|
এ এম এম শওকত আলী
|
|
প্রশাসনের পেটভারী কাঠামো
31 Aug, 2014
মাথাভারী প্রশাসনের কথা মাঝেমধ্যে অতীতে শোনা গিয়েছিল। এর মানে প্রশাসনিক কাঠামোর শীর্ষ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের সংখ্যার আধিক্য। কয়েক বছর থেকে অন্য কথা শোনা যাচ্ছে। পেটভারী প্রশাসন। অর্থাৎ প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যম স্তরে কর্মকর্তাদের সংখ্যার আধিক্য। আমলাতান্ত্রিক কাঠামোতে একাধিক স্তরবিশিষ্ট পদের বিষয়টি স্বীকৃত। ইংরেজিতে বলা হয় hierarchy। অনেকটা সিঁড়ির মতো। ধাপে ধাপে উঠতে হয়। স্তর যত বেশি হবে, ততই হবে কার্যসম্পাদনে জটিলতা। কারণ যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে সব ধাপের কর্মকর্তার মতামত গ্রহণ অনেকটা বাধ্যতামূলক। গত কয়েক বছর একাধিকবার বিভিন্ন পত্রিকায় পেটভারী প্রশাসনিক কাঠামোর বিষয়টি প্রকাশ করা হয়েছে। গত ১৬ আগস্ট একটি বাংলা দৈনিকে হালনাগাদ পরিসংখ্যান উল্লেখ করে খবরের শিরোনামে বলা হয়েছে, 'নড়বড়ে হয়ে পড়েছে প্রশাসনের কাঠামো'। এর কারণ হিসেবে বলা হয় ঢালাও পদোন্নতি, মধ্যম স্তরে কর্মকর্তা বেশি। নিচে কম। বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা ৩১২ জন। অতীতে এবং বর্তমানেও বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডির বিষয়টি বহুল আলোচিত। এর ফলে সরকারের অহেতুক ব্যয় কত, তার কিছু তথ্য বহুল বিশ্লেষণও অতীতে প্রকাশ করা হয়। অহেতুক ব্যয়ের প্রধান বা একমাত্র কারণ এ ধরনের কর্মকর্তাদের মাসিক বেতনসহ অন্যান্য ভাতা ও আনুষঙ্গিক সুবিধা বিনাশ্রমে প্রদান করা। ওএসডির আধিক্যের বিষয়ে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রধানত দায়ী করা হয়। দলীয় আনুগত্যের বিষয়টি আমলে নিয়ে নির্বাচনের পরবর্তী পর্যায়ে এ ধরনের বিষয়টি দৃশ্যমান হয়। ক্ষমতাসীন দলের রদবদল হলেই সংশ্লিষ্ট দল 'আমাদের কর্মকর্তা' খুঁজতে শুরু করে। দলীয় আনুগত্যের বিষয়টি নিশ্চিত না হতে পারলে কর্মকর্তাদের ওএসডি করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৯৯১ পূর্ববর্তী সময়ে দলীয় আনুগত্যের বিষয়টি মুখ্য ছিল না। যে বিষয়টি মুখ্য ছিল তা হলো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সততা ও দক্ষতা। পরবর্তীকালে পদোন্নতিসহ পদায়নে দলীয় আনুগত্যের বিষয়টি প্রাধান্য লাভ করে।
গত ৭ আগস্ট সাত সচিবের পদোন্নতির জন্য সচিব-পরবর্তী পদগুলোতেও পদোন্নতির কথা শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব। এ ক্ষেত্রে বলে রাখা প্রয়োজন যে এ পর্যন্ত প্রশাসনিক কাঠামোর নড়বড়ের বিষয়টি মূলত সচিবালয় প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত। তবে মাঠ প্রশাসনেও যে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় সে প্রশ্নেরও অবতারণা করা হয়েছে। সার্বিকভাবে বলা হয়েছে, মাঠ প্রশাসনে প্রায় ৩০০ পদ শূন্য। ধারণা করা যায় যে এসবের শতভাগই হলো প্রশাসনিক ক্যাডারের। বলা যায়, এর ফলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা অত্যন্ত অপ্রতুল হবে। এর সঙ্গে যদি অন্যান্য ক্যাডারের শূন্য পদের সংখ্যা যোগ হয়, তাহলে মোট সংখ্যা কত হবে তা কখনো নির্ণয় করা হয়নি। সচিবালয় প্রশাসন কাঠামোর মধ্যম স্তরে কর্মকর্তাদের সংখ্যার আধিক্যের বিষয়ে কিছু তথ্য আলোচ্য দৈনিকে প্রকাশ করা হয়। সার্বিকভাবে বলা হয়েছে যে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পর্যায়ে নিয়মিত পদের সংখ্যা এক হাজার ৩৬৭ জন। এর বিপরীতে কর্মরত কর্মকর্তা রয়েছেন দুই হাজার ৪৮৭ জন। অর্থাৎ প্রায় দুই গুণ। জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব পর্যায়ে এক হাজার ৪৬০ পদের বিপরীতে শূন্য পদ রয়েছে ৪৫২টি। সহকারী সচিব পর্যায়ে পদের প্রয়োজন প্রায় ৩০০ জন। জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব পর্যায়ে পদোন্নতি হলে এ সংখ্যা আরো কম হবে।
