Image description
 

একুশ শতকের রাজনীতি এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে বিশ্বের সর্বাধিক আলোচিত দুই রাজনৈতিক ব্যবস্থা-গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র নতুন করে পরস্পরের মুখোমুখি। মানবসভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসে নানা ধরনের শাসনব্যবস্থার উত্থানপতন দেখেছি আমরা। রাজতন্ত্র থেকে সামন্ততন্ত্র, উপনিবেশবাদ থেকে জাতীয়তাবাদ, সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্র; সবই সময়ের চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে ধারণাটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল, তা হলো গণতন্ত্র। মনে করা হয়েছিল, গণতন্ত্রই মানবমুক্তির পথ, রাষ্ট্রের জবাবদিহি ও নাগরিক স্বাধীনতার সর্বোচ্চ নিশ্চয়তা। কিন্তু একুশ শতকে এসে সেই ধারণার ভিত্তি যেন কেঁপে উঠতে শুরু করেছে।

 
 

আজকের বিশ্বে গণতন্ত্র আছে, কিন্তু তার অন্তরস্থ প্রাণশক্তি কমে গেছে। বহু দেশে নির্বাচন হয়, সংসদ আছে, বিচারব্যবস্থার কাঠামো আছে, কিন্তু সেই কাঠামোগুলো কার্যকর নয় বা কার্যকর হলেও ক্ষমতাকেন্দ্রিক দলীয় স্বার্থের কাছে দুর্বল। গণতন্ত্রের ভিত্তি তিনটি : জনগণের অংশগ্রহণ, সরকারের জবাবদিহি এবং নাগরিক স্বাধীনতা। এই তিনটিই বিভিন্নভাবে চাপে পড়েছে। জনসাধারণ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের প্রভাব কমছে। কারণ, অর্থনৈতিক বৈষম্য রাজনীতিকে ধনীদের হাতে কেন্দ্রীভূত করেছে। নির্বাচনে অংশ নিতে অর্থ প্রয়োজন, প্রচারযুদ্ধ পরিচালনা করতে অর্থ প্রয়োজন। ফলে রাজনীতি ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।

 

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তিনির্ভর নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ডেটাভিত্তিক নজরদারি এখন রাষ্ট্র এবং করপোরেট উভয়ের হাতে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। গণতন্ত্র যেখানে নাগরিক স্বাধীনতা ও গোপনীয়তা রক্ষা করার কথা বলে, সেখানে প্রযুক্তি ব্যবহারের অজুহাতে নাগরিকের ওপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি বাড়ছে। আরেক বিপদ এসেছে ভুয়া তথ্য ও প্রোপাগান্ডা থেকে। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি সত্য; কিন্তু আজ সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকে অস্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ভুয়া খবরের সুনামিতে সমাজ বিভক্ত হচ্ছে, মানুষ বাস্তবতার বদলে আবেগ ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এর ফলেই জনপ্রিয়তাবাদী নেতাদের উত্থান ঘটছে, যারা জটিল সমস্যার সহজ সমাধান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনতাকে আবেগের দোলনায় ভাসায়। এদের লক্ষ্য সাধারণত বিচারব্যবস্থা দুর্বল করা, গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষের আস্থা কমিয়ে দেওয়া। ফলে গণতন্ত্র থেকে জন্ম নেয় এক ধরনের অদৃশ্য স্বৈরতন্ত্র, যাকে বলা যায় ‘গোপন স্বৈরতন্ত্র’, যেখানে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন হয় কিন্তু গণতন্ত্রের মুখোশ অটুট থাকে।

 

অন্যদিকে স্বৈরতন্ত্রও বদলে গেছে। একসময় স্বৈরতন্ত্র মানেই ছিল রক্তচোষা একনায়ক, সেনাবাহিনীর ট্যাংক, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, সেন্সরশিপ। সেই চিত্র এখনো আছে, কিন্তু একে বলা যায় ২০শ শতকের স্বৈরতন্ত্র। একুশ শতকে স্বৈরতন্ত্র অনেক বেশি চতুর, কৌশলী এবং প্রযুক্তিনির্ভর। এখন স্বৈরতন্ত্রের প্রধান কৌশল হলো, গণতন্ত্রকে দেখানো, কিন্তু ভেতর থেকে তাকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া। একটি সরকার জনমত জরিপ করে, নির্বাচন আয়োজন করে, সংসদ চালায়; তবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে এমনভাবে, যাতে আসল সিদ্ধান্ত সবসময় ক্ষমতাসীনদের হাতে থাকে। বিরোধী দল থাকে, কিন্তু দুর্বল; গণমাধ্যম থাকে, কিন্তু ক্ষমতার কাছে জবাবদিহি করতে পারে না; বিচারব্যবস্থা থাকে, কিন্তু স্বাধীন নয়। একে বলা হয় ‘হাইব্রিড রেজিম’ অর্থাৎ গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের মিশ্র শাসনব্যবস্থা। বাহ্যিকভাবে গণতন্ত্র, ভেতরে স্বৈরতন্ত্র।

 

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এই দুই ধারার সংঘাত ভিন্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে গণতন্ত্র আছে, কিন্তু রাজনৈতিক মেরূকরণ ভয়ংকরভাবে বেড়েছে। আমেরিকায় জাতিগত বিভাজন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, করপোরেট শক্তির আধিপত্য এবং পপুলিস্ট রাজনীতির উত্থান গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করছে। ইউরোপেও অভিবাসন-সংকট ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থান গণতন্ত্রের স্থিতি প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

 

একসময় ইউরোপ-আমেরিকা যে উদাহরণ দেখিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে গণতন্ত্র প্রচার করত, আজ তারা নিজেরাই গণতন্ত্রের সংকটে পড়েছে।

 

মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র কখনোই গভীরভাবে শেকড় গাড়তে পারেনি। এখানে দীর্ঘদিন ধরে রাজতন্ত্র, সামরিক শাসন ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সমন্বয়ে স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা টিকে আছে। আরব বসন্তের সময় মানুষ গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছিল, কিন্তু সেই স্বপ্ন অধিকাংশ দেশে স্বল্পমেয়াদি সময়ের মধ্যেই ভেঙে যায়। মিসর, সিরিয়া ও লিবিয়া-এসব দেশে গণতন্ত্র টিকতে পারেনি সামরিক শক্তি, গোত্রভিত্তিক রাজনীতি, বৈদেশিক হস্তক্ষেপ এবং উগ্র সংগঠনের উত্থানের কারণে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে স্বৈরতন্ত্র এখনো স্থায়ী ও প্রাতিষ্ঠানিক।

 

আফ্রিকাতেও একই চিত্র, সেখানে অনেক দেশে নির্বাচন হয়, কিন্তু নির্বাচন মানেই যে গণতন্ত্র তা নয়। দুর্নীতি, সামরিক ক্ষমতার প্রভাব, জাতিগত সংঘাত, বহুজাতিক কোম্পানির লুটপাটÑসব মিলিয়ে সেখানে গণতন্ত্র টেকসই হতে পারে না। বহু দেশেই রাষ্ট্রপতির মেয়াদসীমা তুলে দেওয়া হয়েছে, নেতারা আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চান, যার ফলেই গণতন্ত্রের মূল চেতনা বিলীন হয়ে যায়।

 

লাতিন আমেরিকা এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের জায়গা। এখানে কখনো গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়, কখনো আবার পপুলিস্ট নেতাদের হাত ধরে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা মাথাচাড়া দেয়। ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা ও নিকারাগুয়া-এসব দেশে অর্থনৈতিক সংকট ও সামাজিক বৈষম্য রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দেয় আর সেই অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে নেতারা নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন।

 

দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্র আছে কাঠামোগতভাবে, কিন্তু বাস্তবে দলতন্ত্র বেশি শক্তিশালী। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কাসহ সব দেশেই বিভিন্ন ধরনের সংকট দেখা যাচ্ছে। ভারতে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উত্থান, পাকিস্তানে সামরিক প্রভাব, শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকটের কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা-এসবই গণতন্ত্রকে দুর্বল করে।

 

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দলীয় মেরূকরণ, নির্বাচন নিয়ে আস্থাহীনতা, বিরোধী রাজনীতির দুর্বলতা, গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা এবং রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ; এই বিষয়গুলো গণতন্ত্রের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ করে। ফলে গণতন্ত্রের কাঠামো থাকলেও এর মূল উপাদানগুলো অনেকটাই দুর্বল হয়ে আছে।

 

গণতন্ত্র কেন দুর্বল হচ্ছে এবং স্বৈরতন্ত্র কেন আবার জনপ্রিয় হচ্ছে? প্রথম কারণ হলো-বৈশ্বিক পুঁজিবাদ। অর্থনীতির ওপর করপোরেট নিয়ন্ত্রণ বাড়ায় রাজনৈতিক ক্ষমতাও কিছু মানুষের হাতে জমা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তি এখন ক্ষমতার নতুন অস্ত্র। ডিজিটাল নজরদারি ও সাইবার নিয়ন্ত্রণ স্বৈরতন্ত্রকে আরো কার্যকর করেছে। তৃতীয়ত, ভুয়া তথ্যের বিস্তৃতি এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, যেখানে মানুষ বিভ্রান্ত, মেরূকৃত ও অসহিষ্ণু। চতুর্থত, গণতন্ত্রের ধীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিপরীতে স্বৈরতন্ত্র দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়, যা অনেক মানুষ পছন্দ করে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে। পঞ্চমত, আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভারসাম্য বদলে গেছে। চীন ও রাশিয়ার মতো শক্তিধর দেশগুলো এখন উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার নামে কর্তৃত্ববাদী মডেলকে সফল উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছে, যা অন্য দেশগুলোকে প্রভাবিত করছে।

 

অন্যদিকে মানুষও স্বৈরতন্ত্রকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রহণ করছে। তারা মনে করছে, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতার চেয়ে একক নেতৃত্বের শাসন স্থিতিশীলতা দেয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কঠোর আইন প্রয়োগ, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ-এসব বিষয় সামনে রেখে অনেক দেশেই মানুষ গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন পছন্দ করছে।

 

তবে এই চিত্র সত্ত্বেও গণতন্ত্রের সম্ভাবনা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। শিক্ষার প্রসার, মধ্যবিত্ত শ্রেণির বৃদ্ধি, মানবাধিকার আন্দোলন, প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার, বিশ্বায়ন-এসবই গণতন্ত্রকে নতুন শক্তি দিতে পারে। গণতন্ত্রের সমস্যা আছে, কিন্তু তার সৌন্দর্যও আছে। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হলো মানুষকে স্বাধীনতা দেওয়া, মতপ্রকাশের সুযোগ দেওয়া, ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করা এবং ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি রাখা।

 

তাহলে প্রশ্ন হলো-ভবিষ্যতে কোন শাসনব্যবস্থা টিকে থাকবে? বাস্তবতা হলো আগামী কয়েক দশক বিশ্বে খাঁটি গণতন্ত্র বা খাঁটি স্বৈরতন্ত্র দুটোর কোনোটিই খুব বেশি থাকবে না। বরং থাকবে মিশ্রব্যবস্থা। কোথাও গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে, কোথাও স্বৈরতন্ত্র। প্রযুক্তি হবে নির্ধারক শক্তি, অর্থনীতি হবে প্রধান চালিকাশক্তি আর জনগণের শিক্ষা ও সচেতনতা হবে চূড়ান্ত শক্তি।

 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ভুয়া তথ্য মোকাবিলায় সচেতনতা, অর্থনৈতিক সমতা ও রাজনৈতিক সহনশীলতা। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ, কারণ ভবিষ্যৎ তাদের হাতেই।

 

২১ শতকের রাজনীতি হলো গণতন্ত্রের লড়াই এবং স্বৈরতন্ত্রের পুনরুত্থানের গল্প। গণতন্ত্র বেঁচে আছে, কিন্তু প্রতিদিন আক্রমণের মুখে। স্বৈরতন্ত্র মৃত নয়, বরং আগের চেয়ে কৌশলী, প্রযুক্তিনির্ভর ও দৃঢ়। তবু গণতন্ত্রই মানব মর্যাদার সর্বোচ্চ রূপ, কারণ এটি ক্ষমতাকে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেয়। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে নাগরিকদের হাতে; তাদের সচেতনতা, তাদের সতর্কতা এবং সত্যের প্রতি তাদের অটল অবস্থানের ওপর। যে সমাজ সত্য, স্বাধীনতা ও মানবিকতার মূল্য দেয়, সেখানে স্বৈরতন্ত্র কখনো স্থায়ী হতে পারে না। আর যে সমাজ স্বাধীনতাকে অনাদর করে, সেখানে গণতন্ত্র শুধু দেয়ালে টানানো পোস্টার হয়ে থাকে।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ইমেইল: [email protected]