Image description
 

গণতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় জনগণের মতামত, বাক্‌স্বাধীনতা এবং স্বচ্ছ জবাবদিহিতার ওপর। এই তিনটি স্তম্ভকে শক্তিশালী করার জন্য রাজনীতিতে সমালোচনা গ্রহণ করার মানসিকতা অপরিহার্য। একটি রাজনৈতিক দল বা সরকার যখন গঠনমূলক সমালোচনাকে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন তা কেবল অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে না, বরং পুরো গণতান্ত্রিক কাঠামোকেই পঙ্গু করে দেয়। রাজনীতিতে সমালোচনা কেন গুরুত্বপূর্ণ, কেন এটি একটি দলের টিকে থাকা এবং সফল হওয়ার জন্য অত্যাবশ্যক, তা বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

 

সমালোচনা: একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক আয়না
সমালোচনাকে প্রায়শই একটি নেতিবাচক শব্দ হিসেবে দেখা হলেও, সুস্থ রাজনীতিতে এটি একটি মূল্যবান 'ফিডব্যাক টুল'। এটি সমাজের সেই সমস্ত দিকগুলো তুলে ধরে, যা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে সহজে দেখা যায় না।

১. ভুল সংশোধন ও নীতি প্রণয়নে উন্নতি: দল বা সরকার যখন কোনো সিদ্ধান্ত বা নীতি গ্রহণ করে, তা সব নাগরিকের জন্য সমানভাবে ফলপ্রসূ নাও হতে পারে। বিরোধী পক্ষ, নাগরিক সমাজ বা গণমাধ্যমের সমালোচনার মাধ্যমে নীতিনির্ধারকরা জানতে পারেন যে, তাঁদের সিদ্ধান্তগুলো তৃণমূল পর্যায়ে কেমন প্রভাব ফেলছে। সমালোচনা তখন একটি সংশোধনী প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করে, যা দলকে সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে বেরিয়ে এসে আরও বেশি জনমুখী ও বাস্তবসম্মত নীতি তৈরি করার সুযোগ দেয়। সমালোচনা গ্রহণ করার মাধ্যমেই একটি দল তার ভুল স্বীকার করে এবং নিজেদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা প্রমাণ করে।

 

২. জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি: যে কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহি করা বাধ্যতামূলক। সমালোচনা এড়িয়ে যাওয়ার অর্থ হলো জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করা। এর বিপরীতক্রমে, যে দল বা নেতা সমালোচনাকে স্বাগত জানায়, সে দল জনগণের সামনে নিজেদের কাজের জন্য স্বচ্ছতা বজায় রাখতে প্রস্তুত থাকে। এই স্বচ্ছতা জনগণের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করে। যখন কোনো দল বিরোধী মতামতকে সম্মান জানায়, তখন দেশে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যেখানে জনগণ নিজেদেরকে সরকার পরিচালনায় অংশীদার মনে করে।

 

৩. রাজনৈতিক পরিপক্কতা ও আত্মোন্নয়ন: একটি দলের রাজনৈতিক পরিপক্কতার অন্যতম মানদণ্ড হলো প্রতিকূল বা ভিন্নমতকে কীভাবে মোকাবিলা করা হয়। সমালোচনাকে আক্রমণ হিসেবে না দেখে যদি আত্মোন্নয়নের সুযোগ হিসেবে দেখা হয়, তবে তা দলের রাজনৈতিক চরিত্রকে মজবুত করে। অনেক সময় বাইরের সমালোচনার ফলেই দলের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বা সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকাশ পায়। সমালোচনা গ্রহণ করে দ্রুত সেই দুর্বলতা নিরসন করতে পারলে, দল আরও শক্তিশালী ও সুসংগঠিত হয়। এটি দলকে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পাঠ দেয়।


যে দল সমালোচনাকে ভয় পায় বা দমন করতে চায়, তারা দীর্ঘমেয়াদে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সমালোচনাহীন রাজনীতি একনায়কতান্ত্রিক মনোভাব তৈরি করে, যেখানে ক্ষমতা অন্ধ হয়ে যায়। ফলস্বরূপ, দলের মধ্যে 'তোষণ সংস্কৃতি' তৈরি হয়, যা দল এবং রাষ্ট্র উভয়ের জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর। সমালোচনার অনুপস্থিতিতে ভুলগুলো স্থায়ী হতে থাকে, যার চূড়ান্ত শিকার হয় দেশের সাধারণ জনগণ।


রাজনীতিতে সমালোচনা গ্রহণ করার মানসিকতা কেবল একটি উদার দৃষ্টিভঙ্গি নয়, এটি একটি দলের দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব এবং দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য অপরিহার্য। যে দল ভুল স্বীকার করে, সমালোচনা থেকে শিক্ষা নেয় এবং ক্রমাগত নিজেকে সংশোধন করে, সেই দলই গণতন্ত্রকে মজবুত করে এবং জনগণের হৃদয়ে প্রকৃত অর্থে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়। তাই, রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত সমালোচনাকে শত্রু না ভেবে আত্ম-পর্যবেক্ষণের সুযোগ এবং উন্নত শাসনের পথ হিসেবে গ্রহণ করা।

 

শেখ ফরিদ

কবি ও গণমাধ্যমকর্মী