
রাজধানীর শাহবাগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘেঁষে প্রায় ১৬ একর জায়গা নিয়ে ৪৬ বছর আগে ‘শহিদ জিয়া শিশুপার্ক’ গড়ে ওঠে। পার্কটি এক সময় শিশু-কিশোরসহ সব বয়সিদের অত্যন্ত পছন্দের জায়গা ছিল। কিন্তু শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নামে হওয়ায় বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পার্কটি ধ্বংস করে দিয়েছে। পার্কটির নাম-নিশানাসহ সব মুছে দিয়েছে।
২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে রাতের আঁধারে পুরো পার্কের চারপাশে উঁচু প্রাচীর তৈরি করা হয়। কয়েকদিনের মধ্যেই পার্কের সম্মুখভাগের গেট ও নামফলক ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর ভেতরের সব রাইড, খেলনা ট্রেন, মেরি গো রাউডসহ অন্তত ২০টি রাইড এবং বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে উপহার হিসাবে পাওয়া ‘জেট প্লেন’-সবই বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
সাধারণ দর্শনার্থী ও নগরবিদদের ভাষ্য-শেখ হাসিনার খায়েশ ছিল পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ শহিদ জিয়া শিশুপার্ক ঘিরে শুধু তার বাবার (শেখ মুজিব) ভাস্কর্যসহ বিভিন্ন স্থাপনা অর্থাৎ মুজিব বন্দনার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু তৈরি করা। ক্ষমতাসীন হয়ে একক সিদ্ধান্তে তিনি পার্কটি বন্ধ করে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করা শুরু করেন। শিশুপার্ক বলতে যা বোঝায়-তা না করে পার্কের ভেতরে ৫৩ ফুট উথচু শেখ মুজিবের ভাস্কর্যসহ পাকিস্তান সেনাদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের ভাস্কর্য তৈরি শুরু করেন। আন্ডারপাসসহ এসব ভাস্কর্য তৈরিতে প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। আসলে এটি ছিল ‘শেখ হাসিনার প্রকল্প’। তাই এ নিয়ে কারও কিছু বলার সাহস ছিল না। ফলে এ প্রকল্পে বরাদ্দ অর্থ হরিলুটও হয়েছে অবাধে। শেখ মুজিব বন্দনা করতে গিয়ে যে ঐতিহ্যবাহী শিশুপার্কটি তার বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলছে-এ নিয়ে কারও প্রশ্ন তোলার সাহস ছিল না।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) কামরুন নাহার যুগান্তরকে বলেন, ‘অনেক বছর ধরে শিশুপার্কটিতে উন্নয়ন কাজ চলছে। এখন আমাদের সাফ বক্তব্য-শিশুপার্ক শিশুপার্কের মতোই হতে হবে। যত ভাস্কর্য আছে, সবই ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ভেতরে কোনো ভাস্কর্য থাকবে না। যেসব স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোও রাখা হবে না। আমরা নতুন করে সবই করছি, করব। এখনো পার্কের পুরো জায়গা উদ্ধার করতে পারিনি। কিছু জায়গা এখনো দখলে আছে। পার্কটির ঐতিহ্য রয়েছে। ঐতিহ্য অনুযায়ী এখানে একটি মানসম্পন্ন শিশুপার্ক তৈরি করা হবে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্থপতি ও প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘?নিয়ম অনুযায়ী ওখানে যে সংস্থা কিংবা মন্ত্রণালয় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে-তাদের প্রকৃত নকশা আমাদের দেওয়ার কথা। কিন্তু আমরা কোনো নকশা কিংবা প্রয়োজনীয় কাজপত্র এখনো পাইনি। তাছাড়া আমাদের অংশগ্রহণও খুব একটা নেই। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত অধিদপ্তরই কাজ করছে।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ওটা শিশুপার্ক নয়, শিশুপার্ক করার ইচ্ছেও ছিল না শেখ হাসিনার। তার ঘরের লোক (শেখ ফজলে নূর তাপস) ছিল এ সিটির মেয়র। ওখানে কী হচ্ছে, কী হচ্ছে না-সবই দেখত শেখ তাপস। এ প্রকল্পের অর্থ লুটপাট করেছে শেখ পরিবার, খোদ শেখ হাসিনা। শেখ মুজিব বন্দনার উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন তারা।’
সম্প্রতি টানা চার দিন শহিদ জিয়া শিশুপার্ক ঘুরে দেখা যায়, এর চারপাশে উঁচু বেড়া। সাধারণ মানুষ ভেতরে প্রবেশ করতে পারছে না। যদিও প্রতিদিন অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের নিয়ে আসছেন। কিন্তু পার্কে বেড়া দেখে মনোকষ্ট নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। অনেক শিশুকে কান্না করতেও দেখা যায়। অভিভাবকদের কেউ কেউ জানান, তারা জানেন না পার্কটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কেউ বলেন, ‘বারবারই ভুলে চলে আসি। কারণ ঢাকার মধ্যে সবচেয়ে ভালো পার্ক ছিল শহিদ জিয়া শিশুপার্কটি।’
পার্কটির ভেতরে শেখ মুজিবের ভাস্কর্যসহ দুটি ভাস্কর্য ঘিরে বিশ্বাল দৈর্ঘ্যরে ‘এস’ আকারের ফোয়ারা, নানা ধরনের উঁচু-নিচু স্থাপনা ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। পার্কটি ২০১৯ সালের আগে সবুজ গাছপালায় ভরা ছিল। তবে এখন গাছপালাশূন্য। শহিদ জিয়া শিশুপার্কের কোনো রাইড, স্থাপনা ভেতরে দেখা যায়নি। তবে উত্তর পাশে ভাঙা গেটের পাশে মরিচাপড়া একটি হরিণের ম্যুরাল চোখে পড়ে। পূর্বদিকে একটি ভাঙাচোড়া রাউন্ড রাইডের চিহ্ন পড়ে আছে।
এ বিষয়ে কথা হয় পার্কের এক অংশের কাজের পরামর্শক ইঞ্জিনিয়ার আজাহারুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, পার্কটির নামকরণ করা হয়েছে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শিশুপার্ক। এখন কাগজে-কলমে নাম এটিই। পার্কের অধিকাংশ জায়গা ঘিরে ভাস্কর্য, আন্ডার পার্কিং, ফোয়ারাসহ ভাস্কর্য সংশ্লিষ্ট স্থাপনা তৈরি করা হয়েছিল। এসবের অনেক কিছুই ভেঙে ফেলা হয়েছে। তবে শক্ত মজবুত হওয়ায় এসবের অংশ এখনো রয়ে গেছে। আমাদের দায়িত্ব অনুযায়ী, এটিকে একটি শিশুপার্কে রূপ দেওয়া। ওইভাবেই কাজ চলছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের নির্দেশনায় আধুনিক সব রাইড স্থাপনের কাজ চলছে। যেখানে জুলাই অভ্যুত্থানের অনেক কিছু স্থান পাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘পার্কের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে মুজিব বন্দনার জন্য স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছিল। অধিকাংশ কাজ শেষও হয়েছে। আওয়ামী সরকার শিশুপার্ক তৈরি করার জন্য এটি বেছে নেয়নি। মূলত মুজিব ভাস্কর্যসহ মুজিব বন্দনার জন্যই উন্নয়ন কাজ চালিয়েছে। পুরো এলাকায় এমন করে পাথরের স্থাপনা, মুজিবকেন্দ্রিক ছোট-বড় ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে-এখন এখানে নতুন করে সবুজ গাছপালা লাগানো সম্ভব নয়।’
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে ১৯৭৯ সালে শাহবাগে প্রায় ১৬ একর জায়গার ওপর শহিদ জিয়া শিশুপার্কটি নির্মিত হয়। চালু হয় ১৯৮৩ সালে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণপূর্ত অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কেন্দ্রস্থলে স্বাধীনতা জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে। এর চারপাশে বিশাল এলাকাজুড়ে পানির ফোয়ারা তৈরি করে উদ্যানটিকে এক প্রকার ধ্বংস করা হয়েছে। ভাস্কর্য নির্মাণের নামে শহিদ জিয়া শিশুপার্কটিও নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা ছিল শেখ হাসিনার। ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর শহিদ জিয়া শিশুপার্কের নাম পরিবর্তন করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শিশুপার্ক নাম করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভাস্কর্য বিভাগের সাবেক একজন চেয়ারম্যান যুগান্তরকে বলেন. ‘শিশুপার্কে ম্যুরাল কিংবা ভাস্কর্য থাকতে পারে। তবে তা শিশুদের উপযোগী হতে হবে। সেগুলো ১ থেকে ২ ফুট কিংবা ৫ থেকে ১০ ইঞ্চিরও হতে পারে। কিন্তু শিশুপার্কের আড়ালে যদি -অন্য কিছু তৈরির উদ্দেশ্য হয়, তাহলে শিশুদের জন্য নিশ্চয় শিশুপার্ক হয়ে উঠবে না। শিশুপার্কে নির্ধারিত স্থানে রাইড, সবুজ গাছ জরুরি। বহু ভবন কিংবা অনেক বড় ভাস্কর্য জরুরি নয়। ছোট্ট ভাস্কর্য তৈরি করে গ্লাসের ভেতরে রাখলেই প্রকৃতপক্ষে শিশুসহ সব বয়সি মানুষ ভালো করে দেখতে ও বুঝতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, ‘বর্তমানে ওই শিশুপার্কে তাদের অংশের (পার্কিং) কাজ বন্ধ রয়েছে। প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ সমাপ্ত হয়েছে। পার্কিংয়ের যে ছাদ রয়েছে সেখানে নিশ্চয় কোনো রাইড বসানো সম্ভব হবে না। পাশের জায়গায় শিশুপার্কের জন্য রাইড বসাতে হবে। তাছাড়া আমরা যেহেতু শিশুপার্ক নির্মাণে সম্পৃক্ত নয়, সে কারণেই বিস্তারিত বলতে পারছি না।