Image description

ঐকমত্য কমিশনে অভিমত জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান কী হবে তা তৈরি করেছে দলটি। কমিশনে অভিমত জমা দেওয়ার পাশাপাশি সংস্কারের ব্যাপারে তাদের প্রস্তাব কী হবে তা সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশ করবে বিএনপি। জানা গেছে, সরকারের কিছু বিভাগে সংস্কার চাইলেও সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনে বিএনপি একমত নয়। এতে নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে বলে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা সংশয়ান্বিত।

 

বিএনপি বলছে, সংবিধান সংস্কারের এখতিয়ার নির্বাচিত সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। সংসদই সংবিধানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনবে। দলটি নির্বাচনের জন্য প্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের সংস্কারের প্রস্তাবে একমত হলেও সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন পছন্দ করবে না।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ৬ মার্চ ৩৭টি রাজনৈতিক দলকে একটি স্প্রেডশিট পাঠিয়েছিল, তাতে ১৬৬টি সংস্কারের প্রস্তাব ছিল। জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংবিধান ও নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের বিষয়ে যে পাঁচটি কমিশনের সুপারিশ করেছে, সেসব সুপারিশে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত কী তা জানতে চাওয়া হয়েছে। আগামী রবিবার বিএনপি তাদের অভিমত জমা দেবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করছে। গত বৃহস্পতিবার এলডিপির সঙ্গে কমিশনের বৈঠক হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীও সে দিন তাদের অভিমত জমা দিয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বিভিন্ন দলের সঙ্গে বৈঠক শেষ করতে চায় আগামী ২৪ মার্চের মধ্যে। প্রয়োজনে সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্তও আছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, তাদের ও মিত্র দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হয়েছে। সবাই অভিন্ন মতামত জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কারের প্রস্তাব করা যায়। বিএনপির সঙ্গী চারটি দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ লেবার পার্টি ঐকমত্য কমিশনে তাদের অভিমত জানিয়েছে।

বৃহস্পতিবার ঐকমত্য কমিশনে অভিমত জমা দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সাংবাদিকদের বলেন, সংস্কার কমিশনগুলোর দেওয়া সুপারিশমালা নিয়ে দলের আমির শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে তারা দফায় দফায় আলোচনা করে লিখিত অভিমত জানিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নির্বাচন হতে হবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ চায় তারা, তবে এ ক্ষেত্রে তাদের কিছু বক্তব্য আছে।

জামায়াতে ইসলামীর অধিকাংশ প্রস্তাবের সঙ্গেই একমত নয় বিএনপি। বিএনপির অভিমতের খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দলটি সেকেন্ড রিপাবলিক বা গণপরিষদ নির্বাচনকে গ্রহণের পক্ষ নয়। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন বা প্রাদেশিক সরকারের ধারণা নিয়েও তাদের আগ্রহ নেই। বরং বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের সীমাবদ্ধতা, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের বিরুদ্ধে এবং আইনসভার মেয়াদ শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে কিছু শর্ত রাখতে চায়। বিএনপি তাদের এ অবস্থান জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে জানানোর পাশাপাশি সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেবে।

দলটি আগামী ২৩ মার্চ রবিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে তাদের সংস্কার বিষয়ক অভিমত জমা দেবে। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।

বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের দলীয় অভিমত ঐকমত্য কমিশনে জমা দেওয়ার পাশাপাশি গণমাধ্যমেও বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। আমীর খসরু জানান, ‘সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে তুলতে কমিশন যে চেষ্টা করছে, সে বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি, সব বিষয়ে ঐকমত্য হবে যেখানে, সেখানে সংস্কারও হবে। আর যেখানে ঐকমত্য হবে না সে বিষয়গুলো নিয়ে দলগুলো নির্বাচনের পরে জনগণের কাছে যাবে, পরে সংসদে আলোচনা হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফেরাতে হলে অবশ্যই জনগণের সরকার লাগবে।’

বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্র জানাচ্ছে, নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে রাষ্ট্রসংস্কারের প্রস্তাব রয়েছে তাদের। তবে, যেসব সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে, সেগুলোর প্রতি তাদের অবস্থান নেতিবাচক। বিএনপি মনে করছে, রাষ্ট্রসংস্কারের বিষয়টি নির্বাচিত সংসদের অধিকার। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদই রাষ্ট্রসংস্কারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। দলটির এমন আপত্তির মূল কারণ, সংবিধান সংশোধন ও নির্বাচনীব্যবস্থা নিয়ে যে আলোচনা চলছে তাতে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে।

বিএনপিসূত্র অনুযায়ী, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে বিএনপির আপত্তি থাকবে না, তবে সংবিধানের মৌলিক সংস্কারের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখবে দলটি। তারা মনে করে, নির্বাচনী ব্যবস্থার পুরো দলীয়করণ হয়েছে, যা ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশে বাধা সৃষ্টি করছে। তাই শুধু নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে সংবিধান ও নির্বাচনী ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার বিষয়ে তারা একমত।

জানা গেছে, বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদে একসঙ্গে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিরোধী। একইভাবে, তারা সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম বয়স কমিয়ে ২১ বছর করার প্রস্তাবের বিরোধিতা করবে। তবে, নির্বাচনকালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রসঙ্গে বিএনপি কিছুটা একমত, কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া উচিত নয়। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমাবদ্ধ করার ব্যাপারেও দলটি একমত হতে পারে, তবে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর নতুন সরকারের শপথ না নেওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব পালনের প্রস্তাব বিএনপি গ্রহণ করবে না।

দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানান, ‘দেশে বর্তমানে যে সংবিধান রয়েছে, সেটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে এবং এর মধ্যে সংশোধনী আনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পূর্ববর্তী সরকার সংবিধানকে রাজনৈতিক সুবিধার্থে ব্যবহার করেছে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার দলীয়করণ করে গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলেছে। তাই এ বিষয়ে পরিবর্তনের জন্য সংসদ লাগবে। যে সংসদ জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতাসীন হবে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ দেশ রূপান্তরকে জানান, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া স্প্রেডশিটে সবকিছু সবিস্তারে উঠে আসেনি, তাই আমরা বিস্তারিত প্রতিবেদন দেব।’