
সনাতন ধর্মাবলম্বী নয়ন বাছার ছিলেন ছাত্রদলের কর্মী। অথচ তাকে শিবির ট্যাগ দিয়ে পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে দেয় পুলিশ। নয়ন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার আগেই ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে যায় এ তরুণের।
২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অবরোধ কর্মসূচি। এ কর্মসূচি চলাকালে রাজধানীর পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার এলাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের কর্মী নয়ন বাছারের পায়ে গুলি করে পুলিশ। শিবির ট্যাগ দিয়ে গুলি করতে গেলে নিজেকে ছাত্রদলের কর্মী ও সনাতন ধর্মাবলম্বী বলে পরিচয় দিলেও দমানো যায় না পুলিশকে। শটগানের জোড়া গুলিতে পঙ্গু করে দেওয়া হয় নয়নকে।
সেদিন নয়নকে গুলি করেই নিস্তার দেয়নি পুলিশ। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রেখেই তাকে নাশকতার মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। পঙ্গুত্ববরণ করে বেঁচে থাকা নয়ন বাছার নতুন বাংলাদেশে চান এ ঘটনায় দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিচার। এজন্যই দারস্থ হয়েছেন আদালতের।
এক দশক আগে ঘটে যাওয়া এ নৃশংস ঘটনায় দায়ের করেছেন হত্যাচেষ্টা মামলা। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহেরা মাহাবুবের আদালতে চার পুলিশ সদস্যের নামে মামলার আবেদন করেন তিনি। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে আদেশ অপেক্ষমাণ রাখেন। পরে আজ বুধবার (১২ মার্চ) আদালত মামলাটিকে এজাহার হিসেবে গ্রহণের জন্য সূত্রাপুর থানা পুলিশকে নির্দেশ দেন।
দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন নয়ন
মামলার আসামিরা হলেন, সূত্রাপুর থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক মো. আমানুল্লাহ, মো. রফিকুল ইসলাম ও মো. এরশাদ হোসেন এবং কনস্টেবল কামাল হোসেন। এছাড়াও মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় পুলিশ সদস্য, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে।
পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার এলাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের কর্মী নয়ন বাছারের পায়ে গুলি করে পুলিশ। শিবির ট্যাগ দিয়ে গুলি করতে গেলে নিজেকে ছাত্রদলের কর্মী ও সনাতন ধর্মাবলম্বী বলে পরিচয় দিলেও দমানো যায় না পুলিশকে। শর্টগানের জোড়া পঙ্গু করে দেওয়া হয় নয়নকে।
জানা যায়, মামলার বাদী নয়ন বাছার বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের প্রভাষ বাছারের ছেলে। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। পুলিশের গুলিতে পঙ্গু হওয়ার সময় ছিলেন ছাত্রদলের কর্মী, পরবর্তী সময়ে হন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক।
নয়নের করা মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী সরকারের পতনের দাবিতে ডাকা অবরোধের সমর্থনে মিছিলে যোগ দিতে রওনা হন ভুক্তভোগী নয়ন বাছার। পথে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশের রাস্তা থেকে এজাহারভুক্ত চার আসামিসহ ৪০-৪৫ জন নয়নকে ভিক্টোরিয়া পার্কের উত্তর পাশে ধরে আনেন। তখন শাঁখারীবাজার মোড়ে কে বা কারা সুপ্রভাত পরিবহনে আগুন লাগিয়ে দেয়। এর জের ধরে আসামি সূত্রাপুর থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক মো. আমানুল্লাহ নয়নের কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে বলেন, ‘তোর পরিবার থেকে এখনই টাকা এনে দে। তা না হলে তোকে গুলি করে মেরে ফেলবো।’
বাদী চাঁদার টাকা দিতে অস্বীকার করলে আসামি এসআই রফিকুল ও এসআই এরশাদ হোসেন বাদীকে ধরে রাখেন। এরপর এসআই আমানুল্লাহ মুঠোফোনে কারও সঙ্গে কথা বলেন। প্রায় ৪-৫ মিনিট পরে এসআই আমানুল্লাহ অপর আসামি কনস্টেবল কামালকে হুকুম দেন, ওর (নয়ন) হাতে হ্যান্ডকাপ লাগাও। তখন কামাল বাদীর হাত পেছনে নিয়ে হাতে হ্যান্ডকাপ লাগান। তখন এসআই আমানুল্লাহ, রফিকুল ও এরশাদ বলেন, ‘তুই শিবির, তুই গাড়িতে আগুন দিয়েছিস।’ তখন বাদী বলেন, ‘আমি হিন্দু, আমি শিবির না।’
এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে এসআই আমানুল্লাহ, রফিকুল ও এরশাদের নির্দেশে কনস্টেবল কামাল হোসেন নয়নকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে বাম পায়ের হাঁটুর উপরের অংশে দুই রাউন্ড গুলি করেন। পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নয়নকে গাড়িতে উঠিয়ে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকেন মামলার আসামি চার পুলিশ সদস্য। পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত হলে তারা গুলিবিদ্ধ নয়নকে নিয়ে পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
গুলি করার পর হাসপাতালে নিয়ে এসআই রফিকুল ও এরশাদ নয়নকে বলেন, তুই আগুন সন্ত্রাস করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছিস এই মর্মে বিবৃতি দে। নইলে চিকিৎসা ছাড়াই মারা যাবি। এরপর বাদীকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করে এক মিথ্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ।
মামলার এজাহারে বাদী আরও অভিযোগ করেন, গুলি করার পর হাসপাতালে নিয়ে এসআই রফিকুল ও এরশাদ নয়নকে বলেন, ‘তুই আগুন সন্ত্রাস করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছিস এই মর্মে বিবৃতি দে। নইলে চিকিৎসা ছাড়াই মারা যাবি।’ পরবর্তীতে গুলি করার একদিন পর বাদীকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করে এক মিথ্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। এরপর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ওই বছরের ১৭ মে জামিন পান নয়ন বাছার।
বিএনপি চেয়ারপরসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন ভুক্তভোগী নয়ন বাছার
ভুক্তভোগী নয়ন বাছার ওই বছরের ২৮ মে পর্যন্ত জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতালে) চিকিৎসাধীন ছিলেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন তিনি।
পরবর্তী সময়ে এ মামলার আসামি এসআই আমানুল্লাহ, রফিকুল ও এরশাদ নয়নকে বিভিন্ন মাধ্যমে হুমকি দেন। তারা বলেন, ‘এ বিষয় যদি কোনো মামলা করিস, তাহলে তোকে জানে মেরে ফেলবো।’ এরপর বাদী উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত যান এবং দীর্ঘদিন পরে দেশে ফিরে এসে পঙ্গু অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। এখনো ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারেন না তিনি।
এসব অভিযোগে করা মামলায় দণ্ডবিধি আইনের ১৪৩/ ১৪৮/ ৩২৫/ ৩২৬/ ৩৬৪/ ৩০৭/ ৩৮৫/ ৫০৬/ ৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
কথা হয় মামলার বাদী ও ভুক্তভোগী নয়ন বাছারের সঙ্গে। দুঃসহ দিনের স্মৃতিচারণ করে জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘এক দশক আগে তিন পুলিশ সদস্য আমাকে বেআইনিভাবে গুলি করে পঙ্গু করে দিয়েছেন। এখনো পঙ্গু অবস্থায় জীবনযাপন করছি। আমার পায়ে আরও একাধিক অপারেশন করা লাগবে। সেদিন পুলিশ গুলি করার পর সূত্রাপুর থানায় তিনটি মামলা করা হয়। এসময় আমার চিকিৎসা ও আইনি সহায়তায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান পাশে ছিলেন। যারা আমার জীবন শেষ করে দিয়েছে, তাদের সর্বোচ্চ সাজা চাই।’
হাসপাতালে নেওয়ার পর সেখান থেকে চিকিৎসকদের সরিয়ে বন্দুক ঠেকিয়ে আমার কাছ থেকে ভিডিও করে জবানবন্দি নেওয়ার চেষ্টা করে যে, আমি শিবিরকর্মী। তবে আমি বলি যে আমি শিবিরকর্মী নই, আমি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের আদর্শিক কর্মী। - ভুক্তভোগী নয়ন বাছার।
নয়ন আরও বলেন, ‘গুলি করার পর আমাকে প্রায় আধাঘণ্টা পুলিশের গাড়িতে আটকে রাখে। ওইসময় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। তখন তারা আমাকে হাসপাতালে নেওয়ার পর সেখান থেকে চিকিৎসকদের সরিয়ে বন্দুক ঠেকিয়ে আমার কাছ থেকে ভিডিও করে জবানবন্দি নেওয়ার চেষ্টা করে যে, আমি শিবিরকর্মী। তবে আমি বলি যে আমি শিবিরকর্মী নই, আমি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের আদর্শিক কর্মী।’
সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের বর্তমান যুগ্ম আহ্বায়ক মো. মোস্তাফিজুর রহমান রুমি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঘটনার দিন পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার মোড়ে নয়নসহ আমরা কর্মসূচি পালনকালে পুলিশ ও ছাত্রলীগ অতর্কিত হামলা করে। তখন আমার সহযোদ্ধা নয়ন বাছারকে ধরে পায়ে শটগান ঠেকিয়ে গুলি করে। সেসময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আসাদুজ্জামান আসলামসহ আমরা নয়নের দুঃসময়ে পাশে ছিলাম। সেদিনের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলে শরীর শিউরে ওঠে। আমরা পুলিশের পোশাকধারী আওয়ামী দোসরদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।’
নয়ন বাছারের চিকিৎসায় আর্থিক সহায়তা করেন বিএনপি চেয়ারপরসন খালেদা জিয়া
তিনি আরও বলেন, ‘সেসময় আন্দোলন চালাকালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলকে নিয়ে ব্যাপক ষড়যন্ত্র চলছিল। আমাদের কাছে এরকম তথ্য ছিল যে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের কাউকে ধরতে পারলে গুলি করে মেরে ফেলবে।’
নয়নের আইনজীবী এম এ মজিদ মানিক বলেন, ‘নয়নকে গুলি করার ঘটনায় আমরা আদালতে মামলার আবেদন করি। আদালত সন্তুষ্ট হয়ে মামলাটি সূত্রাপুর থানাকে এজাহার হিসেবে গ্রহণের আদেশ দিয়েছেন। আমরা ন্যায়বিচারের ব্যাপারে আশাবাদী।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখনো মামলার এজাহার আমাদের থানায় আসেনি। এজাহার আসলে এ বিষয়ে বলতে পারবো।’