Image description

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন এসেছে, বিশেষ করে জুলাই-আগস্ট ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর। নারী, তরুণ সমাজ ও ছাত্রদের চাহিদা বদলেছে, আগের রাজনৈতিক কৌশল এখন আর কাজ করছে না। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মানুষ এখন বেশি সচেতন। যে দল এই পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে পারবে না, তারা পিছিয়ে পড়বে। বিএনপি অনেক বছর ধরে একটি জনপ্রিয় দল, যার ভিত্তি জিয়াউর রহমানের ১৭ দফা, দেশপ্রেম এবং বেগম খালেদা জিয়ার আপসহীন নেতৃত্ব। এই দলটি রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেও টিকে আছে, মূলত তরুণ  ও নারী ভোটারদের কারণে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি কি বুঝতে পারছে যে তাদের সমর্থকদের চাহিদা বদলেছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ও নারী ভোটারদের ক্ষেত্রে?

ইতিহাস বলে, রাজনৈতিক গণঅভ্যুত্থানের পর সমাজ ও অর্থনীতিতে সাধারণত বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। যদি পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে না পারে, তাহলে নতুন করে সহিংস আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে বিএনপির বড় দায়িত্ব রয়েছে—শুধু দল হিসেবে নয়, বরং জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ছাত্র ও তরুণরা হয়তো রাজনৈতিক বিষয়গুলো পুরোপুরি বোঝে না, কিন্তু তাদের পাশে দাঁড়ানো ও দিকনির্দেশনা দেওয়ার দায়িত্ব বিএনপির। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বিএনপি এখনো তাদের কৌশলগত সম্পৃক্ততা ও তরুণদের নেতৃত্ব গঠনের উদ্যোগ এখনো অপর্যাপ্ত। 

দেখা যাচ্ছে যে, অভ্যুত্থানের পর নারীদের ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বেড়েছে। উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশে আরও অস্থিরতা তৈরি করছে। এদিকে, অন্তবর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ানোর জন্য অভিযুক্ত করা হচ্ছে।  স্বৈরাচার ও পলাতক আওয়ামী লীগও এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে আরো বেশি অস্থিরতা করার চেষ্টা করছে। সাধারণত যেকোনো সামাজিক অস্থিরতার প্রথম শিকার হয় নারী ও শিশুরা। বাংলাদেশেও বর্তমানে এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী ও শিশুরা। এই অবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়: বিএনপি, যা ঐতিহাসিকভাবে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নারীদের শক্তিশালী করেছে, আজ নারী ও শিশুদের উপর বাড়তে থাকা সহিংসতা বা নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কতটা সোচ্চার? 

বিএনপি এবং তাদের ছাত্র সংগঠন, যেমন ছাত্রদল, নারীর প্রতি সহিংসতা ও অধিকার নিয়ে কর্মসূচি, প্রতিবাদ ও সংবাদ সম্মেলন করেছে, তবে এর প্রভাব কতটা কার্যকর তা স্পষ্ট নয়। সেখানে নারীদের উপস্থিতি খুবই কম। প্রচলিত ছিল যে ৯০ দশকের কোন এলাকার সবচেয়ে সুদর্শন, স্মার্ট এবং শিক্ষিত ছেলে-মেয়েরাই ছাত্রদল করত। কিন্তু ৯০ এর গণ-আন্দোলনের পরবর্তীতে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে ছাত্রদলের সেই জৌলুস হারিয়ে যায়। ঠিক একইভাবে দেখা যাচ্ছে বেগম খালেদা জিয়া — যিনি কিনা নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক— তার দলেরই নারীর উপস্থিতি দিনকে দিন কমে যাচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদলের তরুণ নারীরা সামনে না থাকলে বা নারীরা সবসময় পুরুষ ছাত্র নেতাদের পেছনে বা কোনায় দাঁড়িয়ে থাকলে বা সমভাবে একসাথে টেবিলে না বসলে, দলটি নারীদের অধিকার নিয়ে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বেও নারীদের সংখ্যা কম। অনেক নারী নেতা আজও সেই পুরোনো মুখ, যারা ১৫ বছর আগেও নেতৃত্বে ছিলেন। তাদের অভিজ্ঞতা অবশ্যই মূল্যবান, কিন্তু নতুন প্রজন্মের নারীদের জন্য কি কোনো জায়গা তৈরি করা হয়েছে? সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার বলেন, প্রতীক ও দৃশ্যমানতা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিএনপি যদি সত্যিই নতুন প্রজন্মের সঙ্গে সংযোগ চায়, তাহলে জনগণের সামনে তো  দেখাতে হবে যে, তার দলের  জেনারেশন আলফা, এক্স, জেনারেশন জেড এবং মিলেনিয়াল -এর সংমিশ্রণে নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান। বিএনপির এই নারী সংমিশ্রণ দৃশ্যমান না থাকায় দলটির অবস্থান বর্তমানে দুর্বল দেখাচ্ছে। ফলে, খুব শীঘ্রই নারীদের অধিকার নিয়ে তাদের প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।

বিএনপি তাদের ৩১ দফা প্রচারণায় দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করছে, কিন্তু সেখানেও নারীদের উপস্থিতি খুব কম । তাছাড়া সেমিনারে ও কর্মশালায় যারা ৩১ দফা নিয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তারা মূলত পুরুষ প্রশিক্ষক, কোন নারী প্রশিক্ষককে সেখানে দেখা যাচ্ছে না। তাহলে নারীদের সাথে সংযুক্ত হবে কীভাবে? বিএনপির ভেতরে তরুণ নারী নেতাদের প্রশিক্ষণ দেবার অথবা গাইড করার কেউ আছে কি? তাদের রাজনৈতিক আলোচনা, টিভি টক শো বা জনসভার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে কি? বিএনপি কি তরুণ ছাত্রীদের ও নারীদের টিভি আলোচনায় অংশ নিতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের দৃশ্যমানতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে? দুই তিনজন নারী নেতা টিভিতে অংশ নিলেও, তাদের ভূমিকা অনেক সময় গভীরতার চেয়ে লোক দেখানো মনে হয় । অনেক সময় তাদের কথাবার্তায় দাম্ভিকতা দৃশ্যমান হয়, যা জনগণকে ভুল বার্তা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে অভ্যুত্থানের পরবর্তী পরিস্থিতিতে, নিজেদেরকে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অনীহা । এরূপ টকশোতে তাদের অংশগ্রহণে বিএনপির উপকারের চেয়ে আরও বেশি ক্ষতি করছে ।

বিএনপি শুধু দলের ভেতরে নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও নারীদের বিষয়গুলোতে স্পষ্ট অবস্থান নিচ্ছে কি না, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। যখন তারেক রহমান ধর্ষণের শিকার ‘আসিয়া’ এর মা এর সঙ্গে কথা বলেছিলেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। তবে এটি আরও শক্তিশালী বার্তা দিত যদি তার স্ত্রী, ডা. জুবাইদা রহমান, এই ফোন কলটি করতেন। নারীদের অধিকার রক্ষায় কোনো শীর্ষস্থানীয় নেতার স্ত্রী সরাসরি সম্পৃক্ততা বিএনপির অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করতে পারত। ডা. জুবাইদা রহমান, যিনি মাঝে মাঝে বিএনপির বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত হন, যদি নারী অধিকার ও নির্যাতিত নারীদের পক্ষে সরাসরি কথা বলতেন, তাহলে এটি দলটির গ্রহণযোগ্যতাকে আরও বাড়িয়ে দিত। 

বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের দিক নিয়েও ভাবার সময় এসেছে। তারেক রহমানের কন্যা আন্তর্জাতিক মঞ্চে, যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। এটি কি বিএনপি ভবিষ্যতে নতুন নেতৃত্ব তৈরির ইঙ্গিত? যদি তাই হয়, তাহলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে দলটি নীরব কেন? এছাড়া বিএনপি কি তার তরুণ নেতৃত্বের গড়ে তোলার বিষয়ে যথেষ্ট উদ্যোগ নিচ্ছে? কেন তারা বাংলাদেশি তরুণ নেতাদের, বিশেষ করে ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি মতো সংগঠনের সাথে আরো গভীর ও দৃশ্যমান সম্পর্ক গড়ে তুলছে না? তারেক রহমানের কন্যা নিজেও জেনারেশন জেড-এর অংশ, তাহলে তিনি কেন সরাসরি দেশের তরুণ নেতাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করছে না অথবা কাজ করছেন না? বিএনপি সত্যিই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নেতৃত্বে আনতে চায়, তাহলে এরূপ একটি বন্ধুত্বপূর্ণ দৃশ্যমান সংযোগ – যা বিএনপির তরুণদের সাথে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করবে এবং দেখাবে যে দলটি নতুন প্রজন্মের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে। যা ভবিষ্যতে বিএনপি নারী সমর্থকদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারবে।

তবে, বিএনপির জন্য সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। কিছু মুষ্টিমেয়, সুবিধাবাদী ও গুপ্ত রাজনৈতিক দল নারী ও শিশুদের অধিকার ও তাদের প্রতি সহিংসতা নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে সতর্ক অবস্থান নিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' নীতিতে চলছে, কারণ অতিরিক্ত প্রতিবাদ করলে তাদের মতে মৌলবাদী ভোটারদের সমর্থন হারানোর আশঙ্কা থাকতে পারে। বিশেষ করে মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি এই রাজনৈতিক দলগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। কিন্তু খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে  এই বিএনপি  যার  ভবিষ্যৎ নেতৃত্বেও নারীদের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা রয়েছে – শুধু রাজনৈতিক স্বার্থেই নয় বরং দলটি নারী ও লিঙ্গ-বৈষম্য বিষয়ক ইস্যুতে সোচ্চার হতে হবে। যদি দলটি নারীদের কণ্ঠ উপেক্ষা করে, তাহলে তারা তাদের সমর্থনের বড় একটি অংশ হারানোর ঝুঁকিতে থাকবে এবং সমাজে যেখানে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার দাবি বাড়ছে, সেখানে বিএনপি পিছিয়ে পড়বে।

মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার, শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়