|
আহমদ রফিক
|
|
ভারতে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান ভাষিক জাতীয়তার ফেডারেশন
06 Mar, 2014
ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি এখন নৈরাজ্যিক চরিত্রের প্রকাশ ঘটিয়ে যথেষ্ট উত্তাপ ছড়িয়ে চলেছে। বিগত শতকের স্বাধীনতাসংগ্রামের পটভূমিতে আত্মপ্রত্যয়ী উপলব্ধি 'এক জাতি, এক প্রাণ একতা' বহুকাল আগেই হাওয়ায় উধাও। বহুভাষী, বহুজাতিক জনগোষ্ঠীর বিশাল আয়তনের দেশ পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়েও বহু জাতীয়তার কারণে, অন্তর্নিহিত সাম্প্রদায়িক চেতনার কারণে প্রকৃত অর্থে একক জাতিরাষ্ট্র গঠন করতে পারেনি।
দীর্ঘকালীন স্বাধীনতাসংগ্রামের ঐতিহ্য এবং স্বাধীনতার 'স্বাদ ও মৌতাত একক দল হিসেবে কংগ্রেসি শাসনের দৃঢ়ভিত্তিক বিস্তার ঘটাতে সাহায্য করেছিল। ভোটের বাক্সে জোড়া বলদে ছাপ্পা-মারার ক্ষেত্রে শিক্ষার অভাব ও শিক্ষার প্রভাবে কোনো ফারাক দেখা যায়নি। এ অবস্থা চলেছে কয়েক দশক ধরে। সেক্যুলার সংবিধান সত্ত্বেও রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনায় সাংবিধানিক বাস্তবতার প্রতিফলন সামান্যই ঘটেছে। বিচার বিভাগও এ জাতীয় দূষণ বা অনৈতিকতা থেকে মুক্ত নয়। নয় বলেই আদভানিদের অযোধ্যা-কাণ্ড ও নরেন্দ্র মোদির গুজরাট-কাণ্ডের সাম্প্রদায়িকতা উপযুক্ত বিচার পায়নি, এমনকি সীমাবদ্ধ মতামতের বাইরে এ সম্পর্কে ব্যাপক ধিক্কারও উচ্চারিত হতে শোনা গেল না। সে তুলনায় রিজওয়ানুল ঘটনা তো সাগরে বিন্দুবৎ। গান্ধী-নেহরুর অসাম্প্রদায়িক ভারতের স্বপ্ন এ তাবৎ স্বপ্নই থেকে গেছে।
আসলে একদিকে ভোটের জাদুকরী আকর্ষণ; অন্যদিকে সমাজচরিত্র বদলে উদাসীন অনীহা সমাজকে বিভাগপূর্ব কালের দূষিত ও বিষাক্ত ধারায়ই চলতে সাহায্য করেছে। সেই সঙ্গে কংগ্রেসের মতো প্রাচীন দলে আধুনিক চেতনার ঘষামাজার অভাব সনাতনত্বের শ্যাওলা আরো ঘনীভূত হতে সাহায্য করেছে। তা না হলে রাজীব গান্ধীর মতো আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ কিভাবে উচ্চ আদালতের স্থিতাবস্থার রায় অগ্রাহ্য করে অযোধ্যায় রাম মন্দিরের শিলান্যাস করেন এবং তা নিছক ভোটবাক্সের চিন্তা মাথায় রেখে।
ভোটের জাদুর এমনই মহিমা যে সে রাজনীতি ও সমাজে নির্বিবাদে সাম্প্রদায়িক চেতনার হাল চালাতে পারে। সেখানে অনায়াসে হাল ধরতে পারেন 'মি. ক্লিন' নামে পরিচিত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী বা বিদগ্ধ মননশীল প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও, যাঁর খ্যাতি সাহিত্য অঙ্গনেও। রাজনীতি তথা ক্ষমতার টানে সব রকম মননশীলতা বা বৈদগ্ধ হার মানে। ভারতীয় রাজনীতিতে এ জাতীয় ঘটনার সংখ্যা কম নয়।
ভারতে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান ভাষিক জাতীয়তার ফেডারেশন
পাকিস্তানের কথা বাদ দিই। কারণ তার জন্মই তো দ্বিজাতিতত্ত্বের সাম্প্রদায়িক স্লোগান ও সহিংসতায় ভর করে। কিন্তু ভারত? পৃথিবীর অন্যতম প্রধান গণতন্ত্রী দেশের পরিচিতি গায়ে জড়িয়েও সাম্প্রদায়িকতার দূষণ থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। সেই সঙ্গে ব্যাপক দুর্নীতিসহ অগণতান্ত্রিক শাসন দেশটিকে কথিত গণতন্ত্রের বন্ধ্যাভূমিতে পরিণত করেছে।
আর সে সুযোগে এবং আধুনিকতা নামের প্রদীপের নিচে অশিক্ষা-কুসংস্কার ও সনাতনী ভাবনার রূপক অন্ধকার ক্রমে জমাট বেঁধেছে, প্রসারিত হয়েছে। আধুনিক ভারতের সমাজ পরিশীলিত আধুনিকতায় পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠতে পারেনি বলে নতুন করে সাম্প্রদায়িকতার 'হিন্দুস্থানি' স্লোগান জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতে পেরেছে। বিজেপির মতো কট্টর সাম্প্রদায়িক শক্তি রাজনীতির বিশালায়তন ছাতা মেলে ধরে দেশ শাসনের রাজ্যপাট গুছিয়ে নিতে পেরেছে। পেরেছে অন্তর্দ্বন্দ্বে বিভাজিত কংগ্রেসকে কোণঠাসা করে এবং সেখানে ভারতীয় পুঁজিবাদের সনাতনী প্রভাব কার্যকর শক্তি হিসেবে দেখা দিতে। ইতিহাস পাঠকের মনে থাকার কথা যে পরাধীন তথা ঔপনিবেশিক ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পালায় লীগ-কংগ্রেস দ্বন্দ্বে দেশ বিভাগের যে পাঁয়তারা তার পেছনে বড়সড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল ভারতীয় পুঁজিপতিদের ধর্মভিত্তিক দ্বিভাজিত শক্তির স্বার্থ। সেই স্বার্থের অমুসলিম বনাম মুসলিম পুঁজির দ্বন্দ্ব রাজনীতিতে তথা কংগ্রেস ও লীগের স্বার্থে জ্বালানি যোগ করেছিল। উদ্দেশ্য, ভারত ভাগ করে বিভাজিত ভূখণ্ডে প্রতিযোগিতাহীন অর্থনৈতিক স্বার্থবিস্তার।
ধর্মীয় ভিত্তিতে দেশ বিভাগ সে কাজটি খুব ভালোভাবেই সম্পন্ন করতে পেরেছিল যেমন ভারত ডোমিনিয়নে, তেমনই পাকিস্তান ডোমিনিয়নে। স্বার্থান্ধ পুঁজিপতি শ্রেণী ও তাদের প্রতিনিধি লীগ-কংগ্রেস তাদের শ্রেণী শাসন ও সম্প্রদায়বাদী শাসন জোরালোভাবে কায়েম করে চৈতন্যের মাটিতে দূষিত চরিত্রের শিকড়বাকড়ের শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটাতে পেরেছিল।
এর পরিণামে শুদ্ধ গণতান্ত্রিক চেতনা, শুদ্ধ সেক্যুলার চেতনার ক্ষেত্রে দুর্বল ভারত। একা নেহরুর সাধ্য ছিল না, হয়তো বা ইচ্ছাও ছিল না প্রকৃত সেক্যুলার চেতনার ভারতীয় রাষ্ট্র গড়ে তোলার। তাই ১৯৪৭ সালের আগস্ট থেকে ১৯৭৭ সালতক টানা তিন দশকের শাসন সত্ত্বেও কংগ্রেস তার ঘোষিত নীতির চরিত্রগত বাস্তবায়ন সম্পন্ন করতে পারেনি। সেক্যুলার সুশাসনের মাধ্যমে সমাজে অসাম্প্রদায়িকতার শুদ্ধ বিকাশ ঘটাতে পারেনি। বরং বলব, তেমন চেষ্টা তাদের ছিল না। ক্ষমতার দখল এবং তা যেকোনো মূল্যে ধরে রাখাই ছিল তখন কংগ্রেস রাজনীতির একমাত্র উদ্দেশ্য।
তবু এর মধ্যে আন্তর্জাতিক চেতনার প্রভাবে ও পূর্ববর্তী ঐতিহ্য ধারায় ভারতীয় রাজনীতিতে যে বাম ঘরানার প্রকাশ, তার সূচনা সর্বভারতীয় কেন্দ্রীয় ভিত্তির বদলে আঞ্চলিক ভিত্তিতে, আঞ্চলিক শক্তির প্রকাশ ঘটিয়ে, মূলত প্রথম দক্ষিণ ভারতের কেরালায়। কে বলতে পারে সেখানে আদি পর্যায়ের আর্যাবত বনাম দাক্ষিণাত্য চেতনার দ্বন্দ্ব কোনো প্রভাব রেখেছে কি না। রাখুক বা না রাখুক, এ কথা সত্য যে বিভাগপূর্ব ও বিভাগকালীন কংগ্রেস রাজনীতিতে শক্তিশালী কেন্দ্র বনাম দুর্বল প্রদেশ তথা রাজ্য নিয়ে যে জবরদস্তির প্রকাশ, সে ঐহিত্য দীর্ঘ সময় ধরে রাখতে পেরেছে কংগ্রেস শাসন। এমনকি বিজেপিও শক্তিশালী কেন্দ্রের পথ ধরেই চলেছে।
তাই সর্ব উত্তর-পূর্ব সীমান্তে আসামের ভাষিক জাতিসত্তা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বিভাগপূর্ব ঐতিহ্য নিয়ে ক্রমে শক্তিমান হয়ে একপর্যায়ে সহিংসতারও প্রকাশ ঘটিয়েছে। অন্যদিকে গোটা দক্ষিণ ভারতে তামিল-তেলেগু-মালয়ালামভাষী জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিশ্চিত করতে তারা মূলত সংসদীয় রাজনীতিরই পথ ধরেছে। তা সত্ত্বেও কেরালার বাম রাজনীতিকে অন্যায় চাতুর্যে পর্যুদস্ত করে কংগ্রেস; যদিও তা পারেনি পূর্ব সীমান্তের প্রান্তিক রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায়। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ বাম জামানার অবসান ঘটেছে তাদেরই অদূরদর্শী ভুল-ভ্রান্তিতে। অন্ততপক্ষে নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর তার প্রমাণ। ত্রিপুরা অবশ্য তাদের বাম ঘাঁটি এখনো ধরে রেখেছে।
