
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর ত্রিবেণী শ্মশান খাল এলাকায় পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা হানিফ আলীসহ তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাত ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এর আগে ২০০৩ সালের ৪ ডিসেম্বর একই এলাকায় দ্বন্দ্বের জেরে পাঁচ চরমপন্থী নেতাকে গুলি ও গলা কেটে হত্যা করেন চরমপন্থী নেতা কালু।
গতকাল হত্যার বিষয়ে চরমপন্থী সংগঠন জাসদ গণবাহিনীর নেতা কালু দায় স্বীকার করে গণমাধ্যমকর্মীদের হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠিয়েছেন। চরমপন্থী নেতা কালু পরিচয় দিয়ে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনাবাসীর উদ্দেশে জানানো যাচ্ছে, পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী কুখ্যাত ডাকাত বাহিনীর শীর্ষ নেতা অসংখ্য খুন, গুম, দখলদারি, ডাকাতি, ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হরিণাকুণ্ডু নিবাসী হানিফ তাঁর দুই সহযোগীসহ জাসদ গণবাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছেন। এই অঞ্চলের হানিফের সহযোগীদের শুধরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো, অন্যথায় আপনাদের একই পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে।’
জানা গেছে, একই এলাকায় ২০০৩ সালের ৪ ডিসেম্বর দ্বন্দ্বের জেরে পাঁচ চরমপন্থী নেতাকে গুলি ও গলা কেটে হত্যা করেন চরমপন্থী নেতা কালু। তাঁরা হলেন ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপার শেখপাড়া গ্রামের শহিদ খাঁ, ত্রিবেণী গ্রামের নেওয়াজ শাহ, ফারুক, নুর খান ও কুষ্টিয়ার ভবানীপুর এলাকার শরিফুল ওরফে কটা। ওই মামলায় গত বছরের ২৯ অক্টোবর তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ঝিনাইদহ জজ আদালত সূত্র আজকের পত্রিকাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এদিকে পুরাতন স্টাইলে নতুন করে চরমপন্থী সংগঠনের জানান দেওয়াটা সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, যশোরসহ বেশ কয়েকটি জেলায় আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে এই কালু।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সবচেয়ে অশান্ত ও চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের জনপদ হিসেবে পরিচিত ছিল কুষ্টিয়া জেলা। চরমপন্থী সংগঠনের মধ্যে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল), পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (লাল পতাকা), জাসদ গণবাহিনী ও শ্রমজীবী মুক্তি আন্দোলন ছিল উল্লেখযোগ্য। ২০০৪ সালের পরে র্যাব ও পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে চরমপন্থী সংগঠনের অনেক শীর্ষ নেতা নিহত হন। তখন জীবন বাঁচাতে বেশির ভাগ চরমপন্থী সংগঠনের নেতারা ভারতে পালিয়ে যান।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় কয়েকজন চরমপন্থী সংগঠনের নেতা পরিচালিত হলেও ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর তাঁরাও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এরপর আবারও নতুন করে আলোচনায় এসেছে কুষ্টিয়ার আলী রেজা সিদ্দিকী ওরফে কালু। ৯০ দশক থেকেই তিনি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জাসদ গণবাহিনীর সামরিক প্রধান ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় শতাধিক খুনের মামলা রয়েছে।
সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ভাদালিয়ায় জেটি ইন্টারন্যাশনাল (জাপান টোব্যাকো) বাংলাদেশ লিমিটেডের মূল গেটের সামনে বোমা ও গুলি ছুড়ে দুর্বৃত্তরা। ২ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে চলে যায় দুর্বৃত্তরা। ১৮ ফেব্রুয়ারি কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের সৈয়দ মাছউদ রুমী সেতুর নিচে বালু ঘাটে ম্যানেজারকে পায়ে গুলি করে ফিল্মি স্টাইলে টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায় এবং খোকসার জিলাপীতলা ঘাটে আধিপত্য নিতে প্রায় ৪০ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। পরবর্তীকালে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বালুর ঘাটের ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। সূত্রের দাবি, প্রত্যেকটি ঘটনা চরমপন্থী নেতা কালুর নির্দেশেই ঘটেছে। তিনি জানান দিতে চান, সব জায়গায় জাসদ গণবাহিনীর লোক ছড়িয়ে আছে।

চরমপন্থী নেতা কালুর সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ইবি থানাধীন আব্দালপুর গ্রামের বাসিন্দা। জাসদ গণবাহিনীর সামরিক প্রধান। ১৯৯৮ সালে মিরপুর উপজেলার কলাবাড়িয়ায় পাঁচজনকে জবাই করে হত্যার অস্তিত্ব জানান দেন কালু।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে আলামপুর ইউনিয়নের দহকুলা গ্রামের তমছের ও মানা নামে দুজনকে প্রকাশ্যে নওয়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে গুলি করে হত্যা করেন। একই সালে ঝিনাইদহ শহরের চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে নিজ গ্রামের রায়হান ও মজিদ মিয়াকে দিনদুপুরে গুলি ও জবাই করে হত্যা করেন কালু। এরপর ১৯৯৯ সালে কুষ্টিয়া সদরের কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের জোতপাড়া গ্রামের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শুকুর মালিথাকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করেন চরমপন্থী এই নেতা। ২০০২ সালে পূর্ব আব্দালপুরের তাছের নামে এক ব্যক্তিকে জবাই করে হত্যা করেন।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক ঠিকাদার জানান, ২০০৯ সালের ৮ আগস্ট তিনজনকে হত্যা করে কুষ্টিয়া গণপূর্ত কার্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ব্যাগের ভেতর তিনটি মাথা ঝুলিয়ে রেখে যান কালু।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে ভারতে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পশ্চিম আব্দালপুরের চেয়ারম্যান আনুকে শ্বাসরোধের পর জবাই করে হত্যা করেন কালু। এরপর ২০১২ সালে ঝাউদিয়া ইউনিয়নের আজিবার চেয়ারম্যানকে জবাই করে হত্যা করেন। একই সালে ইবি থানাধীন লক্ষ্মীপুর বাসস্ট্যান্ডে আব্দালপুর এলাকার রহমান ও হাসেম নামের দুজনকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করেন কালু। এর পর থেকেই আতঙ্ক হিসেবে কালুর নাম কুষ্টিয়ার আশপাশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।
তবে দীর্ঘ সময় পর হত্যার মাধ্যমে আবার নতুন করে চরমপন্থী সংগঠনের জানান দেওয়ার ঘটনার জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নাজুক অবস্থাকে দায়ী করছে সচেতন সমাজ। এ বিষয়ে কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) ফয়সাল মাহমুদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সতর্কতার সঙ্গে আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতা চলছে। এসব ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত, তাদের গ্রেপ্তারে বিশেষ অভিযানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’