ড. মো. আদনান আরিফ সালিম
সম্প্রতি নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী তার স্বভাবসুলভ হঠকারী বক্তব্য দিয়ে আরেক দফা বিতর্ক উষ্কে দিয়েছেন নেটিজেনদের মধ্যে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ জানাচ্ছে তার বক্তব্য ছিল ‘জিয়াবাদ বলুন, মুজিববাদ বলুন—আমরা কোনো বাদ বাংলাদেশে চাই না৷ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রধান জায়গায় থাকবে জনগণ। জনগণের পক্ষেই আমরা লড়াই করতে চাই।’ওদিকে তার এই বক্তব্য ভাইরাল হতে না হতেই অনলাইনে অনেকেই ‘ডার্বিবাদ’, ‘নাসিরাবাদ’, সায়েদাবাদ এগুলো জুড়ে দিয়ে যাচ্ছেতাই বাদানুবাদে লিপ্ত হয়েছে। যার কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ হারিয়ে গেছে মূল ফোকাস থেকে। আর এ থেকে কারা সব থেকে লাভবান হয়েছে সেটা নতুন করে বলার কিছ নাই।
নাগরিক কমিটির এই আহ্বায়ক শুরু থেকেই কোনো কিছু ‘না বুঝে’, কিঞ্চিৎ বুঝে’ কিংবা ‘বেশি বুঝে’ ধারাবাহিক যেসকল হঠকারী বক্তব্য রেখেছেন তা কিছু না করুক, অন্তত ৫ আগস্ট পূর্ব বিপ্লবী শক্তির মধ্যে বিদ্যমান ছোট্ট চিড়গুলোকে বিকট দর্শন কিম্ভূতকিমাকার ফাটলে পরিণত করেছে। গতকালের বক্তব্যও তার সেই হঠকারিতার ধারাবাহিকতা মাত্র। রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির দুর্দান্ত একটি মঞ্চ এখন অনলাইন। আর সেখানে ৫ আগস্টের পর থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তি নিজেদের মধ্যে শুরু হওয়া নয়া ফ্যাসাদে কিছু নিত্যনতুন শব্দ যুক্ত করেছে। আর সেগুলো কিছু না করুক সমৃদ্ধ করেছে অন্তর্জালিক শব্দভাণ্ডারকে।
বাংলা ব্লগের স্বর্ণযুগে অনেকগুলো দুর্দান্ত শব্দ আবিষ্কার হতে দেখেছিলাম। আজ থেকে প্রায় একযুগ আগে আমার একটা লেখায় আমি সেটা নিয়ে বিস্তর বর্ণনা দিয়েছিলাম। বর্তমান জেনজি হয়তো সেগুলোর সঙ্গে তেমন পরিচিত নয়। তাই নতুন করে তাদের জন্য বলতে হয় সেই ব্লগীয় নতুন পরিভাষাগুলোর কথা। সেখানে ছিল গদাম (পশ্চাৎ দেশে লাথি ঝাড়া), পাকি (পাকিস্তান সমর্থক), ভিম্পি/বিম্পি (বিএনপি), আম্লিগ/হাম্বা (আওয়ামী লীগ), ভাদা (ভারত এর দালাল), পাদা (পাকি দালাল) ভাকুর (ভারতীয় কুকুর), ছাগু/জাশি (জামাত শিবির), টেকি (প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের নাম), খিকচ (চাপা হাসির বহিঃপ্রকাশ), ধইন্যা (ধন্যবাদ), ল্যাঞ্জা বাইর হওয়া (বিতর্কে হেরে যাওয়া), কুত্তালীগ (ছাত্রলীগ), লুলামী করা (মেয়েঘেষা কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়া), ছাইয়া (ছেলে হয়ে মেয়ের ভান করা), তেনা পেঁচানো (অযথা তর্ক করা), পিছলানো (পাশ কাটিয়ে চলা) ইত্যাদি। এগুলোকে স্বঘোষিত বোদ্ধাদের বেশিরভাগ বাংলা ভাষাশৈলীর বিকৃতি হিসেবে মনে করলেও আমরা সেটাকে পাত্তা দেইনি, উল্টো স্বগৌরবে এগিয়ে নিয়েছিলাম সেগুলোকে।
তখন আমাদের সবার কাছে নিছক হাসির খোরাক হিসেবে চালু করেছিলাম বাংলা-ইংরেজি মিশ্রণে বিবিধ নিত্যনতুন শব্দ। ওদিকে বাংলার আংশিক রূপান্তরের মাধ্যমে কিছু শব্দ যেমন শিরাম/সৈরাম (সেরকম), চ্রম (চরম), মুঞ্চায় (মন চায়), ভাল্লাগ্লো(ভালো লাগলো), পিছলানো (কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া), তেব্র (তীব্র), পিচলামি (ইসলামি), মালানি (হিন্দুয়ানি), জসিলা (জটিল)- ইত্যাদির পৌনপুনিক ব্যবহারও দেখা গিয়েছিল। অন্যদের কথা জানিনা একজন ব্লগার হিসেবে এইসব শব্দের বহুল ব্যবহারের ধারাবাহিকতায় পরীক্ষার খাতায়ও এই ধরনের কিছু শব্দ মনের অজান্তে লিখেছিলাম আমি। তারপর পরীক্ষকের কাছে নিতান্তই আজগুবি লাগায় তিনি নম্বর কেটেছিলেন, পাশাপাশি গালমন্দ করেছিলেন আমাকে।
শব্দকে নিজের মতো করে ব্যবহারের যে মজা সেটা দেখেছিলাম বিদেশি শব্দ প্লাচাইলাম (ইতিবাচক রেটিং বা ভোট দেয়া), ব্যান (নিষিদ্ধ), ব্লগান (ব্লগিং করা), পোস্টান/পুস্টানো (লেখা দেয়া), ইউজান (ব্যবহার), হেল্পান (সহযোগিতা করেন), স্লিপান (ঘুমানো), ইটাচ্ছি (খাচ্ছি), কম্পু (কম্পিউটার), ল্যাপু (ল্যাপটপ) ইত্যাদিতে। এগুলো তখন নিতান্ত বেরসিককেও হাসাতে পেরেছিল। তবে ব্লগারদের নামগুলাও ছিল ইউনিক। নিক-নাম হিসেবে চিকন মিয়া, গেদু চাচা, চেয়ারম্যান, খালি ব্যান খাই, পিরীতির নাম কাডালের আঠা, পুলার নাম লিপিস্টিক খান, ছেড়ে দে শয়তান, আজীব পোলা, দুলাভাই, আমার শালী লণ্ডনে, ডিজিটাল পোংটামি, ডিজিটাল হাসি, ভেজা বিলাই, জাকারবার্গের চেলা, স্টিভ জবস আমার শালা, ভাদাইম্যা, বদনা দে নয়তো উষ্টাদিমু, বিজলী এখন ঢাকায়, ধর সাইকেল মুইত্যা আসি, বদমাশ, অধমের নাম বলদা ছেলে, দুর্যোধন, আঁতেল, ফাত্রা পুলা রুবেল, ঢাকাচ্ছেলে টুটুল এগুলা ভাবতে গেলেও অনেককে অবাক হতে হবে। অথচ সেগুলো ছিল তখনকার অন্যতম বাস্তবতা।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ঘেরাটোপে ব্লগের সেই সৃষ্টিশীলতা হারিয়ে যাওয়ার আগে আমরা দেখেছিলাম বাংলা বাক্য ও শব্দের অনেক নতুন রূপ। হাহাপগে (হাসতে হাসতে পড়ে গেলাম), হাহালুখুগে (হাসতে হাসতে লুঙ্গি খুলে গেল), চ্রম (চরম), খ্রাপ (খারাপ), পুত্তম(প্রথম), তেব্র (তীব্র), বেয়াপক/বেফুক(ব্যাপক), মজাক লইলাম (খুশি হলাম), পালাদিমুচা (পাছায় লাথি দিতে মন চায়), আবুআ (আয় বুকে আয়)। এসব নিয়ে নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও সেটাকে সৃষ্টিশীলতা হিসেবে অস্বীকার করে সাধ্য কার।
ব্লগের নস্টালজিয়া থেকে স্মৃতিতর্পণ শেষ হলে নষ্ট বক্তব্য আর ভ্রষ্ট চিন্তার এই যুগের ভাবাদর্শিক দর্পণে একটু দৃষ্টি দেওয়া যেতেই পারে। ৫ আগস্ট উত্তরকালের ফেসবুকারর এখন নতুন করে সৃষ্টিশীলতা দেখাচ্ছেন। তারাও নতুন করে কিছু শব্দ অনলাইনে যুক্ত করেছেন। তারা ফ্যাসিবাদী শক্তির প্রতি নিজেদের রাগ-ক্ষোভ একপাশে রেখে পরস্পরকে আক্রমণ করছেন ‘টেম্পুস্ট্যান্ড’ কিংবা ‘আন্ডাগ্রাউন্ড টানেল পার্টি-এটিপি’ হিসেবে। ওদিকে কেউ কেউ জাতীয় নাগরিক কমিটির নানা কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে তাদের বলছেন জাতীয় নাগরিক কমেডি। বামপন্থীদের যুক্তিতে বিরক্ত হয়ে অনেকে বক্তব্য ‘তুই গোসল কর’। এদিকে তার বিপরীতের অনেকের যুক্তি ‘মানুষ কি কাম করলে রোজ গোলস করে সেটা আমরা জানি’।
কাদা নিক্ষেপ প্রতিযোগিতায় যদি ফুটবলের মতো ব্যালন ডি’অর থাকতো ৫ আগস্ট পরবর্তীকালের পারফর্মেন্স হিসেবে সেটা নিঃসন্দেহে নাসিরউদ্দীন পাটোয়ারির ঘরে যেতো। ওদিকে তার অতীত টেনে এনে অনেকে তারও নতুন নাম দিয়েছে ‘ডার্বি নাসির’। আমি শুরুতে মনে করেছিলাম মিসরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘুরে এসে কারও নাম যদি আযহারী হয় তাহলে ইংল্যান্ডের ডার্বিশায়ার ফেরত স্কলার হিসেবে নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী নিজের নিজের নামে এই ডার্বি নাসির লাগালেন কি– না। পরক্ষণে ভাবি তাহলে তো ডার্বিশায়ার হওয়ার কথা। শুধু ডার্বি কেনো? তাদের ক্যাচাল কাটতে না কাটতেই জানতে পারি তথ্য অন্যখানে।
যাই হোক পরীক্ষায় প্রশ্ন কমন না পড়লে শিক্ষার্থীরা অনেক কথাই লিখে ফেলে। জানাকের আহ্বায়ক এই ছেলেটার ক্ষেত্রে কাহিনি অনেকটা তাই। ইতিহাসের প্রশ্নের উত্তর লিখতে গিয়ে অনেকে যেমন লিখে ফেলে ‘বিশিষ্ট গবেষক লিওনেল মেসি’ বলেন কিংবা ‘নন্দিত ইতিহাসবিদ ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো তার এল’ক্লাসিকো গ্রন্থে লিখেছেন’; নাসিরে ঘটনা তথৈবচ। যদি তাই না হয় তাহলে ‘মুজিববাদ’ এবং ‘জিয়াবাদ’ শীর্ষক শব্দগুলোকে গুলিয়ে ফেলার মূর্খতা কেউ দেখাতে পারে না। তবে হ্যাঁ এখানে বিশ্লেষণী আলোচনার সুযোগ রয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমানের অপ্রকাশিত আত্মজীবনী বাজারে থাকলেও সেখানে তার রাজনৈতিক দর্শন তথা মুজিববাদ নিয়ে সুস্পষ্ট আলাদা বক্তব্যও অধ্যায় নেই। পাশাপাশি ‘মুজিববাদের’ প্রবর্তক শেখ মুজিব নিজে ছিলেন না। এখানে রাজনৈতিক দিক থেকে ফয়দা নিতো তোফায়েল আহমেদ এবং তার থেকে বেশি ভূমিকা রাখেন কাপালিকখ্যাত সিরাজুল আলম খান। বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপে এই কাপালিক সিরাজুল আলম খানকেই মুজিববাদের পক্ষে স্লোগান আওড়াতে দেখা গিয়েছে। তবে রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে এটাকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা নেওয়া হয়েছিল আরও পরে। বলা যেতে পারে তার উপর ভিত্তি করেই পলাতক ফ্যাসিবাদের ভিত্তি রচিত হয়েছিল।
অন্যদিকে ‘উই রিভোল্ট’ বলে পাকিস্তানি আক্রমণের প্রথম প্রতিরোধের পাশাপাশি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক হিসেবে সুবিদিত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কয়েকটি প্রবন্ধে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন সুস্পষ্ট করে গিয়েছেন। ‘আমার রাজনীতির রূপরেখা’ শীর্ষক একটি গ্রন্থে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা এবং দর্শন সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ওদিকে রাষ্ট্র ও জনগণের উন্নয়ন সামনে রেখে তাঁর ঘোষিত ১৯ দফাকেও এখানে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা যেতে পারে। যদি তাই হয় তাহলে এই ধারণাগুলোকেই তর্কের খাতিরে ‘জিয়াবাদ’ হিসেবে ধরে নিচ্ছি। সেখানে এগুলোকে বাদ দিয়ে কোনোভাবেই বাংলাদেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি কিংবা প্রবৃদ্ধির সুযোগ নাই। যারা এগুলো পড়েছেন কিংবা প্রাথমিক ধারণা রাখেন তারা বুঝতে পারবেন আজকের বাংলাদেশের সমৃদ্ধির স্বপ্ন কীসের উপর দাঁড়িয়ে আছে। আর সে হিসেবে নাসিরউদ্দীন পাটোয়ারীর বক্তব্য নিঃসন্দেহে হঠকারিতা, নির্লজ্জতা এবং মূর্খতার মূর্ত প্রতীক।
ওদিকে ছাত্র ইউনিয়ন কিংবা ছাত্রফ্রন্ট ছেড়ে নাগরিক কমিটিতে যোগ দেওয়া জনৈক নারী নেত্রীর বিরুদ্ধে এবার অভিযোগের তীর। বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলাকারী একজন নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠনের নেতাকে থানা থেকে ছাড়িতে আনার জন্য এই নেত্রী নাকি ফোন করে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন ক্রমাগত। মাত্র কয়েকদিন আগে এতগুলো ছেলে-মেয়ে জীবন দিল, এত জন আহত হল। তাদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে একটা রাজনৈতিক দল করার স্বপ্ন দেখা দলটির গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা একজন নেত্রীর এতোটা অধঃপতন হয় কীভাবে?
উক্ত নেত্রী যদি সত্যিই এই সন্ত্রাসীকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ফোন দিয়ে থাকে, তার বিরুদ্ধে জাতীয় নাগরিক কমিটির অবস্থান এখন স্পষ্ট করতে হবে। আর যদি এর সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা না থাকে তবে দ্রুততার সঙ্গে কমিটির পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে তা গণমাধ্যমকে জানানো উচিত। এ বিষয়ে অস্বাভাবিকভাবে নীরব থাকার অর্থ হচ্ছে অপকর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা কিংবা অপপ্রচারকে মেনে নিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করা। আর সেই কাজটিই নাগরিক কমিটি পৌণঃপুনিকভাবে করে যাচ্ছেন। আর সেই কারণই হয়তো অনেক নেটিজেন তাদের জাতীয় নাগরিক কমেডি হিসেবে হেয় করার সুযোগ পাচ্ছেন।
বাংলাদেশের প্রধান একটি রাজনৈতিক দল, তার নেতৃবৃন্দ এবং প্রতিষ্ঠাতাকে নিয়ে সমালোচনা করতে গেলে জানাকের কয়েকজনকে যেমন সরব হতে দেখা যায়, নিজেদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার হলে কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষেত্রে তাদের রহস্যজনক নীরবতা আমাদের পুরোপুরি অবাক করে দেয়। তারা বিভিন্ন বাদ নিয়ে বাদানুবাদ বাদ দিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অংশীজনদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অংশগ্রহণে নতুন বাংলাদেশ গড়ায় মন দিলে সমস্যা অনেকাংশেই কেটে যায়।
আমার বিশ্বাস জাতীয় নাগরিক কমিটি তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর ব্যাপারে যত দ্রুত সম্ভব তাদের বক্তব্য স্পষ্ট করবেন। অপপ্রচার কিংবা দুই একজনের অপকর্মের দায় সবার উপর বর্তায় না। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে একটি অপপ্রচার চলতে থাকলে সেটিকে মানুষ সত্য বলে মেনে নিবে। তখন আপনাদের আর পিছনে ফেরার জায়গা থাকবে না। পরিস্থিতি এখন তেমনি। আমার মতে, আপনাদের প্রথম ভুল ছিল আন্দোলনের সব থেকে যোগ্য দুই নেতাকে সরাসরি নখ-দন্তহীন উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যুক্ত করা। তাদের সরে যাওয়ার পর যে নেতৃত্বশূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে আপনারা সেটা আর কাটিয়ে উঠতে পারেন নাই।
শুনতে খারাপ শোনালেও সত্য যে স্বভাবসুলভ অনৈতিক অবস্থান ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা প্রতিটি মানুষকে দানব করে দেয়। তাই একটা সময়ের গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া অনেক ছেলেমেয়ের মধ্যে এই অসুস্থ প্রবণতা এখন সুস্পষ্ট হচ্ছে দিনে দিনে। তারা অনেকেই এমন অনিয়ম ও অঘটনের জন্ম দিচ্ছে যার মধ্য দিযে মানুষের মধ্যে বিরক্তি দানা বাঁধছে ধীরে ধীরে। তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান না নিয়ে সাফাই গাইতে থাকলে দিনে দিনে তারাও আরেকটি ফ্যাসিবাদ কায়েমের দিকে এগিয়ে যেতে দেরি করবে না। সে হিসেবে বিবেকবর্জিত অবাস্তব বক্তব্য রাখায় জনাব পাটোয়ারী অনেক আগেই জাতীয় নাগরিক কমিটিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছেন। তার উচিত হঠকারী বক্তব্য রাখার জন্য গণমাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং জুলাই-আগস্টের অংশীজনদের বিরুদ্ধে কটুকথা বলার ক্ষেত্রে আরও সংযত হওয়া।
নিজের কিংবা দলের ব্যর্থতা ঢাকতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা এবং রাজনৈতিক দল নিয়ে কুমন্তব্য করাটা ছিল পলাতক ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য। এর ফলাফল শেষ অবধি কী হয় কমবেশি সেটা দেশবাসীর কাছে সুস্পষ্ট। ফ্যাসিবাদ পতনের পর বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে দেশকে গতিশীল করতে গেলে বাংলাদেশপন্থী প্রতিটি রাজনৈতিক শক্তিকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। পরস্পর দোষারোপ করার যে ‘ওল্ড স্কুল’ রাজনীতির ধারণা তা থেকে বেরিয়ে না আসলে আখেরে তা কারো জন্য ভালো ফল আনবে না।
আমরা জানি যে ষণ্ডাতন্ত্র সংস্কৃতি বোঝে না। তেমনি ক্ষুধার জ্বালা তত্ত্বকথার ধার ধারে না। বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ক লেখাপড়ার দুটি ধাপ থাকে। একটি তত্ত্বীয় হলে, অন্যটি ব্যবহারিক। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তাত্ত্বিক বিষয়ের পরীক্ষা বহু আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। সেখানে তারা ডিস্টিংশনসহ পাস করেছেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু ব্যবহারিক পরীক্ষা শুরুর পর তাদের পারফর্মেন্স নিতান্তই হতাশাজনক। এখানেও ধারাবাহিকভাবে তত্ত্বীয় পরীক্ষার মুখস্থ উত্তর বলে গেলে কাজ হবে না। সরাসরি ব্যবহারিক দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। আর সেক্ষেত্রে কোনো মতবাদ নিয়ে বাদানুবাদ বাদ দিয়ে সরাসরি কাজকর্মের দক্ষতা, নৈতিকতা ও আন্তরিকতার কোনো বিকল্প নাই।