কোনো পদক্ষেপেই ডলার সংকট কাটছে না, বরং সংকট আরও গভীর হচ্ছে। সরকার ডলার বাঁচাতে বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করছে কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। সংকট এখন এতটাই বেড়েছে যে আগামী রোজার জন্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো ডলার সংকটের কারণে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে এলসি খুলতে পারছে না। আবার ডলার সংকটের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ এসে ভিড়লেও সেগুলো খালাস করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আগামী রোজায় একদিকে যেমন পণ্য সংকট দেখা যাবে অন্যদিকে দামও অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা।
অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে এখন দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২৪৭ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। গত বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৫২০ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সেই তুলনায় রিজার্ভ কমেছে ১ হাজার ২৭২ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। সদ্য বিদায়ি বছরের জুন মাস শেষে রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ১৮২ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। বছর শেষে ডিসেম্বরে এর পরিমাণ আরও কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩৭৪ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। সেই হিসেবে চলতি মাসের ১৮ দিনে বৈদেশিক মুদ্রা ডলার কমেছে ১২৬ কোটি ৮১ লাখ।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মানদ- অনুযায়ী, বর্তমান রিজার্ভ থেকে আরও ৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার বাদ যাবে। এতে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দাঁড়াবে ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। সংস্থাটির মানদ- অনুসারে, দেশের মজুদকৃত রিজার্ভ থেকে রফতানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ঋণ এবং রিজার্ভ থেকে দেশীয় প্রকল্পে অর্থায়নের ব্যয় বাদ যাবে। তবে সরকার এখন আইএমএফ এবং নিজস্ব অর্থাৎ দুই ধরনের হিসাবই রাখছে।
এর আগে ২০২১ সালের আগস্টে প্রথমবারের মতো দেশের ইতিহাসে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল। আর ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করেছিল। করোনার প্রভাব ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির প্রভাব পড়তে থাকে দেশের অর্থনীতিতে। ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করতে থাকে। ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আইএমএফের মতে, রিজার্ভ হতে হবে রিজার্ভ, যেকোনো সময় ব্যবহারযোগ্য। বাংলাদেশের এই রিজার্ভের হিসাবে এখনও স্বর্ণ, বন্ড, ফেডারেল রিজার্ভে রক্ষিত ডলারও আছে, যা যেকোনো সময় ইচ্ছা করলেই বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবহার করতে পারবে না। তাই এখনও আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী রিজার্ভ দেখানো শুরু হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েক দিন ধরে তাই স্বর্ণ বিক্রিও শুরু করেছে। আইএমএফ রফতানি উন্নয়ন তহবিল ছোট করতে বলেছে, যার কোনো কিছু এখনও দেখা যাচ্ছে না বলে মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সময়ের আলোকে বলেন, আগামী ছয় মাসের মধ্যেও দেশে ডলার সংকট দূর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখি না। এই সংকট কাটাতে অবশ্যই রফতানি বাড়াতে হবে। রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমাতে হবে। ডলারের দাম বেঁধে দিয়ে সাময়িকভাবে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু এটা সমাধান নয়। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। ব্যাংকে রাখা টাকার পরিমাণ (মান) প্রকৃত বিবেচনায় কমে যাচ্ছে। আবার আমাদের অনেক অদৃশ্য পেমেন্ট আছে। ১৫-১৭ মিলিয়ন ডলার শর্ট-টার্ম পেমেন্ট আছে প্রাইভেট সেক্টরে প্রতি মাসে।
রিজার্ভ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন রকম উদ্যোগ নিলেও দিন দিন রিজার্ভের পরিমাণ কমছেই। আর বাজারে ডলারের সংকট এখনও কাটেনি। ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের দামে অস্বাভাবিক ব্যবধান আছে। ফলে বিদেশ ভ্রমণে যেতে অনেকে এখন ডলারের বিপরীতে গন্তব্য দেশের মুদ্রা এন্ডোর্স করছেন। এ ছাড়া অনেকে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ডলার মজুদ করে রাখছেন। এটিও বাজারে ডলার সংকটের কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, সরকারকে হুন্ডি ঠেকাতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে মেরুদ- শক্ত করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অতি ধনী লোকরাও যেন ঘন ঘন বিদেশে না যেতে পারে সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অন্যদিকে রিজার্ভ ধরে রাখতে অতি প্রয়োজনীয় পণ্য বাদে বিলাসবহুল পণ্য আমদানি বন্ধসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার। রফতানি বাড়ানো এবং প্রবাসীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোসহ বেশ কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো উদ্যোগেই ডলার সংকট কাটছে না, বাড়ছে না রিজার্ভ।
এ ছাড়া ডলার সংকটের কারণে এখন সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হচ্ছে আগামী রোজার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে। ডলারের অপ্রতুলতার কারণে নিত্যপণ্য আমদানি বিল পরিশোধ বিলম্ব ও এলসি খোলার জটিলতা দেখা দিয়েছে। এতে গত তিন মাস (অক্টোবর-ডিসেম্বর) এলসি খোলার হারও কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) অপরিশোধিত চিনির ঋণপত্র খোলার পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে ২৮ শতাংশ কমেছে। এ ছাড়া অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের ৪৭ শতাংশ, সয়াবিন বীজ ৮৩ শতাংশ, অপরিশোধিত পাম তেল ৯৯ শতাংশ, ছোলা ৪৭ শতাংশ ও খেজুর আমদানির ঋণপত্র খোলা কমেছে ৩০ শতাংশ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে রোজায় বাজার স্বাভাবিক রাখতে চলতি জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৭ লাখ মেট্রিকটন ভোজ্য তেল, ৬ লাখ মেট্রিকটন চিনি, ২ লাখ মেট্রিকটন মসুর ডাল, ৬ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজ, ১ লাখ মেট্রিকটন ছোলা ও ৭৫ হাজার মেট্রিকটন খেজুর আমদানি করতে হবে। আর এসব পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ব্যয় হবে ১৩৮ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ভোজ্য তেল আমদানিতে সম্ভাব্য ডলার প্রয়োজন ৭৭ কোটি মার্কিন ডলার। বর্তমান বিশ^বাজারে এক মেট্রিকটন সয়াবিনের মূল্য ১ হাজার ২১৭ মার্কিন ডলার এবং পাম অয়েল ৯৮০ ডলার। যেহেতু দেশে সয়াবিন ও পাম উভয় ধরনের ভোজ্য তেল আমদানি হয়, সে হিসাবে ভোজ্য তেল আমদানির গড় মূল্য ধরা হয় প্রতি টন ১ হাজার ৯৯ ডলার। একইভাবে চিনিতে ২৭ কোটি, মসুর ডালে ১০ কোটি, পেঁয়াজে ১২ কোটি, ছোলায় ৭ কোটি এবং খেজুর আমদানিতে প্রয়োজন ৫ কোটি মার্কিন ডলার। শুধু রোজার এক মাসের জন্য প্রয়োজন হয় ভোজ্য তেল ৩ লাখ, চিনি ৩ লাখ, পেঁয়াজ ৪ লাখ, মসুর ডাল ১ লাখ, ছোলা ১ লাখ এবং খেজুর ৫০ হাজার মেট্রিকটন।
চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, বন্দরে তিনটি জাহাজের পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে একটির নাম ‘এমটি সুপার ফরটি’। জাহাজটি মালয়েশিয়া থেকে প্রায় ১২ হাজার টন পাম তেল নিয়ে গত ২৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছায়। ১ কোটি ২৪ লাখ ডলার মূল্যের এই তেল আমদানি করেছে চট্টগ্রামের এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেড। জাহাজ আসার পর ৫৪ দিন পেরিয়ে গেলেও তারা পণ্য খালাস করতে পারেনি।
জানা গেছে, জাহাজটি থেকে যত দিন পণ্য খালাস হবে না, তত দিন জরিমানা দিতে হবে আমদানিকারককে। প্রতিদিনের জরিমানার পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার ডলার, যা ৫৪ দিনে দাঁড়ায় ৮ লাখ ৬৪ হাজার ডলারে (প্রায় সোয়া ৯ কোটি টাকা)। ব্রাজিল থেকে ৬০ হাজার ৫০০ টন চিনি নিয়ে ‘এমভি কমন এটলাস’ নামের একটি জাহাজ বন্দরে পৌঁছায় ৫ জানুয়ারি। সূত্র জানিয়েছে, জাহাজটি থেকে ২৩ হাজার ৬৫০ টন চিনি খালাস হয়েছিল। তবে ১১ জানুয়ারি থেকে খালাস স্থগিত করে দেয় রফতানিকারক। কারণ বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ডলার সংকটে ঋণপত্রের বিপরীতে আমদানি দায় পুরোপুরি পরিশোধ করতে পারেনি। গত সোমবার ২০০ মিটার লম্বা জাহাজটি বন্দরের জেটিতে ভেড়ানো হয়। এর মাধ্যমে বন্দরে বড় জাহাজ ভেড়ানোর কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু উদ্বোধনের পর পণ্য খালাস না করে বিকালে জাহাজটি বহির্নোঙরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই জাহাজের বিপরীতেও প্রতিদিন ৪০ হাজার ডলার জরিমানা দিতে হবে আমদানিকারককে।
১১ জানুয়ারি থেকে খালাস বন্ধ থাকার হিসাবে সাত দিনে জরিমানা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার ডলার (প্রায় তিন কোটি টাকা)। এসবই হচ্ছে ডলার সংকটের কারণে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার গত নভেম্বরে বলেছিলেন, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে (চলতি মাস) ডলার সংকট অনেকটাই কমে যাবে। রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। এর আগে গত ৩০ অক্টোবর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ও নির্বাহী পরিচালকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় গভর্নর বলেছিলেন, আগামী জানুয়ারি শুরু থেকে ডলার সংকট কমে আসবে। ডলার সংকটের কারণে আমদানি তদারকি জোরদার করা হয়েছে। ফলে ঋণপত্র খোলার পরিমাণ কমেছে। ডলার বাজার পরিস্থিতি নিয়ে ওই সভায় বলা হয়, ৩০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের আমদানি ঋণপত্র তদারকি করা হচ্ছে। এতে ঋণপত্র খোলার পরিমাণ কমে গেছে। ফলে সামনের দিনে সংকট কেটে যাবে। বাস্তবতা হচ্ছে-সেই জানুয়ারি মাস এখন চলছে। অথচ ডলার সংকট না কমে উল্টো আরও বেড়েছে।
ডলার সংকটের বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, অনিশ্চয়তার কারণে টাকার পরিবর্তে অনেকেই এখন ডলার হাতে রাখেন। আইন যতই করেন, কাদের হাতে নগদ ডলার আছে, তা তো আগে জানতে হবে। আর দেশের বাইরে ডলার পাচার হচ্ছে। কেন পাচার হচ্ছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ঋণ তো শোধ করতে হচ্ছে। লোন রি-পেমেন্ট তো এক জায়গা থেকে হয় না। সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট আছে। গভর্নমেন্টের ক্রেডিট আছে। বছরে সরকারকেই তো দুই-তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয়। অফশোর ব্যাংকিংয়ের ডেবিট, ক্রেডিট আছে। এটা অনেক বৃহৎ পরিসরে দেখলে রিজার্ভের ওপর চাপ ও ডলার সংকটের বিষয়টি বোঝা যাবে। শুধু আমদানি-রফতানি আর রেমিট্যান্স দিয়ে বাস্তব অবস্থা বোঝা যাবে না। এ জন্যই ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা আসছে না এবং সংকট কাটছে না।