জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপি যেই যুক্তি দিচ্ছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রশ্নে ঠিক উল্টো যুক্তি দিচ্ছে তাদের সহযোগী ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।
বিএনপি বলছে, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেটুকু সংস্কার প্রয়োজন অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত সেটুকু করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া। এ বিষয়ে প্রকাশ্যে তারা জুলাই–আগস্টের কথা বললেও আগামী ডিসেম্বরকে সময়সীমা ধরে এগোচ্ছে। তাদের দাবি অযৌক্তিক নয়।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গত বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচন সম্পর্কে বলেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলো অল্প সংস্কার চাইলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। আর তারা ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার চাইলে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি নির্বাচন হতে পারে।
জামায়াতে ইসলামীসহ কিছু দল সংস্কারের জন্য সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে চাইলেও বিএনপি নির্বাচন বিলম্বিত করতে রাজি নয়। তাদের যুক্তি হলো বর্তমান সরকারের মূল দায়িত্ব একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। সব সংস্কারকাজ তারা করলে নির্বাচিত সরকার এসে কী করবে?
এই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়টিও সামনে এসেছে। ডাকসু, জাকসুসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে একদিকে ছাত্রদল, অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রশিবির মুখোমুখি অবস্থানে। যদিও ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানকে সফল করতে এসব সংগঠন একযোগেই কাজ করেছে।
আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে যে ৯ দফা দাবি ঘোষণা করা হয়, তাতে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ও ছাত্র সংসদ চালু করার কথা বলা হয়েছিল। এ বিষয়ে ছাত্রদলসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের আপত্তি ছিল। তবে আন্দোলনের স্বার্থে সে সময়ে কেউ উচ্চবাচ্য করেনি।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ছাত্রদলসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন এ বিষয়ে সোচ্চার হয় এবং ক্যাম্পাসে নানা কর্মসূচি পালন করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা প্রথমে আপত্তি করলেও পরে রাজনৈতিক দলের সহযোগী ছাত্রসংগঠনগুলোকে মেনে নেয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জানিয়েছিলেন ফেব্রুয়ারির মধ্যেই ডাকসু নির্বাচন হবে। গত ৪ ডিসেম্বর রাতে ঢাকার বাংলামোটরে নিজেদের কার্যালয়ে ৩০টি ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে তারা। সভা শেষে সংগঠনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ডাকসুসহ সারা দেশে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে সভায় ঐকমত্য হয়েছে।’ ওই সভায় শিবির অংশ নিলেও ছাত্রদল ও বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো অংশ নেয়নি। পরদিন ছাত্রদল ও বামপন্থী ছাত্রসংগঠনসহ মোট ২৮টি ছাত্রসংগঠন আলাদা বৈঠক করে নির্বাচনের আগে ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কারের দাবি জানিয়েছে।
প্রশ্ন হলো, নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি ও ছাত্রদলের বিপরীতমুখী অবস্থান কেন? ছাত্রদল কেন সংস্কারের নামে নির্বাচন পেছাতে চাইছে। তারা যেসব সংস্কার চাইছে সেগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরুক। তারা যদি সেটি সমর্থন করে, তাদের পক্ষেই রায় যাবে। সে ক্ষেত্রে ছাত্রদলের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু আগে সংস্কার তারপর নির্বাচন এই বাহানায় যদি ছাত্র সংসদ নির্বাচন আটকে যায়, সেই দায়িত্ব ছাত্রদলকে নিতে হবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনের ভাষা পড়ুন। তারপর রাজনৈতিক অবস্থান ঠিক করুন।
তাদের অভিযোগ, তড়িঘড়ি করে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে কিছু ‘ফেস’ (মুখ) তৈরি করতে চাইছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই মুখগুলোর মাধ্যমে তারা জাতীয় রাজনীতিতে অবস্থান তৈরি করতে চায়। এর অর্থ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছাত্র সংসদ নির্বাচন করে জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্র তৈরি করতে চাইছে। আর ছাত্র দল বিএনপির শক্তিকে পুঁজি করে এগোতে চাইছে।
ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধনে কমিটি গঠন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সাত সদস্যের এই কমিটি গঠন করা হয় গত ২৫ ডিসেম্বর। তারা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের কাছে সংস্কার প্রস্তাব চেয়েছে। ডাকসু নির্বাচনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক্যালেন্ডার ইভেন্ট’ (বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে) হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি গঠনতন্ত্রে যুক্ত করা, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বয়সসীমা নতুনভাবে নির্ধারণ (বর্তমানে প্রার্থীদের সর্বোচ্চ বয়স ৩০ বছর রয়েছে) করে দেওয়া এবং বিভিন্ন সম্পাদকীয় পদের নাম পরিবর্তনের বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছে কয়েকটি ছাত্রসংগঠন।
