
ভারতের অসহযোগিতার কারণে কলকাতায় খুন হওয়া আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যা মামলার তদন্ত থমকে আছে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর কলকাতার সিআইডি ঢাকার ডিবি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ডিবি পুলিশের পক্ষ থেকে বার বার যোগাযোগ করা হলেও তাদের কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। মামলার অগ্রগতির বিষয়ে কিছু জানায়নি কলকাতার সিআইডি। অথচ ৫ আগস্টের আগে এ মামলায় গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের কারণে ওই খুনের মাস্টার মাইন্ডদের নাম বের হতে শুরু করেছিল। আনার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি সাইদুল করিম মিন্টুসহ আরো একাধিক রাঘববোয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এই হত্যাকাণ্ডের আদ্যপান্ত বের হয়ে আসে।
২০২৪ সালের ১৩ মে কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে খুন হন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম। ওই হত্যাকাণ্ডের পর অন্য আসামিদের পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে আ.লীগ নেতা সাইদুল করিম মিন্টুর নাম উঠে আসে। ডিবি পুলিশ তাকে ধানমন্ডি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। তাকে দুদিন ডিবি কার্যালয়ে রাখা হয়েছিল। দুদিন ধরে তাকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। তাকে ছাড়ানোর জন্য তদ্বির করেছিলেন স্বয়ং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর এসাইনমেন্ট অফিসার সনজিত চন্দ্র দাস। আনার হত্যাকাণ্ডে ডিবি পুলিশের চোখে অন্যতম মাস্টারমাইন্ড ছিলেন জেপির সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সাবেক এপিএস ও পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার সাবেক এমপি মহারাজ। কিন্তু ডিবি পুলিশ অদৃশ্য শক্তির ইশারায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ ও আটক করতে পারেনি। ডিবির একটি সূত্র জানিয়েছে, তাকে আনার হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে এবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ২০২৪ সালের ২৬ জুন খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম থেকে ফয়সাল ও মোস্তাফিজকে গ্রেপ্তারের দাবি করে ডিবি। ওই গ্রেপ্তার অভিযানে তৎকালীন ডিবি প্রধান হারুন হেলিকপ্টার ব্যবহার করেন। যেটা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা তৈরি হয়। ডিবির একটি সূত্র জানিয়েছিল দুজনকে বাগেরহাট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
আনার হত্যাকাণ্ডের পর ডিবির ৩ সদস্যের একটি টিম কলকাতায় যায়। তারা সেখানে কলকাতার পুলিশ ও সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন। এই তিন কর্মকর্তার আবার কলকাতায় যাওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর তাদের আর কলকাতায় যাওয়া হয়নি। তবে বর্তমান ডিবি পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন। খুব শিগগিরই আনার হত্যার তদন্ত শুরু হবে। সূত্র জানায়, আনার হত্যায় যারা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন প্রয়োজনে পুলিশ তাদের আবার রিমান্ডে আনবে। এদিকে নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা কলকাতায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন।
২০২৪ সালের ১৩ মে আনোয়ারুল আজীম খুন হওয়ার পর ২২ মে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বাদী হয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। পরে পুলিশ এ মামলায় গ্রেপ্তার করেন শিলাস্তি, আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া ও তানভীর ভূঁইয়া ওরফে ফয়সাল সাজিকে। পরে আদালত শিলাস্তিসহ মোট তিনজনের আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। প্রথম দফায় রিমান্ডে কিছু তথ্যের ঘাটতি থাকার কারণে ডিবি পুলিশ ৩১ মে আসামিদের আদালতে হাজির করে আবার রিমান্ডের আবেদন করে। শিমুল ভূঁইয়া তার জবানবন্দিতে গ্যাস বাবুর কথা বলেন। গ্যাস বাবু আবার ঝিনাইদহ জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর এ খুনে জড়িত থাকার কথা তদন্ত কর্মকর্তাদের জানান।
সদ্য বিদায়ী ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল হক মল্লিক আমার দেশকে জানিয়েছিলেন, আনার হত্যার তদন্ত তারা শুরু করেছেন। আনারের ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুর রউফ জানান, আমরা দ্রুতই ডিএনএ করার জন্য কলকাতায় যাব। কলকাতা কর্তৃপক্ষ যখনই ডাকবে তখনই আমরা সেখানে যাব।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, দেশের এমপি এই প্রথম বিদেশের মাটিতে খুন হন। এতে সারাদেশে চাঞ্চল্য তৈরি হয়। প্রথমে ভিকটিমের পরিবারের পক্ষ থেকে শেরেবাংলা নগর থানায় যে অপহরণ মামলাটি করা হয় সেই মামলাটির তদন্ত শুরু করে ডিবি পুলিশ। এতে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। কলকাতায় ঘটনাস্থল দেখতে ডিবির একটি টিম যায়। সেখানে সরেজমিন ঘটনাস্থল দেখার পাশাপাশি গ্রেপ্তারকৃত আসামিদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এতে তারা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পান।
সূত্র জানায়, ডিবির পক্ষ থেকে কলকাতার পুলিশকে জানানো হয় আনারের সঙ্গে ঝিনাইদহ এলাকার রাজনৈতিক নেতাদের বিরোধ ছিল। এ খুনে স্বর্ণ চোরাচালানের বড় একটি কারণ থাকতে পারে সেই বিষয়টিও কলকাতার সিআইডিকে জানানো হয়। পাশাপাশি তাদের জানানো হয় যে, আনারের কন্যা ডরিন শেরেবাংলা নগরে অপহরণের মামলা করেছেন সেই মামলায় গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, মামলার তদন্ত শুরু করেছিল ডিবি পুলিশ। কিন্তু, ওই মামলার তদন্তে রাজনৈতিক নেতারা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। মূলত রাজনৈতিক বিরোধ ও স্বর্ণচোরাচালানকে কেন্দ্র করে আনার হত্যাকাণ্ড হয়েছিল বলে মামলার তদন্তে উঠে আসে। খুনের সঙ্গে অনেক রথি-মহারথিরা জড়িত ছিল। তারা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ডিবি পুলিশ অনেককেই সন্দেহ করলেও রাজনৈতিক প্রভাব থাকার কারণে জিজ্ঞাসাবাদ, আটক বা গ্রেপ্তার করতে পারেনি। ডিবিতে মোটা অংকের টাকার লেনদেন হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর এবার নির্মোহ তদন্ত করবে বলে জানিয়েছে ডিবি। ডিবি জানিয়েছে, মামলার প্রয়োজনে ওই হত্যাকাণ্ডের আসামিদের আবার রিমান্ডে আনা হতে পারে। তবে যারা আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না।