
তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ও মেগা প্রকল্প অবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবিতে ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন’ নামের একটি সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে গত সোম ও মঙ্গলবার দেশের উত্তরাঞ্চলে তিস্তাপাড়ে ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়েছে। যদিও আয়োজক সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে আছেন বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু। তবে তিনি একে বিএনপির নয়, গণমানুষের আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করেছেন। দুদিনের এই কর্মসূচি ঘিরে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার ১১টি পয়েন্টে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। ভার্চুয়ালি এই কর্মসূচিতে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিস্তাপাড়ে গিয়ে সরাসরি আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন দলটির মহাসচিবসহ এক ডজন শীর্ষ নেতা। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বসহ দলটির নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি সত্ত্বেও কর্মসূচিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিতে দেখা গেছে লাখো মানুষকে, যাকে এই জনপদে বিএনপির রাজনীতির পালে নতুন হাওয়ার ইঙ্গিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত মঙ্গলবার লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি কর্মসূচিতে যুক্ত হয়ে দেওয়া বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তিস্তার পানির হিস্যা আদায়ে ভারতের প্রতি কঠোর মনোভাবের বিষয়টি স্পষ্ট করেন। দাবি আদায়ে আন্তর্জাতিক মহলে যোগাযোগ ও প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আলোচনার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তাগাদা দেন তিনি। পাশাপাশি ক্ষমতায় গেলে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সবরকম উদ্যোগ গ্রহণের প্রতিশ্রুতিও দেন।
তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সম্পৃক্ততা এবং এতে যুক্ত হয়ে তারেক রহমানের দেওয়া বক্তব্যকে ইতিবাচকভাবেই নিচ্ছেন এই জনপদের মানুষ। আন্দোলনে যোগ দেওয়া সাধারণ মানুষ বলছে, তাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনে বিএনপি এগিয়ে আসায় তারা নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন। আগামী দিনে সরকার গঠন করলে বিএনপি তাদের দাবি পূরণে কাজ করবে বলেও আশা তাদের। আর বিশ্লেষকরা বলছেন, তিস্তার পানির হিস্যা আদায় ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারেক রহমানসহ বিএনপি শীর্ষ নেতৃত্ব যে ঘোষণা দিয়েছে, তার সুফল আগামী নির্বাচনে পেতে পারে দলটি।
লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার রুদ্রেশ্বর গ্রামের বাসিন্দা শাহিনুর রহমান কালবেলাকে বলেন, তিস্তা নদী এখন তাদের দুঃখ। প্রতি বছর বন্যা ও নদী ভাঙনে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয় তাতে এ এলাকার মানুষ সারাবছর অভাবে থাকে। এবার বিএনপি আন্দোলনের যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে পুরো নদী এলাকার মানুষ তাদের সাথে আছে।
তিনি বলেন, ‘যে উদ্যোগ নিছে তাতে শুধু আমি না মোটামুটি নদী এলাকার যত মানুষ আছে তারা সাধুবাদ দিছে– বিএনপির হাত দিয়ে যদি বিশাল উপকারটা হয়। তাতে আমরা উপকৃত হবো, দুঃখটা লাঘব হবে। যদি বিএনপি এটা করে তাহলে তাদের রাজনীতি ও ভোটে অনেক প্রভাব পড়বে।’
৪৮ ঘণ্টার এ কর্মসূচিতে যোগ দেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছের বাসিন্দা জহির উদ্দিন। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘যারা আমাদের পাশে থাকবে আমরাও তাদের পাশে থাকব। আমাদের দুঃখের সময় যাদের আমরা পাশে পাব, যারা আমাদের দাবি নিয়ে কথা বলবে আমরা তো স্বাভাবিকভাবে তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ব।’
এদিকে এই কর্মসূচি ঘিরে চাঙা হয়েছে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও। তারা বলছেন, এত বড় জমায়েতের পর উত্তরের রাজনীতিতে বিএনপি আগামীদিনে ভালো কিছু করবে, তা বোঝাই যাচ্ছে। এ অঞ্চলগুলোতে আগামী নির্বাচনে বিএনপির বিজয়ের সম্ভাবনার দিক বিবেচনা করেই তিস্তা ইস্যুটিকে সামনে এনেছে দল।
এ কর্মসূচিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘মানুষের স্বার্থে যে কোনো আন্দোলন করলে সে দলের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে আসে। তিস্তাপাড়ের মানুষের সমস্যা সমাধানে এরকম আন্দোলন আর হয়নি। এ কর্মসূচির কারণে তিস্তাপাড়ের মানুষ অনেক সজাগ হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আমাদের সঙ্গে থাকবে।’
জেলা মহিলা দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহেদা হাসান বলেন, ‘এ আন্দোলনের জন্য সাংগঠনিকভাবে আমরা অনেকটাই চাঙা। আগামীতে নির্বাচন যেহেতু সামনে আছে, এ জন্য সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে, এটাও একটা বার্তা ছিল এ আন্দোলনের।’
কী বার্তা দিল বিএনপি
তিস্তা আন্দোলন নিয়ে বিএনপির এ কর্মসূচি ঘিরে রাজনৈতিক মহলে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিনের এ দাবি সমাধানে প্রতিবেশী দেশকে চাপ প্রয়োগ ও দ্রুত সময়ের মধ্যে আগামী নির্বাচন আয়োজন করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে বার্তা দিয়েছে দলটি। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতি নিজেরদের মনোভাব স্পষ্ট করেছে দলের শীর্ষ নেতারা।
কর্মসূচির উদ্বোধন শেষে দেওয়া বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘ভারতকে পরিষ্কার করে বলতে চাই—বাংলাদেশের মানুষদের সঙ্গে যদি বন্ধুত্ব করতে চান, তাহলে তিস্তার পানি দেন, সীমান্তে গুলি করে হত্যা বন্ধ করেন। বড় দাদার মতো আচরণ বন্ধ করেন। আমরা আমাদের পায়ের ওপর দাঁড়াতে চাই। আমরা আমাদের হিস্যা বুঝে নিতে চাই। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই; কিন্তু সেই বন্ধুত্ব তবে সম্মানের সঙ্গে, আমার যে পাওনা সেটি বুঝে নেওয়ার সম্পর্ক।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘এই জায়গায় আপনাদের নিরপেক্ষ থাকলে চলবে না, আপনাদের মুখ খুলতে হবে। ভারতকে বলতে হবে যে পানির ন্যায্য হিস্যা আমরা চাই। আর আপনি যেহেতু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, খুব তাড়াতাড়ি নির্বাচন দিয়ে জনগণের সরকারের হাতে ক্ষমতা দেন। নির্বাচন দিলে দেশে যে অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে তা আর থাকবে না। দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আসবে।’
কর্মসূচি ঘিরে বিএনপির উদ্দেশ্য কী
এর আগেও তিস্তা ইস্যুতে আন্দোলন করেছে বিএনপি। ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিল ঢাকা থেকে তিস্তা অভিমুখে লংমার্চ করেছিল দলটি। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় সংস্কার ও নির্বাচন আয়োজন যখন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা, তখন বিএনপির এ কর্মসূচির কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো নির্বাচন ঘিরে এ অঞ্চলের মানুষের আস্থা অর্জন, তিস্তার পানিচুক্তি ও প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন তৈরি করা এবং আগামী দিনে সরকারে এলে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি কী হবে তা স্পষ্ট করা। এ উদ্দেশ্যে দলটি অনেকটাই সফল বলে মনে করছেন রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ত্বহা হোসাইন।
তিনি বলেন, এই কর্মসূচি ঘিরে বিএনপির তিনটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে, এ অঞ্চলে বিএনপি জাতীয় পার্টির ফাঁকা জায়গাটি পূরণ করতে চাচ্ছে। দ্বিতীয়ত ইস্যুটা সেন্টিমেন্টাল। এ অঞ্চলের মানুষ কৃষির সঙ্গে জড়িত। তারা সেচের জন্য তিস্তা নদী ও এর সঙ্গে যুক্ত শাখা উপশাখা ও ছোট ছোট নদীর ওপর নির্ভরশীল। বিএনপি জনগণের এই সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগাতে চাচ্ছে হয়তো।
তৃতীয় উদ্দেশ্য সম্পর্কে ত্বহা হোসাইন বলেন, দেশের পররাষ্ট্রনীতিও নতুন করে ভাবা হচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে জনগণের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে যে, কোনো পরাশক্তির কাছে নতজানু হব না। এক্ষেত্রে আগামীতে ক্ষমতায় গেলে বিএনপির পররাষ্ট্রনীতি কী হবে তা হয়তো পরিষ্কার করতে চাচ্ছে। তবে মূলত এ বছরের শেষে যে নির্বাচন হবে সেটিকে লক্ষ্য করেই তারা আগাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, ‘দীর্ঘদিনের দাবি বাস্তবায়নের এ আন্দোলন কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দলের নয়। এ নদীর জন্য মানুষ ছিন্নমূল, ভিক্ষুকে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুযায়ী যতটুকু পানির ভাগ পাব ততটুকু যেন দেওয়া হয়। দুই কোটি মানুষের জীবনরেখা হলো তিস্তা নদী। এ নদীকে রক্ষা না করে আমরা আন্দোলন থেকে সরে যাব না।’