প্রশাসনের পেটভারী কাঠামো
প্রকাশিত খবরে দেখা যায় যে অতিরিক্ত সচিবের নিয়মিত পদের সংখ্যা ১০৭। এর বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ২৭৩ জন। অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশি। সার্বিকভাবে সচিবালয় কাঠামোর মধ্যম স্তরে অর্থাৎ অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিবের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বা তার বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশাসনের প্রতিষ্ঠিত নিয়ম অনুযায়ী নিয়মিত পদের বিপরীতেই নিয়োগ বা পদোন্নতি দেওয়া হয়। এ নিয়ম এখন নির্বাসিত। কর্মরত কিছু কর্মকর্তার অনুভূতিও এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের মতে, মধ্যম স্তরে সংখ্যার আধিক্য ও নিচের স্তরে সংখ্যা কম হওয়ার কারণে প্রশাসনে এলোমেলো অবস্থা বিরাজমান। নিয়মিত পদ না থাকা সত্ত্বেও ঢালাও পদোন্নতির কারণে এসব কর্মকর্তা অতীতের নিম্ন পদেই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। উপসচিব পদে নিয়মিত পদ হলো ৮৩০ জন। এর বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন এক হাজার ২৯৫ জন। অর্থাৎ ৪৬৫ জন উপসচিব অনিয়মিত পদে সমাসীন। পদোন্নতি পেয়েও কাজ করতে হচ্ছে নিম্ন পদে। সচিবালয় কাঠামোর এমন অবস্থার জন্য কর্মকর্তাদের মধ্যে কাজ ভাগ করার বিষয়েও জটিলতা হয়। যে কাজ আগে একজন উপসচিবের জন্য ছিল, এখন হয়তো তা তিনজন সম্পাদন করছেন। এর ফলে কাজে সমন্বয়হীনতার বিষয়টিও দৃশ্যমান। সরকারি কার্যসম্পাদন বিধি অনুযায়ী কোনো মন্ত্রণালয়ের সচিব কর্মরত ব্যক্তিদের মধ্যে কর্মবণ্টন করবেন। সচিবালয় নির্দেশমালার বিধান ৭ অনুযায়ী (ক) কার্যবণ্টন প্রক্রিয়া সমতাভিত্তিক হবে, (খ) বিষয়গুলোর (পধংব) উপস্থাপন সমপর্যায়ের কর্মকর্তার মাধ্যমে হবে এবং (গ) সচিব ছাড়া অনধিক তিনটি ধাপের মধ্য দিয়ে সাধারণত বিষয়গুলো অতিক্রম করবে। মধ্যম স্তরে নিয়মিত পদের অতিরিক্ত কর্মকর্তার কারণে সচিবালয় নির্দেশমালার এসব নিয়ম সঠিকভাবে পালন করা হয় কি না সে বিষয়টি অনুসন্ধানযোগ্য। প্রকাশিত খবরে দেখা যায় যে উপসচিব পদে নিয়মিত পদের তুলনায় কর্মকর্তা বেশি। বলা হয়েছে, উপসচিব পর্যায়ে নিয়মিত পদের সংখ্যা ৮৩০ জন। এই পদে কর্মরত রয়েছেন এক হাজার ২৯৫ জন। অর্থাৎ ৪৬৫ জন বেশি। প্রশাসন বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ঢালাও পদোন্নতিই নড়বড়ে অবস্থার কারণ। নতুনভাবে পদোন্নতির উদ্যোগের বিষয়ে কিছু সমালোচনাও হচ্ছে।
উপজেলা প্রথা আশির দশকের প্রথমভাগে চালু হওয়ার পর যোগ্যতা ও বয়স শিথিল করে ৬৫০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। বলা হয়েছে যে তাঁরাই এখন উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব হচ্ছেন। বলা বাহুল্য যে বিশেষ প্রয়োজনে তাড়াহুড়া করে নিয়োগ দেওয়ার কারণে দক্ষতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বর্তমানে মধ্যম স্তরে সংখ্যা বৃদ্ধির এটাও একটা অন্যতম প্রধান কারণ। মোট তিনটি ব্যাচে নিয়োগপ্রাপ্ত এসব কর্মকর্তা আগামী তিন বছর পর অবসরে যাবেন। সে সময় পর্যন্ত এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা নেই। এ কথা অনস্বীকার্য যে সময়মতো পদোন্নতি না দিলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কর্মবিমুখ হয়ে পড়েন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষতম কর্মকর্তার মতে, বাস্তবতার আলোকেই এসব পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। এর পক্ষে অন্য একটি যুক্তি রয়েছে। তা হলো পদোন্নতির মাপকাঠির সব ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি না দিলে প্রশাসনে গতিশীলতা অর্জন সম্ভব নয়। তবে এর পাল্টা যুক্তি হিসেবে বলা যায় যে প্রশাসনে এসব পদক্ষেপ সত্ত্বেও গতিশীলতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। এর সঙ্গে এ কথাও বলা যায় যে ৩১২ ওএসডি রাখাও গতিশীলতা অর্জনের বিষয়টি ব্যাহত করে। এ শ্রেণিভুক্ত মোট সংখ্যা ৩১২ জন। সূত্র মতে, ১১ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে তাঁদের মধ্যে তিনজন সচিব, ৩৩ জন অতিরিক্ত সচিব, ১১৮ জন যুগ্ম সচিব, ৭৩ জন উপসচিব, জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব ৩৫ এবং সহকারী সচিব ৫০ জন। যেখানে মাঠ প্রশাসনে প্রায় ৩০০ পদ শূন্য, সেখানে অন্তত ৮৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া কষ্টকর নয়। কী কারণে এসব কনিষ্ঠ কর্মকর্তাকে ওএসডি ও কাজ না করেও বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়টিও বোধগম্য নয়। অন্যদিকে ৩৩ জন অতিরিক্ত সচিব ও ১১৮ জন উপসচিবই বা কেন বসে থাকবেন। বিশ্বের সব দেশে গ্রহণযোগ্য প্রশাসনিক কাঠামোকে ক্যারিয়ার পিরামিড বলা হয়। অর্থাৎ কাঠামোটি হবে পিরামিড আকারের। এ আকারে নিচের স্তর চওড়া, যা ক্রমেই ওপরের দিকে হ্রাস পায়। পিরামিডের ভিত থাকে প্রশস্ত। কারণ সম্পূর্ণ বোঝা নিচের স্তরকেই বহন করতে হয়। অর্থাৎ ভিত হবে মজবুত। বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো এ নিয়মের ব্যতিক্রম, যা কখনো মঙ্গলজনক হতে পারে না। সুস্থ ক্যারিয়ার পিরামিডে ওপরের দিকে ক্রমেই উচ্চ পদের সংখ্যা কমতে থাকে। এর কারণ পিরামিডের সর্বনিম্ন স্তরের কর্মকর্তারা সবাই উচ্চ পদে যাওয়ার সুযোগ পাবেন না।
এমন ব্যবস্থার বিপক্ষে যুক্তি দেখানো হয় যে দীর্ঘদিন একই পদে কাজ করলে এবং সময়মতো পদোন্নতি না হলে কর্মকর্তারা হতাশ বা নিরাশ হয়ে কর্মস্পৃহা বা উদ্যম হারিয়ে ফেলেন। তবে অধিকসংখ্যক মধ্যম পর্যায়ে পদ সৃষ্টি করাও প্রশাসনিক কাঠামো ব্যবস্থাপনার জন্য মঙ্গলজনক হবে না। সচিবালয় ছাড়াও যেকোনো দপ্তর, অধিদপ্তরের ক্যারিয়ার পিরামিডের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে যে ওপরের দিকে উচ্চ পদের সংখ্যা কম। সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন স্বায়ত্ত বা আধাস্বায়ত্তশাসিত সংস্থায়ও একই চিত্র দৃশ্যমান। সচিবালয়ের কাঠামোর চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। এ সমস্যা সমাধানের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। প্রয়োজন নেই অথচ পদ সৃষ্টি করতে হবে- এ নীতি কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আলোচ্য প্রতিবেদনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্রের উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে আগামী তিন বা চার বছর এ কাঠামোর অবস্থা অপরিবর্তিত থাকবে। কিন্তু এ সময়ের পরও অবস্থার কোনো উন্নতি হবে বলে মনে হয় না। কারণ যে অধিকসংখ্যক পদের প্রয়োজন মধ্যম স্তরে একবার দেওয়া হয়েছে তা অতি সহজে পাল্টানো যাবে না।
লেখক : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন