কাজী সিরাজ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছিল। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সেই সাজা কমিয়ে আসামিকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন। রায় ঘোষণার পরপরই সারা দেশে দুটি জোরালো গুঞ্জন ওঠে। এক. সরকার এবং জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে তলে তলে একটা সমঝোতা বা অাঁতাতের ফলেই জনগণ সংঘবদ্ধ হওয়ার মতো একটি রায় হয়েছে এবং দুই. বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট থেকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বেরিয়ে যাওয়াটা এখন কেবলই সময়ের ব্যাপার। বলে নেওয়া দরকার, ঘোষিত রায় নিয়ে যে পাবলিক পারসেপশন, তাতে অভিযোগের আঙ্গুল কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে- যে বিচারকরা রায় দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে নয়। এ ব্যাপারে কোনো ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ নেই। কিন্তু সরকারি মহল তেমন একটি ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করে এ সংক্রান্ত মত প্রদানকারীদের সঙ্গে বিচার বিভাগের একটি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি করে নিজেদের ভূমিকা আড়াল করতে চাচ্ছে বলে মনে হয়। আইন বিশারদ না হয়েও যে কোনো বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন লোক বুঝতে পারেন যে, কোনো মামলার রায় নির্ভর করে বাদী ও আসামি পক্ষের সওয়াল-জওয়াব, যুক্তিতর্ক এবং সরবরাহকৃত তথ্য-উপাত্ত সংবলিত নথির ওপর। যে কোনো পক্ষের আইনি লড়াইয়ের দুর্বলতা, গাফিলতি বা স্বার্থান্বেষী ভূমিকা বা আচরণ কিংবা চতুরতায় মামলার রায় এদিক-সেদিক হয়ে যেতে পারে। বিচারকের তাতে কিছু করার থাকে না। বিচারক মামলা শুনে-বুঝে রায় দেন, বাদী-বিবাদীর কারও পক্ষে লড়াই করেন না, কোনো বিচারকের তা করার কথা নয়।
সরকার-জামায়াত অাঁতাতের যে কথাটা বাইরে চাউর হয়েছে সরকার পক্ষকে কেউ তা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানান দেয়নি। আলোচিত মামলাটি ঘিরে এই গুঞ্জনটা পত্রপত্রিকায় এসেছে পরদিন ১৮ সেপ্টেম্বর। ইলেকট্রনিক মিড়িয়ায় জনমত প্রকাশ হতে থাকে সন্ধ্যার পর থেকে বিভিন্ন টকশোতে। কিন্তু তার আগেই 'অাঁতাত হয়নি, অাঁতাত হয়নি' কথাটা অনেকটা প্রলাপের মতো উচ্চারিত হতে থাকে সরকারি তরফ থেকে। রায় ঘোষণার পরপরই তাৎক্ষণিক সভায় বসে ক্ষমতাসীন ১৪-দলীয় জোট। জোটের মুখপাত্র ও সভার সভাপতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিম 'ঠাকুর ঘরে কে রে- আমি কলা খাই না'র মতো আওয়াজ দিয়ে উঠলেন যে, 'যারা অাঁতাতের কথা বলে তারা জ্ঞানপাপী।' তিনি বলেছেন, আদালতের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল, তারা রায় মেনে নিয়েছেন। রায় অমান্য করার কথা কিন্তু কেউ বলেননি। যারা রায়ে সন্তুষ্ট হননি, সংক্ষুব্ধ হয়েছেন, ক্ষুব্ধ মনোভাবও প্রকাশ করেছেন মিডিয়ায়, তারা কেউ কিন্তু এ কথা বলেননি যে, এ রায় আমরা মানি না। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলমও মন্ত্রী মো. নাসিমের সুরেই কথা বলেছেন রায় প্রকাশের পর সারা দিন। হ্যাঁ, অাঁতাতের অভিযোগ তার কাছে যাওয়ার পর তিনি তা নাকচ করতে পারেন। কিন্তু একজন প্রবীণ আইনজীবী হিসেবে তিনি এ কথা কী করে বলতে পারছেন যে, এই সন্দেহ, পাবলিক পারসেপশন বা অভিযোগের পেছনে বিচার বিভাগকে হেয়প্রতিপন্ন করার দুরভিসন্ধি আছে।
সরকার ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে গোপন অাঁতাত বা তলে তলে সমঝোতার বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনা-সমালোচনা চলছে। খোদ বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের ভিতরও জামায়াত নিয়ে নানা ধরনের সন্দেহ-সংশয় ও কানাঘুষা চলছে। পাঠক, আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, বছরখানেক আগে বরিশালের এক জনসভায় স্বয়ং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তলে তলে সরকার-জামায়াত অাঁতাতের প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন। অতি সম্প্রতি জোটের এক সভায় বেগম জিয়া জামায়াতের প্রতিনিধির কাছে 'অাঁতাতের' ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলেন। যে খবর মিডিয়ায়ও প্রচার হয়েছে ব্যাপকভাবে। বেগম খালেদা জিয়া কিংবা তার দলের পক্ষ থেকে কখনো সেই খবরের সত্যতা অস্বীকার করা হয়নি। জামায়াতে ইসলামী মাঝে মাঝে মৃদুকণ্ঠে বলেছে- না, সরকারের সঙ্গে তাদের কোনো অাঁতাত হয়নি। কিন্তু মানুষ তা আস্থায় নেয়নি। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার কাজে শ্লথগতি এবং জামায়াতের নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়ার পর দীর্ঘদিন অন্যদের ঘোষিত দণ্ড কার্যকর করার ব্যাপারে প্রলম্বিত প্রক্রিয়া জনমনে এই সন্দেহ বাড়িয়ে দেয় যে, এটা বোধহয় সরকারের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর একটা অর্থপূর্ণ সমঝোতারই ফল। জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মামলার বিচারক পরিবর্তনের কারণে একই মামলার দ্বিতীয় শুনানির ব্যবস্থার ফলে অনেক সময়ক্ষেপণ, অসুস্থতার কারণে আদালতের কার্যক্রম স্থগিতকরণ তথা রায় প্রদান কার্যক্রম প্রলম্বিতকরণ এবং কারা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তার সুস্থতার বার্তা পৌঁছানোর পরও তার মামলায় জট লেগে থাকা এবং পাশাপাশি জামায়াতের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীর জামিন লাভের ঘটনাসমূহ সাধারণ্যে এই বার্তাই তো দেয় যে, ভিতরে ভিতরে অবশ্যই একটা 'খেলা' চলছে এবং এসব খেলার পেছনে সরকারের একটা হাত অবশ্যই আছে। শোনা যাচ্ছে যে, জামায়াত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার যে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়, তা খুবই দুর্বল এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারি উকিলরা যথাযথভাবে মামলা লড়েন না। ফলে জামায়াত নেতা-কর্মীদের জামিন পেতে কোনো অসুবিধা হয় না। এ জন্য বিচারককে দায়ী করা যাবে কী করে? সন্দেহ করা হয়, সরকারি ইচ্ছাতেই এসব হয়ে চলেছে। তো, জনগণ অাঁতাত বা সমঝোতার কথা বলবে না কেন?
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার ব্যাপারেও একই ধরনের সমালোচনাই উঠে আসছে। অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর দণ্ড কমে যাওয়ায় তার মনোবেদনার কথা বলে এর কারণ হিসেবে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা রীতিমতো অাঁতকে ওঠার মতো। তা সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধেই যায়। ১৭ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১১টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তিনি একাত্তর টেলিভিশন চ্যানেলের 'একাত্তর জার্নাল' টকশোতে ছিলেন। সেই টকশোতে আমিও ছিলাম। আরও ছিলেন ঢাকা ট্রিবিউনের বিশেষ সংবাদদাতা জুলফিকার আলী মানিক এবং দেশের নাট্যব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। অ্যাটর্নি জেনারেলের নিরুত্তাপ কণ্ঠেও প্রকাশ পেয়েছে যে, রায়ে তিনিও সন্তুষ্ট নন। তবে রায়টি এমন হওয়ার জন্য তদন্ত টিমের গাফিলতিই দায়ী। জুলফিকার আলী মানিক তাকে সুনির্দিষ্টভাবে প্রশ্ন করেছিলেন, 'সমগ্র মামলাটি পরিচালনা করতে গিয়ে কোন কোন বিষয়ে তদন্ত টিমের গাফিলতি আপনার চোখে ধরা পড়েছে?' তিনি স্পষ্ট করেই একটি উদাহরণ তুলে ধরেন। পিরোজপুরের ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা মামলার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, নিহতের স্ত্রী একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। আসামি পক্ষ এফআইআরের কপি দেখিয়ে বলেছে, তাতে সাঈদীর নাম নেই। তদন্ত টিম এই মামলার চার্জশিট হয়েছিল কিনা, পরে নতুন কোনো মামলা হয়েছিল কিনা কিছুই তদন্ত করে বের করতে পারেনি। এটা গাফিলতি। ফলে এই হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পেয়ে যায় সাঈদী। এটা তদন্ত টিমের দোষ। আদালত তাকে মামলার এসব দুর্বলতার কথা জানিয়েছেন। কিন্তু তদন্ত টিম কোনো প্রকার ইনপুট দিতে পারেনি। সব গায়েব হয়ে গেছে। তার চেষ্টাও সফল হয়নি। প্রসিকিউশন সম্পর্কেও তিনি প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, কারও কারও সম্পর্কে শুনলে শিউরে উঠতে হবে। এমন ব্যক্তিও আছেন যার ফৌজদারি মামলা করারও অভিজ্ঞতা নেই। একজনের পারফরম্যান্সে বিরক্ত হয়ে আদালত থেকে তাকে বের করে দিয়েছিলেন বিচারক।
অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার হয়েছে যে, তদন্ত টিম এবং প্রসিকিউশনের দুর্বলতা ও গাফিলতির কারণেই মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায় গণপ্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। এখানেই তো মামলার রায় প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে সরকারি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। ইনভেস্টিগেটিং টিম বা তদন্ত টিম এবং প্রসিকিউশনের আইনজীবী প্যানেল তো বিচারকরা ঠিক করেননি, করেছে সরকার, সরকারের পক্ষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরুর সময়ই এই বিচারের ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। চিফ ইনভেস্টিগেটর নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল একজন জামায়াতে ইসলামীর লোককে। এ নিয়ে চারদিকে বেশ হৈচৈ হয়। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ কেউ কেউ এ নিয়োগ নিয়ে আপত্তি তোলে। প্রথমে সরকার তা কানে তোলেনি। পরে লীগ নেতা আমির হোসেন আমু যখন চেঁচিয়ে ওঠেন যে, নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে ইসলামী ছাত্র সংঘের (শিবিরের পূর্বসূরি সংগঠন) প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল, তখনই সরকারের টনক নড়ে এবং তাকে পরিবর্তন করা হয়। তখনই সন্দেহ জেগেছিল, সরকার বিষয়টি নিয়ে হয়তো রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের মতলবে আছে। জামায়াতকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট থেকে সরিয়ে ভোটের রাজনীতিতে বিএনপিকে ঘায়েল করার ব্লুপ্রিন্ট নিয়ে কাজ করছে সরকার। জামায়াতকে ভয়-ভীতি ও চাপের মধ্যে রাখার এটা হয়তো সরকারের একটা কৌশল। রাজনীতিতে কত কিছুই তো হয়। জামায়াত এর আগেও আওয়ামী লীগের সমগামী হয়েছিল। স্বৈরাচার এরশাদের ১৯৮৬ সালের পাতানো নির্বাচন বিএনপি বর্জন করেছিল। কিন্তু 'এরশাদের অধীনে যারা নির্বাচনে যাবে তারা হবে জাতীয় বেঈমান'- এই প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু তিনি নিজেই ওয়াদা ভঙ্গ করেন এবং তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এরশাদের ক্ষমতা দখলকে বৈধতা প্রদান করে। জামায়াতে ইসলামী তখন বিএনপির সঙ্গে না থেকে আওয়ামী লীগের সমগামী হয়। তারাও সেই পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। পঞ্চম জাতীয় সংসদে খালেদা সরকারের বিরুদ্ধে একটি অনাস্থা প্রস্তাবে জামায়াত আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দিয়ে সরকারকে পরাস্ত করে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ জামায়াতে ইসলামীও ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে। তারা অসহযোগসহ যুগপৎ একই কর্মসূচিতে লড়াই করেছে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে। কাজেই বিএনপিকে কুপোকাৎ করার জন্য আবারও আওয়ামী লীগ-জামায়াত একটা অাঁতাতের বিষয় মানুষ উড়িয়ে দিচ্ছে না। মানুষ সন্দেহ করছে সরকার ইচ্ছা করেই প্রসিকিউশনের আইনজীবী প্যানেল এবং ইনভেস্টিগেটিং টিম দুর্বল করে গঠন করেছে। প্রশ্ন উঠেছিল, সরকার যদি যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে আন্তরিক ও সিরিয়াস হতো তাহলে সরকার সমর্থক ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ূনের মতো বাঘা বাঘা আইনজীবী প্রসিকিউশনের আইনজীবী প্যানেলে নেই কেন? মনে হয়, শুরু থেকেই 'লড়ব কিন্তু হারব' এমন একটা শুভঙ্করের ফাঁকি ছিল সরকারের পরিকল্পনায়। তদন্ত টিম এবং প্রসিকিউশনের আইনজীবী প্যানেল সম্পর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলমের অভিযোগ এবং সরল স্বীকারোক্তি জনগণের ধারণা ও সন্দেহকেই প্রতিষ্ঠিত করে। এই অভিযোগ এখন উঠতেই পারে যে, সরকারের হস্তক্ষেপে বা পরামর্শেই তদন্ত টিম তাদের কাজে গাফিলতি করে মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করা অসম্ভব করে দিয়েছে এবং আসামি পক্ষের ঝানু ঝানু আইনজীবীদের বিপক্ষে লড়ার জন্য জজ কোর্টে মামলা করারও অভিজ্ঞতা নেই তেমন আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছে প্রসিকিউশনে। সত্যিকারের লড়াইয়ের প্রত্যয় থাকলে যোগ্য ও অভিজ্ঞ লোক থাকা সত্ত্বেও অযোগ্যদের কেন নিয়োগ দিল সরকার? অ্যাটর্নি জেনারেল অবশ্য এ ব্যাপারে সব দায় চাপিয়ে দিয়েছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমদের ওপর। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়া বা তাদের 'তালিকার' বাইরে সাবেক আইনমন্ত্রী সবকিছু সাজিয়েছেন এটা কী বিশ্বাসযোগ্য? জুলফিকার আলী মানিক অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন জামায়াতের মূল নেতা-অপরাধীর বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলাই তো চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায়। এখন তো নতুন করে কোনো তথ্য-উপাত্ত ও অনুসন্ধান রিপোর্ট যোগ করার সুযোগ নেই। সব ক্ষেত্রেই যদি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার মতো গাফিলতি ও দুর্বলতা থেকে যায় তা হলে সব ক্ষেত্রেই কী আমাদের বলতে হবে 'বেদনাহত হৃদয়ে রায় মেনে নিলাম'। এর কোনো সঠিক জবাব অবশ্য দেননি অ্যাটর্নি জেনারেল। টিভি পর্দায় তার অসহায় অভিব্যক্তিই দেখা গেছে শুধু। লক্ষণীয় ব্যাপার, এর আগে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে প্রথমে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ায় সরকার পক্ষের যে সব বুদ্ধিজীবী ফেটে পড়েছিলেন, গণজাগরণ মঞ্চ ও এর আশপাশ কাঁপিয়ে তুলেছিলেন, রায় ঘোষণার সময় সারাক্ষণ আদালতে বসে থাকতেন তাদের মধ্যে একমাত্র কর্নেল (অব.) তাহেরের ভাই আনোয়ার হোসেন ছাড়া শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু কাউকে দেখা যায়নি। আনোয়ার হোসেনও যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তা হাস্যকর। একমাত্র সাংবাদিক আবেদ খানকে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা গেছে। বাকি সবাই জানিয়েছেন 'হোমিওপ্যাথিক' প্রতিক্রিয়া। রায় নিয়ে পাবলিক পারসেপশন এতে আরও দৃঢ় হচ্ছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, তা হলে জামায়াত দুই দিন হরতাল ডাকল কেন? আজকের হরতাল কেমন হবে জানি না। তবে বৃহস্পতিবার কোনো হরতাল হয়েছে বলে মনে হয়নি। মানুষ বলছে হওয়ার জন্য বা সরকারকে বিব্রত করার জন্য জামায়াত হরতাল ডাকেনি, হরতাল ডেকেছে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থা থেকে রক্ষার জন্য। মানুষের এই ধারণা যদি সত্য হয়, তা হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মেরুকরণে পরিবর্তন বোধহয় সহসাই লক্ষ্য করা যাবে।
জামায়াতের সঙ্গে সরকারের অাঁতাতের ব্যাপারে বিএনপিতে সন্দেহের বিষয়টা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। জামায়াতও বিভিন্ন সময় বিএনপির আচরণে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে এবং তা মিডিয়ায়ও এসেছে। গতকালও এমন একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে খবরের কাগজে। বিভিন্ন স্থানে শিবির-ছাত্রদল দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাড়ছে। উপজেলা নির্বাচনে বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াত বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ করেছে। অনেক উপজেলায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দিয়ে ভাইস চেয়ারম্যান পদ নিয়ে সমঝোতা করেছে। যার ফলে তারা ভাইস চেয়ারম্যান পদে অস্বাভাবিক ফল করেছে। তারা যে সব উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান জিতেছে তার অধিকাংশ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে জিতেছে আওয়ামী লীগ। অতি সম্প্রতি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ধর্মকে ভিত্তি করে কোনো রাজনৈতিক দল হয় না। তার এই বক্তব্য সরাসরি জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে যায়। জামায়াতের সঙ্গে 'মধুচন্দ্রিমা' শেষ হওয়ার ইঙ্গিত বলেই অনেকে তারেক রহমানের এই উক্তিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছেন। মনে হচ্ছে ২০-দলীয় জোটে সহসাই ভাঙনের শানাই বাজবে। জামায়াতের ২০-দলীয় জোট ত্যাগ এখন কী তবে সময়ের ব্যাপার? বিএনপি-জামায়াত মধুচন্দ্রিমা কী শেষ হয়ে যাচ্ছে?
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন