|
এ এম এম শওকত আলী
|
|
ক্যাঙ্গারু কোর্ট
20 Sep, 2014
ক্যাঙ্গারু কোর্ট ইংরেজিতে বহুল প্রচলিত বিষয় না হলেও অনেকেই ক্ষেত্রভেদে এটি ব্যবহার করেন। এ বিষয়টির উৎপত্তি নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। ক্যাঙ্গারু অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় প্রাণী। অথচ ক্যাঙ্গারু কোর্ট শব্দের উৎপত্তি অস্ট্রেলিয়ায় হয়নি। জানা যায়, এ অভিব্যক্তির উৎপত্তি যুক্তরাষ্ট্রে। ১৮৪৯ সালের ক্যালিফোর্নিয়ার সোনার খনির মালিকানার সঙ্গে জড়িত। ওই সময় সোনার খনির স্বত্বাধিকারী হওয়ার জন্য সংক্ষিপ্ত বিচারব্যবস্থা ছিল বলে জানা যায়। খনির মালিকানা স্থায়ীভাবে পাওয়ার জন্যই সংক্ষিপ্ত বিচারব্যবস্থা। ক্যাঙ্গারু প্রাণীটি লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। ওই সময়ের সংক্ষিপ্ত বিচারব্যবস্থাও প্রচলিত নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে বিচারের রায় ঘোষণায় অভ্যস্ত ছিল। অনেকে মনে করেন, এ জন্যই এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এ শব্দটির অন্য একটি ব্যাখ্যাও রয়েছে। ক্যাঙ্গারুর পেটের ওপরে থলি দৃশ্যমান। এ থেকে মনে করা হয় যে বাদী না বিবাদীর পক্ষে কী রায় ঘোষণা করা হবে, তা আগে থেকেই নির্ধারিত। ক্যাঙ্গারু কোর্ট অন্য কারো পকেটে রয়েছে অর্থাৎ কোর্ট স্বাধীন ও নিরপেক্ষ রায় দিতে অক্ষম। এ ধরনের ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে যে কোর্ট বা আদালত প্রতিষ্ঠিত আইনকানুনের কোনো তোয়াক্কা না করে স্বেচ্ছাচারমূলক রায় ঘোষণা করেন, সেসব আদালতের জন্য এ শব্দটি যুক্তরাষ্ট্রে প্রাথমিকভাবে ব্যবহৃত হয়।
প্রশ্ন থেকে যায় যে ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে এ ধরনের আদালতের উৎপত্তি হলো কেন। জানা যায় যে ক্যালিফোর্নিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যখন সোনার খনির স্বত্ব নিয়ে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ শুরু হয়, তখন অনিয়মতান্ত্রিক আদালতের সৃষ্টি হয়। ওই সময় এসব আদালতের বিচারকর্তা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতেন। স্থানীয় প্রয়োজনেই আদালত ভ্রাম্যমাণ ছিল। জানা যায় যে ওই সব আদালতের বিচারকদের বেতন মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল ছিল। ক্ষেত্রবিশেষে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে যে জরিমানা আদায় হতো, সে অর্থ থেকেই বিচারকদের বেতন দেওয়া হতো। এ ব্যবস্থায় প্রচলিত নিয়মকানুন না মেনেই রায় ঘোষণার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। যেকোনো বিবাদী লেখক বা গবেষক এ শব্দই অবজ্ঞার সুরে এ ধরনের আদালত সম্পর্কে ব্যবহার করে থাকেন। তাঁদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বিচারকও রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট ১৯৬৭ সালে এক কিশোর অপরাধীর বিচার সম্পর্কে ক্যাঙ্গারু কোর্ট শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। এ রায়ে বলা হয়েছিল, কিশোরদের বিচারের ক্ষেত্রেও সাংবিধানিক নিয়মকানুন অবশ্যই থাকবে। যেকোনো মামলায় বিচারিক আদালত বা মামলা পরিচালনাকারী কৌঁসুলি প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুনের বিষয়টি বলে থাকেন ইংরেজিতে, যাকে বলা হয় Due process of law. উল্লিখিত রায়ে এমনই নীতি ঘোষণা করা হয়, কারণ কিশোর অপরাধীর বিচারে প্রতিষ্ঠিত নিয়ম অমান্য করা হয়েছে। উচ্চ আদালতের রায়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় যে কিশোর অপরাধীরাও প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুনে বিচার পাওয়ার অধিকারী। এ নিয়মের ব্যত্যয় করে ক্যাঙ্গারু কোর্টের মাধ্যমে বিচারের কোনো অবকাশ নেই। ১৯৫১ সালে এ ধরনের বিচারের অধিকতর ব্যাখ্যা এক রায়ে সহযোগী বিচারক দিয়েছিলেন। তিনি এ প্রসঙ্গে গ্রেপ্তারকৃত আসামিকে যে পুলিশ নির্যাতন করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় সে বিষয়টির অবতারণা করেন। এ ক্ষেত্রেও সহযোগী বিচারক ক্যাঙ্গারু কোর্ট শব্দটি ব্যবহার করেন। তাঁর ভাষায়, পুলিশি নির্যাতনের মাধ্যমে বিচার পক্ষপাতদুষ্ট করা হয়। জন্ম হয় ক্যাঙ্গারু কোর্টের।
ক্যাঙ্গারু কোর্ট
এর বিপরীতেও কিছু মতবাদ রয়েছে। এ মতের মূলকথা হলো ১৮০০ সালের প্রথমার্ধেই এ শব্দটি যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহার করা হয়। সে কারণে ক্যাঙ্গারু কোর্ট অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙ্গারুর সঙ্গে যে সাদৃশ্য, তা ওই সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে জানা ছিল। জানা যায় যে ১৮০০ সালের প্রথম দিকে স্যামুয়েল অ্যাডামস হ্যামেট নামধারী এক লেখক ছদ্মনাম ব্যবহার করে একটি সাময়িকী প্রকাশ করতেন। তাঁর একটি লেখায় বলা হয়, "সর্বসম্মতিক্রমে বিচারক 'জি'- নির্বাচিত হয়েছেন এবং এর ফলে মাস্টাং বা ক্যাঙ্গারু কোর্টের নিয়মিত বিচারিক কাজ শুরু হলো।" এ থেকে দাবি করা হয় যে ক্যাঙ্গারুর লাফিয়ে চলার সঙ্গে শব্দটির সাদৃশ্য আপাতদৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হলেও মাস্টাং কোর্টের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত হয়। ক্যাঙ্গারু কোর্টও একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। মাস্টাং একটি আমেরিকান বুনো ঘোড়া। আকারে ছোট।
ক্যাঙ্গারু কোর্ট শব্দটি যে সব সময় নিন্দা করার অর্থে ব্যবহৃত হয়, তা নয়। অনেকে খেলাধুলায় যে অনানুষ্ঠানিক বিচারের মাধ্যমে খেলোয়াড়দের তাৎক্ষণিক শাস্তি প্রদান করার প্রথা রয়েছে, তা কারো অজানা নয়। শাস্তির মাধ্যমে জরিমানাও আদায় করা হয়। বলা হয় যে আমেরিকান বেসবল লিগের খেলায় যে জরিমানা আদায় করা হয়, তা সাধারণত সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানকে দান করা হয়। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। জরিমানার অর্থ সংশ্লিষ্ট দলের আপ্যায়নের জন্যও ব্যয় করা হয়। বিষয়টি বিতর্কের উর্ধ্বে, কারণ এটি সবার জন্য সহনীয় প্রথা।
বাংলাদেশে অনিয়মতান্ত্রিক আদালতের বহু নজির সময় সময় মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত এসব ঘটনা জানার পর উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলেও এ ধরনের অদ্ভুত ও মধ্যযুগীয় বিচারব্যবস্থা বন্ধ হয়নি। ফতোয়া ও গ্রাম্য সালিস প্রথা এর মধ্যে অন্যতম। ফতোয়ার বিষয়ে অবশ্য উচ্চ আদালত বহু বছর আগেই এ প্রথা নিষিদ্ধ করার রায় দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও ফতোয়া ঘোষণা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়নি। কারণ এ ধরনের 'বিচারকদের' উপযুক্ত শাস্তি হয় না। এ ধরনের বিচারকে অবশ্য ক্যাঙ্গারু কোর্ট বলা হয় না। তবে ক্যাঙ্গারু কোর্ট শব্দটি অবশ্য ২০০৮ সালে সামরিক সাহায্যপুষ্ট কিছু বিশেষ আদালত সম্পর্কে একজন বিচারাধীন রাজনৈতিক ব্যক্তি বলেছিলেন। তিনি এসব আদালতকে ক্যাঙ্গারু কোর্ট হিসেবেই আখ্যা দিয়েছিলেন। বিষয়টি মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। ওই সব আদালত অনিয়মতান্ত্রিক না হলেও তাঁদের রায়ে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল, যার ফলে প্রায় সব অভিযুক্ত হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মাঝেমধ্যে নারী ধর্ষণের ঘটনায় অদ্ভুত ও অমানবিক বিচারের বিষয় মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। এসব বিচারে বিচারপ্রার্থীকে হয় বেত্রাঘাত অথবা জরিমানা করা হয়েছে। এ ধরনের ক্যাঙ্গারু কোর্টের বিচারে বিচারপ্রার্থী নারীরাই আক্রান্ত হয়, যা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।
গত ৮ সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠে গাজীপুরে এক মহিলা কাউন্সিলরের বিচারকে 'তুঘলকি' সালিস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এক বিধবা নারীর ২৯টি ছাগল নিয়ে যে খামার, সে খামারকে ঘিরেই সালিস করা হয়েছে। যে কাউন্সিলর সালিস করেন ওই মামলার বিবাদী তাঁর এক আত্মীয়। সালিসের রায়ে বিধবা নারীকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তাঁর অপরাধ দুটি। এক. ২৯টি ছাগলের মধ্যে কয়েকটি পুরুষ ছাগলও রয়েছে। দুই. বাড়িতে কোনো পুরুষ ব্যক্তি বাস করেন না। এ ছাড়া বাইরের লোকজনের ছাগলের প্রজনন বীজ দেওয়া হয়। বিবাদীর গর্ভবতী ছাগল জবাই করেও খেয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। এ ধরনের বিচার যে একেবারেই আইনসিদ্ধ নয়, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। যে বিষয়টি স্পষ্ট নয় তা হলো, এ বিচারকে সালিস কেন বলা হলো। কারণ গ্রাম পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ সীমিত আকারে বিচার করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত, তারও একটা নিয়মকানুন রয়েছে। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ক্যাঙ্গারু কোর্ট পরিচালনা করেন। গাইবান্ধায় এ ধরনের এক বিচারের বিষয় মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছিল। এরপর এক সংসদ সদস্যের বিষয়েও এ ধরনের কোর্ট পরিচালনা করা হয় বলে পত্রিকান্তরে জানা যায়, যা এখন বন্ধ করা হয়েছে। কারণ বিষয়টি নিয়ে মিডিয়া সোচ্চার ছিল।
উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের ইতিহাসে নিয়মিত আদালতেরও ক্যাঙ্গারু কোর্ট হওয়ার আশঙ্কার বিষয়টি রয়েছে। আলোচ্য ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে এর কিছু নজির উল্লেখ করা হয়েছে। এক. ১৮০০ সালে স্যামুয়েল অ্যাডামস জি নামধারী এক বিচারক নিয়োগের ফলে এ ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। দুই. ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের শিশু অপরাধীদের সম-অধিকার সম্পর্কে মন্তব্য। এ ধরনের নজির থেকে বোঝা যায় যে বিচারকদের নিয়োগ পক্ষপাতদুষ্ট হলেই ক্যাঙ্গারু কোর্টের আবির্ভাব হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। এ থেকে শিক্ষণীয় বিষয়টি হলো বিচারকদের নিয়োগের ব্যাপারে নিয়োগ কর্তৃপক্ষের সচেতনতা ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন