
রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব বিস্তারকারী আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা সরকার পতনের পর নানা সংকটে পড়েছেন। ক্ষমতা হারিয়ে দেশের বাইরে পাড়ি জমানোর পর তারা এখন নিজ নিজ ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে অংশীদার খুঁজছেন। এসব প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের এমপি, মন্ত্রী, আমলাসহ ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারাও।
নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবারের বাণিজ্যিক সমীকরণ
শিল্পাঞ্চল নারায়ণগঞ্জে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে ওসমান পরিবারের একচ্ছত্র প্রভাব ছিল।
আগে থেকেই শামীম ওসমানসহ এ পরিবারের সদস্যদের বেনামি অংশীদারত্ব ছিল দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যবসায়ী গ্রুপে।
বিপাকে গোলাম দস্তগীর গাজী
একই জেলার প্রভাবশালী নেতা গোলাম দস্তগীর গাজী বর্তমানে কারাগারে। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক এই মন্ত্রীর গাজী টায়ারসহ বেশ কিছু কারখানা অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এখনো বন্ধ। পরিবার সূত্র বলছে, এসব কারখানা সচল করতে তারা অংশীদার খুঁজছেন, তবে স্থানীয় বিএনপির দুটি গ্রুপের দ্বন্দ্ব এ বিষয়ে জটিলতা তৈরি করছে।
অংশীদার খুঁজছেন আবু জাফর মো. শফিউদ্দিন
কুমিল্লা-৮ আসনের সংসদ সদস্য ও এসবিএসি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবু জাফর মো. শফিউদ্দিনও দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। এসকিউ গ্রুপের এ কর্ণধার চতুর্থ প্রজন্মের সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের (এসবিএসি) চেয়ারম্যান ছিলেন।
গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া এ ব্যবসায়ী এখন অংশীদার খুঁজছেন। ইতিমধ্যে বিএনপিপন্থী এক ব্যবসায়ীকে তার ব্যবসায় যুক্ত করেছেন এবং এসবিএসি ব্যাংকে থাকা নিজের তিনটি পরিচালক পদের একটির শেয়ার ওই ব্যবসায়ীর নামে হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া চলছে।
শাহরিয়ার আলম ও রেনেসাঁ গ্রুপ
প্রাক্তন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সরকার পতনের আগেই ভারত হয়ে থাইল্যান্ড, পরে রাশিয়ায় পাড়ি জমান। তার মালিকানাধীন রেনেসাঁ গ্রুপের অধীনে বস্ত্র, তৈরি পোশাক, আবাসন, হাসপাতালসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসা রয়েছে। দেশের বাইরে রাশিয়ায়ও শাহরিয়ারের ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। এসব ব্যবসা বর্তমানে বিপর্যস্ত। ব্যাংক ঋণ খেলাপি হওয়ার পথে।
রেনেসাঁ গ্রুপের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, তিনি বিদেশ থেকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। এখানে তার বাবা শামসুদ্দিন ব্যবসা দেখাশোনা করছেন। বিএনপি রাজশাহী অঞ্চলের একাধিক নেতার সঙ্গে ব্যবসার অংশীদার হওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে।
সালমান এফ রহমান ও বেক্সিমকোর পতন
দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ নেয়া আলোচিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের সম্পদ দেখানো হয়েছিল ৩৯৪ কোটি টাকা। বেক্সিমকো গ্রুপের এ ভাইস চেয়ারম্যান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সাবেক সভাপতিও। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর গত বছরের আগস্টে সালমান এফ রহমান গ্রেপ্তার হন। এরপর থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন। এরই মধ্যে ঋণের ভারে জর্জরিত বেক্সিমকো গ্রুপের এক ডজনের বেশি কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ
আওয়ামী লীগের পলাতক ধনকুবেরদের মধ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদও রয়েছেন। তিনি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) সাবেক চেয়ারম্যান। ২০২৩ সালে জাতীয় সংসদে এ আওয়ামী লীগ নেতা ঘোষণা দেন বিদেশে তার ২ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ সম্পদ আছে। যদিও আয়কর রিটার্নে তিনি বিদেশে থাকা কোনো সম্পদের উল্লেখ করেননি। গত এক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদে বলা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ ও তার আত্মীয়-স্বজনের মালিকানায় অন্তত ২৯৫ মিলিয়ন ডলারের ৪৮২টি সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে ৩১৫টি, দুবাইয়ে ১৪২, নিউইয়র্কে ১৬, ফ্লোরিডায় ছয় এবং নিউজার্সিতে তিনটি সম্পত্তি আছে।
পলাতক এ আওয়ামী লীগ নেতা বর্তমানে যুক্তরাজ্যে রয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। সেখান থেকেই তিনি দেশে তার পারিবারিক প্রতিষ্ঠান আরমিট গ্রুপের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য বাঁচানোর জন্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদও অংশীদার খুঁজছেন বলে জানা গেছে।
হাছান মাহমুদ
ব্যবসায়িক অংশীদার খুঁজছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদও। নিজে সরাসরি সামনে না এলেও স্ত্রী নুরান ফাতেমা ও দুই ভাই খালেদ মাহমুদ ও এরশাদ মাহমুদের মাধ্যমে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। সর্বশেষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরের লাইসেন্স পান তার স্ত্রী। এছাড়া একাধিক ফিশিং ট্রলারেরও মালিকানা রয়েছে পরিবারটির। সম্প্রতি হাছান মাহমুদের পরিবারের দখলে থাকা বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ২০০ একরের বেশি জমি উদ্ধার করা হয়েছে। তবে সরকারের সঙ্গে থাকা এ পরিবারের ব্যবসাগুলো চলমান রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। ব্যবসার ক্ষেত্রে পলাতক এ আওয়ামী লীগ নেতাকে স্থানীয় বিএনপির নেতারা সহযোগিতা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
তাজুল ইসলাম
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। তিনি রফতানিমুখী পোশাক শিল্প, ব্যাংকসহ বিভিন্ন শিল্প উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পোশাক খাতে ফেবিয়ান গ্রুপ নামে কলকারখানা রয়েছে তার। সরকার পরিবর্তনের পর তিনি পলাতক থাকলেও তার কলকারখানা চালু রয়েছে। সন্তানরা ব্যবসা পরিচালনা করলেও তিনি এখন অংশীদার খুঁজছেন বলে জানা গেছে।
মাহবুব-উল আলম হানিফ
ব্যবসায়িক অংশীদার খুঁজছেন বহুল আলোচিত পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব-উল আলম হানিফও। তার মালিকানাধীন কোয়েস্ট গ্রুপের অধীনে ঠিকাদারি, ড্রেজিং, ট্রাভেল এজেন্সি, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, রিসোর্ট, আবাসন, মাছের ঘেরসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা রয়েছে।
নসরুল হামিদ বিপু
শেখ হাসিনা সরকারের পলাতক ব্যবসায়ী মন্ত্রীদের একজন নসরুল হামিদ বিপু। দীর্ঘদিন তিনি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। বিদ্যুৎ, জ্বালানি, আবাসনসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা রয়েছে তার। হামিদ গ্রুপের এ কর্ণধারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরে হাজার কোটি টাকার বেশি পাচারের অভিযোগ তুলেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটি বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি কোম্পানি খুলে নসরুল হামিদ বিপু হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। ওই কোম্পানি প্রতিষ্ঠাকালে বিপু তার নিজের যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থিত বাসভবনের ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি হিসেবে সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশে নিবন্ধিত। এ কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নসরুল হামিদ বিপুর আত্মীয়-স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনদের হাতে। পলাতক অবস্থা থেকেই দেশে থাকা বিভিন্ন সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছেন নসরুল হামিদ। যেসব সম্পদ বিক্রি করা যাচ্ছে না, সেগুলো পরিচালনার জন্য তিনি অংশীদার খুঁজছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
আ হ ম মুস্তফা কামাল
শেখ হাসিনা সরকার পতনের আগেই দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের একজন সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। জনশক্তি রফতানি, আবাসন, শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা রয়েছে তার। নিজের ব্যবসা ধরে রাখতে তিনিও বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে এরই মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছেন বলে জানা গেছে।
এছাড়া শতকোটি টাকার বেশি সম্পদশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে রয়েছেন চুয়াডাঙ্গার আওয়ামী লীগ নেতা দিলীপ কুমার আগরওয়ালা। জুয়েলার্স প্রতিষ্ঠান ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদকও। এছাড়া ঢাকার আওয়ামী লীগ নেতা মো. খসরু চৌধুরীর সম্পদও শতকোটি টাকার বেশি। তিনি নিপা গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক। হলফনামায় শতকোটি টাকার বেশি সম্পদ দেখিয়েছিলেন ফেনী-১ আসন থেকে নির্বাচন করা আওয়ামী লীগ নেতা আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম ও ফেনী-২ আসন থেকে নির্বাচিত নিজাম উদ্দিন হাজারীও। পলাতক আওয়ামী নেতা আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০০৯ সালের শুরুতে সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। এরপর থেকে গত দেড় দশকের বেশি সময়জুড়ে রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যও আবর্তিত হয়েছে ক্ষমতাসীন দলকে ঘিরে। ব্যবসার ক্ষেত্রে একচেটিয়া কর্তৃত্ব ও অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদ গড়ে তুলেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতারা। নেতাকর্মীরা ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার পাশাপাশি পেশাদার ব্যবসায়ীদেরও নিজেদের দলে টেনে নেন শেখ হাসিনা।
এছাড়া গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারাও বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তুলেছেন। তবে সরকার পতনের পর যেসব ব্যবসায়ী জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত তাদের শিল্প-কারখানা ঠিকমতো চলছে না। এ পরিস্থিতিতে অংশীদার ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাই কেউ কেউ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে থাকা বিএনপির নেতাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। অন্যরা সম্পদ বিক্রি করে বিদেশে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন।
তবে রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আওয়ামী লীগের কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর বিভিন্ন তথ্য দিলেও নিজেদের নাম উদ্ধৃত করে কেউই বক্তব্য দিতে চাননি। এছাড়া ব্যবসায়িক অংশীদার খুঁজে বেড়ানো পলাতক অনেক নেতাদের দেশে ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরগুলো বন্ধ থাকায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।