Image description

ড. শাকিব মুসতাভী

 

লাখ লাখ মানুষ অশ্রুসিক্ত নয়নে শহীদ ওসমান হাদিকে বিদায় জানাল। কোনো কোনো সূত্র অনুযায়ী এই সংখ্যাটা ১০ লক্ষাধিক! স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো জানাজায় এত মানুষের সমাগম বিরল। বয়োজ্যেষ্ঠদের অনেকে বলছেন, সংখ্যার দিক থেকে এই জনসমুদ্রের সঙ্গে একমাত্র তুলনা করা যায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জানাজার সঙ্গে।

প্রসঙ্গক্রমে, শহীদ জিয়ার নাম আসায় আফসোসটা আরেকটু বেড়ে গেল। কারণটা হলো শহীদ জিয়ার গড়া দল বিএনপির অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়, এ রকম অনেক আইডি থেকে কয়েক মাসে শহীদ ওসমান হাদিকে নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা কটূক্তি করা হয়েছে। তাকে ‘পথশিশু’, ‘মব সৃষ্টিকারী’, ‘ডেভিল’সহ বিভিন্ন কুৎসিত শব্দ ব্যবহার করে আক্রমণ করা হয়েছে। হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তারা কিছুটা সহানুভূতি দেখালেও দাফনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অনেকে সেই পুরোনো শব্দের আক্রমণে ফিরে গেছেন। শহীদ ওসমান হাদির জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে প্রায় লাখের কাছাকাছি ফেসবুক ফলোয়ার আছে—এমন একজন বিএনপিপন্থি অ্যাকটিভিস্ট মন্তব্য করেছেন, ‘জনি সিন্স তো বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্স স্টার্ভ তরুণ জনি সিন্স হতে চায়।’

জনি সিন্স একজন পর্নো সিনেমার অভিনেতা। একজন তরুণ রাজনৈতিক নেতা, যিনি বিকল্পধারার রাজনীতি করার স্বপ্ন দেখতেন, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি এবং দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে গিয়ে ইনসাফের বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন, তার প্রতি এই গোষ্ঠীর এত ক্ষোভের কারণ কী? শুধু তাই নয়, হাদি তার কোনো বক্তব্যে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো রাজনৈতিক দল সম্পর্কে কোনো ধরনের কটূক্তি করেননি। এমনকি আওয়ামী লীগের মধ্যে যারা অপরাধ করেনি, সেসব মানুষের ইনসাফের পক্ষেও তিনি কথা বলতেন। তাই এটাকে তার প্রতি নিছক রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কিংবা তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীদের অজ্ঞতা বলে সম্পূর্ণরূপে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। এর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি-কাঠামো এবং রাজনৈতিক কর্মীদের মনোভাব আমলে না নিলে ওসমান হাদির প্রতি এই বিদ্বেষকে যৌক্তিকভাবে বোঝাপড়া করা সম্ভব নয়।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপি এই দ্বিদলীয় বন্দোবস্ত বিদ্যমান ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শাসন ক্ষমতায় থাকা এই দুটি দল মূলত পরিবারতন্ত্রের চর্চা করেছে। দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্তরবিন্যাস ছিল অনেকটা ইউরোপের মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রের মতো।

মধ্যযুগে ইউরোপে সব মানুষকে সমান বলে বিবেচনা করা হতো না। সমাজ মোটামুটি তিনটা স্তরে বিন্যস্ত ছিল। শুরুতেই ছিল রাজপরিবার। এরপরের স্তরেই ছিলেন সমাজের অভিজাত শ্রেণির মানুষ। তারা মূলত জমিদার, সামরিক অফিসার এবং আমলা। সবচেয়ে নিচের স্তরে ছিলেন প্রজারা বা ফিউডাল সার্ফরা। এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, এই তিনটি স্তর ছাড়াও আরেকটি স্তর ছিল। সেটি হলো যাজক সম্প্রদায় বা ক্লারজি। তারা রাজপরিবারের পরই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক সুবিধা উপভোগ করতেন। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্তরবিন্যাসের প্রেক্ষাপটে ক্লারজি বা মোল্লাতন্ত্রের আলাপ প্রাসঙ্গিক নয়।

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিদলীয় প্রধান নির্বাচনের ক্ষেত্রে পুরোপুরি পরিবারতান্ত্রিক। বাংলাদেশের রাজনীতির মিড বা আপার মিড লেভেলের নেতৃত্ব আসলে রাজনৈতিক এলিট বা অভিজাতদের হাতে। একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে নিজের মেধা, যোগ্যতা, সাহস এবং পরিশ্রম দিয়ে সেখানে দলীয় প্রধানের পদে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব।

এই অসম্ভব কাজটা শহীদ ওসমান হাদি করতে চেয়েছিলেন। তিনি নিজের চেয়ে অনেক বেশি হেভিওয়েট একজন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পুরো নির্বাচনি এলাকা হেঁটে তিনি গণসংযোগ করতেন। মানুষের সঙ্গে কুশলবিনিময় করতেন। নির্বাচনে কালো টাকা এবং পেশিশক্তির ওপর নির্ভর না করে তিনি ক্রাউড ফান্ডিং এবং জনতার ভালোবাসার ওপরেই আস্থা রেখেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি জিততে পারতেন কি না—সেটি তর্কসাপেক্ষ এবং এই মুহূর্তে অপ্রাসঙ্গিক। তবে তিনি যে জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলতে পেরেছিলেন, এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। কোটি কোটি টাকা ছাড়াও যে নির্বাচন করা যায়, এই ধারা ভেঙে দিতে যাচ্ছিলেন ওসমান হাদি, যা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রচলিত ঘুণে ধরা রাজনীতির সামনে।

ওসমান হাদির এই ব্যতিক্রমধর্মী রাজনীতি আসলে বাংলাদেশে এতকাল ধরে চলে আসা সামন্ততান্ত্রিক রাজনীতির ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। হাদির কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হয়ে যদি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, সৎ এবং রক্ষণশীল যুবক-যুবতীরা যদি দলে দলে রাজনীতিতে যোগদান করেন, সেটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে পুরোপুরি বদলে দিতে পারে। এই ভয়টা পুরোনো অভিজাতদের মধ্যে হাদি ভালোভাবেই ঢোকাতে পেরেছিলেন।

যেসব দলীয় অ্যাকটিভিস্টরা হাদির বিরুদ্ধে বুলিংয়ে নেমেছিল, তার মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর লাঠিয়াল বা ভাড়াটে। ছাত্র সংগঠনসহ তাদের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনও আসলে দলীয় লাঠিয়ালের ভূমিকা পালন করে। নইলে ৩৮ বছর বয়সে একজন মানুষ কীভাবে ছাত্রনেতা হতে পারেন?

শহীদ হাদি সামান্য একজন প্রজা থেকে জননেতা হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক বাংলাদেশি রাজনীতিতে জননেতার পদটা শুধু এলিটরাই অলংকরণ করতে পারেন। হাদি এই ‘ধৃষ্টতা’ দেখানোর হিম্মত করেছিলেন বলে ভার্চুয়াল লাঠিয়ালরা তির্যক মন্তব্য করে তার জনপ্রিয়তাকে পর্নো অভিনেতার সঙ্গে তুলনা করে তাকে উপহাস করছেন। এই ভার্চুয়াল লাঠিয়ালরা কিন্তু চাইলেও তাদের মালিকদের মতো অভিজাত হতে পারবেন না। হাদি প্রকারান্তরে তাদের পক্ষেই লড়াই করেছেন। কিন্তু দলান্ধতার রঙিন চশমা পরে থাকায় তারা সেটি বুঝতে পারলেন না। আফসোস!

এখন পাল্টা প্রশ্ন হলো, ওসমান হাদি কি ব্যর্থ? বাংলাদেশে কি আর কোনো দিন রাজনৈতিক সামন্তবাদের বলয় থেকে বের হয়ে আসতে পারবে না? তাহলে শহীদ ওসমান হাদির জানাজায় এই লাখো মানুষের জনসমুদ্র আসলে কীসের আলামত? এটা কি শুধুই আবেগী জনতার ঢল? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের খুঁজতে হবে।

ওসমান হাদির শাহাদতের পর একটি স্লোগান ভাইরাল হয়েছে, ‘আমরা সবাই হাদি হব’। মানুষ কেন হাদি হতে চাচ্ছে? মানুষের হাদি হয়ে ওঠা মূলত রাজনৈতিক সামন্ততন্ত্র ভেঙে প্রজা থেকে নাগরিক হয়ে ওঠার আলামত। ধারণা করা হচ্ছে, আসন্ন সংসদ নির্বাচনে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভোটার জীবনে প্রথমবারের মতো কোনো অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভোট দিতে যাচ্ছেন। এই তরুণ ভোটারদের একটা বড় অংশেরই কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি ধরাবাঁধা আনুগত্য নেই। তারা চিন্তায় অনেকটা স্বাধীন এবং সুইং ভোটার। এদের হাত ধরে চব্বিশের বিপ্লব বা জুলাই গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। তাদের হাদি হতে চাওয়ার এই আকাঙ্ক্ষা আসলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সামন্ততন্ত্রের পতনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভিজাতরা কি এই পরিবর্তনের গণধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন?

লেখক : পোস্ট ডক্টরাল গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা, আমেরিকা