কেন্দ্রে বাম শক্তির পিছিয়ে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ মূল বাম শক্তির বহুমুখী বিভাজন। এমনকি দায়ী একসময় কংগ্রেসের প্রতি সিপিআইয়ের বিভ্রান্তিকর সমর্থন, যা কংগ্রেসকে নতুন করে শক্তিমান হতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু নানা অনৈতিকতায় কীটদষ্ট রাজনীতির টানে কংগ্রেসের ক্রমাগত বেহাল দশা ও কেন্দ্রে বাম রাজনীতির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের নানামুখী তৎপরতা ভারতীয় রাজনীতিতে সম্প্রদায়বাদী শক্তি তথা বিজেপির উত্থান নিশ্চিত করে। সেই সঙ্গে বাম রাজনীতির আত্মঘাতী বিভাজন ও নীতিগত ভুল-ভ্রান্তিও এ জন্য কম দায়ী নয়। তা ছাড়া ধর্মবাদী দলগুলোর কমিউনিস্ট বিরোধিতা তো আছেই।
ভারতীয় রাজনীতিতে আঞ্চলিক শক্তির বিকাশও কেন্দ্রে বাম শক্তির বিকাশে এক ধরনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক দুর্যোগ ও অর্থহীন সাংগঠনিক বিভাজন ভারতে বাম শক্তির কেন্দ্রীয় ক্ষমতা দখলে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রদায়িক শক্তির বিকাশ তো গণতন্ত্রীদের জন্যও সমস্যা ও সংকট তৈরি করেছে। তাই এমন এক ঘোলা জলে সাম্প্রদায়িক গণহত্যার গুজরাটি নায়ক বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদির জন্য দিল্লির মসনদ দখল প্রায় নিশ্চিত সম্ভাবনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বহুভাষিক জাতিসত্তা অধ্যুষিত ভারতের জন্য সঠিক গণতান্ত্রিক সমাধান একমাত্র বহুভাষিক জাতিরাজ্যের ফেডারেশন গঠনের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হতে পারে। সে সম্ভাবনা বিভাগপূর্ব চল্লিশের দশকে ক্বচিৎ দেখা দিয়ে রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার টানে মিলিয়ে যায়। এর জন্য তখনকার দুই প্রধান রাজনৈতিক দল লীগ-কংগ্রেস, এমনকি কমিউনিস্ট পার্টিও দায়ী। কমিউনিস্ট রাজনীতির ধীমানরা এই লেনিনীয় তত্ত্ব নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাননি। এ জাতীয় ফেডারেশন গঠন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ভয়াবহতা থেকেও অখণ্ড ভারতকে রক্ষা করতে পারত।
ভারতীয় রাজনীতির দুর্ভাগ্য যে বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার অভাব তাকে বরাবর তাড়িত করে সমস্যার জন্ম দিয়েছে। সে তাড়না থেকে ছয় দশক পরও তার মুক্তি ঘটেনি। এমনকি তেমন সম্ভাবনাও দূর অস্ত। তেলেঙ্গানা রাজ্য নিয়ে পরস্পর বিরোধিতাও তেমন আভাসই দেয়। ভারত সত্যই এখন এক রাজনৈতিক সমস্যার খাদের কিনারায় দাঁড়ানো। উদ্ধারের পথ একটিই এবং তা ভাষিক জাতিসত্তাভিত্তিক ফেডারেশন, যা একই সঙ্গে আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে রুখতে পারে। এ পথে ভারতীয় রাষ্ট্রনীতির ক্যান্সার হিসেবে বিবেচিত কাশ্মীর সমস্যার সমাধানও সম্ভব। কিন্তু রাজনীতি ও রাজশক্তির একদেশদর্শী রক্ষণশীলতা সহজে ওই সম্ভাবনার পথে পা বাড়াবে বলে মনে হয় না। ফলে সেক্যুলার ভারতে আরো রক্ত ঝরবে, সমস্যা তৈরি হবে, গণতন্ত্রী ভারত সম্প্রদায়বাদী পরিচিতি পাবে, এই যা।
লেখক : গবেষক ও ভাষাসৈনিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন