবাবে আমরা বলেছি, আশঙ্কা সত্য হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। উভয়েরই সম্ভাবনা আছে। দেশের অতীত রাজনৈতিক অবস্থা তাই বলে। তিনি বলেন, নির্বাচনের কথা প্রসঙ্গে আমরা ফুটবল খেলার উদাহরণ টেনেছি। তাদের বলেছি, ‘ধরেন আপনি টিকিট কেটে খেলা দেখতে গেলেন। ফুটবল মাঠে গিয়ে দেখলেন এক টিম আসেনি। তখন খেলা কি উপভোগ্য হবে। ঠিক তেমনি নির্বাচনে সবাই অংশগ্রহণ না করলে মাঠ ফাঁকা হয়ে যাবে।’
ইইউ প্রতিনিধি দল সবকিছু শুনেছে। তারা নোট নিয়েছে। সবশেষ তারা রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে। এ বিষয়ে সরকার সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার বিধায় আমরা বলেছি, সরকারকে আগে উদ্যোগী হতে হবে।
নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে দুই সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশ সফরে এসেছে ইইউর প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলটি। বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে তারা। এরপর ইইউর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেলের কাছে তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদন জমা দেবে বিশেষজ্ঞ দলটি। তাদের মতামত ইতিবাচক হলে পরবর্তী সময়ে আরও প্রতিনিধি দল পাঠাবে ইইউ। আর সবকিছু ঠিক থাকলে অর্থাৎ প্রতিনিধি দলের মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানো হবে কি না, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন ইইউ প্রধান।
সময়ের আলো/আরএস