ছাত্রদলের পক্ষ থেকে নির্বাচনে প্রার্থীদের বয়সসীমা সুনির্দিষ্টভাবে ৩০ বছর না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ‘ভোটার ও প্রার্থী’ হওয়া; ডাকসুর সভাপতি পদে শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত করা; নারী শিক্ষার্থীদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণে নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীদের জন্য মোট দুটি সহসভাপতি এবং দুটি সহসাধারণ সম্পাদক পদে আলাদা নির্বাচনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ, ১৯৭৩ অনুযায়ী, ডাকসু থেকে মনোনীত পাঁচজন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। তবে ২০১৯ সালের পর আর নির্বাচন না হওয়ায় এখন সিনেটে শিক্ষার্থীদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। সিনেটের সদস্য ১০৫ জন।
২০১৯ সালের আগে ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০ সালে। মাঝখানে দীর্ঘ ২৮ বছর ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচন হয়নি মূলত রাজনৈতিক সরকারগুলোর অসহযোগিতার কারণে। বর্তমানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ডাকসু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করে ছাত্রসংগঠনগুলো।
২০১৯ সালে ডাকসু ও হল সংসদের সর্বশেষ নির্বাচন হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনের মতোই ডাকসুর সেই নির্বাচনও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ভোটে নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। নির্বাচনে ভিপি পদে জয়ী হন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্রার্থী নুরুল হক। তিনি এখন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি। তাঁর প্যানেল থেকে সমাজসেবা সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন আখতার হোসেন। তিনি এখন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব। ডাকসুতে ভিপি (সহসভাপতি) ও জিএসসহ (সাধারণ সম্পাদক) মোট পদ ২৫টি। ডাকসুর গত নির্বাচনে ভিপি ও সমাজসেবা সম্পাদকের বাইরে বাকি ২৩টি পদে জয়ী হয় তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ (এখন নিষিদ্ধ ছাত্রসংগঠন)।
কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামীর অনুসারী ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদে ১৯৯০ সালে শিবির ও ছাত্রসমাজকে ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে না দেওয়ার বিষয়ে মতৈক্য হয়েছিল। ৫ আগস্টের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা প্রকাশ্যে তৎপরতা চালাচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগরে শিবির বাধার মুখোমুখি হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে রকম পরিস্থিতি হয়নি। ইতিমধ্যে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি ঘোষণা করেছে। আরও মজার বিষয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির যে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে, তার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুজনই ছাত্রলীগের ব্যানারে কাজ করেছেন আওয়ামী লীগ আমলে। তাদের দাবি, আন্দোলন সফল করতে ছদ্মবেশেই তাদের কাজ করতে হয়েছে।
সমস্যা হলো আওয়ামী লীগ আমলে ছাত্রশিবির অপ্রকাশ্যে থাকলেও তাদের রাজনৈতিক সমর্থন ছাত্রদলের পক্ষে ছিল। ছাত্রলীগ ছিল উভয়ের প্রতিপক্ষ। কিন্তু ৫ আগস্টের পর ছাত্রলীগকে সরকার নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করার পর ছাত্রলীগমুক্ত ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরই এখন ছাত্রদলের প্রধান প্রতিপক্ষ। অন্যদিকে তাদের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যুক্ত হলে ছাত্রদলকে এককভাবে দুই শক্তিকে মোকাবিলা কঠিন হবে। এ কারণেই ছাত্রদল আরও সংগঠিত হয়ে নির্বাচন করার পক্ষপাতী। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসংগঠন মনে করে, যত দ্রুত নির্বাচন হবে ফলাফল তাদের পক্ষে আনা সম্ভব হবে। শিবিরের সমর্থন থাকলে তো কথাই নেই।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রদলকে এই দুই সংগঠনকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের তফসিল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে ছাত্রদল ও অন্যান্য ছাত্রসংগঠন। এদিকে রোডম্যাপ অনুযায়ী তফসিল ঘোষণার কথা থাকলেও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা পিছিয়ে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের রোডম্যাপ অনুযায়ী ১ ফেব্রুয়ারিতে তফসিল ঘোষণা করার কথা ছিল। তবে তফসিল ঘোষণার পূর্বে ‘সংস্কার কমিটি’ গঠন করে গঠনতন্ত্র সংস্কার, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলার বিচার, সিন্ডিকেট পুনর্গঠনসহ ৫ দফা দাবিতে উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দেয় শাখা ছাত্রদল।
অন্যদিকে জাকসুর রোডম্যাপ ঘোষণা হওয়ার পর সংস্কারের প্রস্তাব তুলে ছাত্রদল জাকসু বানচালের চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেছে ‘জাকসুর পক্ষে জাহাঙ্গীরনগর’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম৷ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কামরুল আহসান প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে রোডম্যাপ ঘোষণার কথা বলেছিলেন। তখন মনে হয়েছিল জাহাঙঙ্গীরনগরে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আর কোনো বাধা নেই। এখন মনে হচ্ছে সহজে নির্বাচনী জট খুলছে না। ছাত্রদলের অমতে প্রশাসনের পক্ষে তফসিল দেওয়া সম্ভব হবে না বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রশ্ন হলো, নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি ও ছাত্রদলের বিপরীতমুখী অবস্থান কেন? ছাত্রদল কেন সংস্কারের নামে নির্বাচন পেছাতে চাইছে। তারা যেসব সংস্কার চাইছে সেগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরুক। তারা যদি সেটি সমর্থন করে, তাদের পক্ষেই রায় যাবে। সে ক্ষেত্রে ছাত্রদলের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু আগে সংস্কার তারপর নির্বাচন এই বাহানায় যদি ছাত্র সংসদ নির্বাচন আটকে যায়, সেই দায়িত্ব ছাত্রদলকে নিতে হবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনের ভাষা পড়ুন। তারপর রাজনৈতিক অবস্থান ঠিক করুন।
-
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি