Image description
 

নিউ ইয়র্কে একটি অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘ড. ইউনূসের মধ্যে জিয়াউর রহমানের প্রতিচ্ছবি দেখছি।’ দিনটি ছিল ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫। মাত্র এক মাসের মাথায় কী এমন ঘটল, সেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে এখন তুলনা করা হচ্ছে জেনারেল আইয়ুব খান ও জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে, যে দুই পাকিস্তানি জেনারেল বাংলাদেশে ঘৃণিত তাদের নানা ভূমিকার কারণে। ২৮ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় সংস্কারের জন্য গঠিত ঐকমত্য কমিশন রিপোর্ট দেওয়ার পরই বিএনপির এই ইউটার্ন। বৈঠকে উপস্থিত দায়িত্বশীল সূত্রের বরাতে বলা হয়েছে, ২৮ অক্টোবর রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত সংবিধান সংস্কার পরিষদের সমালোচনা করে অভিযোগ করা হয়েছে, আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসি এবং ইয়াহিয়া খানের ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’ অনুসরণে এটি করা হয়েছে। স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদকে পাশ কাটিয়ে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলটির অভিযোগ, সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবায়নের সুপারিশে তা বাদ দেওয়া হয়েছে।

 
এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কী ছিল বিএনপির নোট অব ডিসেন্টে? স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে থাকার পরও এসব ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বাদ দিয়ে ঐকমত্য কমিশন কেন আদেশ জারি করার সুপারিশ করল? ঐকমত্য কমিশনের একজন সদস্য আলাপচারিতায় জানিয়েছেন, এসব নোট অব ডিসেন্ট আমলে নিলে সংস্কারের মানে হয় না। ফ্যাসিবাদের উত্থান রোখা যাবে না।

অন্যদিকে বিএনপি নেতারা মনে করছেন, নামকাওয়াস্তে প্রধানমন্ত্রী হবেন তারেক রহমান, যদি নির্বাচনে জিততে পারেন। ড. ইউনূস এনসিপি এবং জামায়াতের সহযোগিতা পেয়ে তাহলে কি তারেক রহমানকে ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার’ ধরনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আয়োজন সম্পন্ন করেছেন? ড. আলী রীয়াজের ঘাড়ে বন্দুক রেখে এই কাজটি সম্পন্ন হয়েছে ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে। বিএনপি নেতারা বলছেন, ড. ইউনূস ও ঐকমত্য কমিশন শেষমেশ যে আয়োজন করেছেন, সেটি ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারকে হাত-পা বেঁধে নদীতে সাঁতার কাটতে বলার শামিল। জুলাই সনদে বিএনপির পক্ষে যে দুই নেতা স্বাক্ষর করেছেন, সেই দুজনের একজন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকার ও কমিশন তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। আর অন্যজন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, দু-একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকে সুবিধা দিতে ঐকমত্য কমিশন রেফারির ভূমিকায় থেকে নিজেই গোল দিয়ে দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন
 

গতকাল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের নেই । যে কোনো আদেশ অবশ্যই রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরিত হতে হবে।

তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব এবং সুপারিশে প্রতীয়মান হয়, দীর্ঘ এক বছরব্যাপী সংস্কার কমিশন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘ ধারাবাহিক আলোচনা ছিল অর্থহীন, অর্থ ও সময়ের অপচয়, প্রহসনমূলক এবং জাতির সঙ্গে প্রতারণা। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

বিএনপির সঙ্গে ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচন নিয়ে ড. ইউনূস সরকারের টানাপোড়েন চলছিল। ড. ইউনূস বলছিলেন আগামী বছর জুনের মধ্যে নির্বাচন করতে। তার আগে সংস্কার ও বিচারের কাজটি ভালোভাবে এগিয়ে রাখতে। দেনদরবার করে ড. ইউনূস দুই মাস এগিয়ে এপ্রিলে নির্বাচনে রাজি হন। শেষ পর্যন্ত তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডন বৈঠকে দুই পক্ষ ছাড় দিয়ে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনে সম্মত হয়। জামায়াত ও এনসিপি মৃদু আপত্তি করলেও সংস্কার দ্রুত করার শর্তে রাজি হয়। এরপর ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে সংস্কার প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে নিতে বিএনপি সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইস্যুতে বিএনপির আপত্তি থাকায় নোট অব ডিসেন্টসহ জুলাই সনদ স্বাক্ষর করে জামায়াতসহ ২৫ দল। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিশ্চিত হলে এনসিপি সনদে স্বাক্ষর করবে বলে জানায়।

এর মধ্যে গত ২৮ অক্টোবর ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সুপারিশ জমা দেয়। যে কমিশনের প্রধান ড. ইউনূস, তবে ভাইস চেয়ারম্যান ড. আলী রীয়াজ মূল কাজগুলো করছিলেন অন্য সদস্যদের নিয়ে। জুলাই সনদ আদেশ জারি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে রিপোর্টে বিএনপির সব নোট অব ডিসেন্ট তুলে দেওয়া হয়। সেখান থেকে ড. ইউনূসের সঙ্গে নতুন করে বিএনপির বিরোধ বাধে।

বিএনপির অভিযোগ, স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থাকলেও বাস্তবায়নের সুপারিশে তা বাদ দিয়ে গণভোটের আয়োজন করতে বলা হয়েছে। এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সংসদকে একই সঙ্গে সংবিধান সংস্কার পরিষদের দায়িত্ব প্রদান ও ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার না করলে জুলাই সনদ অটোমেটিকলি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে বলে যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। দলটির অভিযোগ, আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসি ও ইয়াহিয়া খানের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার বা এলএফওর আদলে এটি করা হয়েছে।

বিএনপির অভিযোগের বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনার পর এ বিষয়ে সরকার তার অবস্থান জানাবে বলে জানা গেছে। এদিকে ঐকমত্য কমিশন বলেছে, তারা সরকারকে সুপারিশ দিয়েছে। এটি গ্রহণ করা বা না করার এখতিয়ার সরকারের।

এছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটভুক্ত দলের প্রতীকে ভোট করার বিধানটি বাদ দেওয়া নিয়েও বিএনপির ঘোরতর আপত্তি রয়েছে।

লন্ডন বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকার ও দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির মধ্যে একটি বোঝাপড়ার সম্পর্ক তৈরি হলেও এখন নতুন করে সে অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রস্তুতির সময়কালে এসে সরকার ও বিএনপি অনেকটাই মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে।

রাষ্ট্র সংস্কারবিষয়ক জাতীয় জুলাই সনদ গত ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত হয়। এনসিপি ছাড়া জুলাই আন্দোলনের পক্ষের প্রায় সব দলই এ সনদে স্বাক্ষর করেছে। এছাড়া, ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ কমিশনের সদস্যরা এতে সই করেন। সনদ সইয়ের পর এর বাস্তবায়ন নিয়ে সুপারিশ তৈরি করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গত মঙ্গলবার ‘জাতীয় জুলাই সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়নে আদেশ’ শিরোনামে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয় ঐকমত্য কমিশন। এতে ৮৫টি সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে ৯টি নির্বাহী আদেশে, ২৮টি আইনপ্রণয়ন/সংশোধন (অধ্যাদেশ জারি) করে এবং সংবিধান সম্পর্কিত বাকি ৪৮টি বাস্তবায়নে দুটি বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়। পাশাপাশি আদেশের প্রশ্নে গণভোট ও আগামী জাতীয় সংসদে দ্বৈত ভূমিকা (সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও জাতীয় সংসদ) পালনের ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

গিট্টু লাগল কোথায়

ড. ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির গিট্টু লাগল কোথায়Ñএ নিয়ে দু-তিন দিন ধরে জনমনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হলে প্রধানমন্ত্রী হবেন তারেক রহমান। সেই প্রধানমন্ত্রী যাতে দলের নেতা না থাকতে পারেন, তার আয়োজন করেছেন ড. ইউনূস। ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন সরকারের অসংখ্য ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা নির্বাহী বিভাগের প্রধান হয়েও বিচার বিভাগ ও সংসদের ওপর একচ্ছত্র প্রভাব খাটাতে পারতেন আইনি এবং বেআইনিভাবে। আইনগতভাবে প্রভাব খাটানো বন্ধ করতে বিচার বিভাগের আলাদা সচিবালয় করে নিয়োগ-বদলি, অর্থ ব্যয় থেকে শুরু করে সবকিছু প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আলাদা সচিবালয়ের অধীনে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সংবিধানের ৪৮(৩) ধারা অনুযায়ী, একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া বাকি সব কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতিকে করতে হয়। তাও আবার প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগের একটি প্রক্রিয়া আছে, সেখানে রাষ্ট্রপতির তেমন কিছু করার নেই। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের কাজের অভিজ্ঞতা থাকলেই হতো। বাস্তবে এতদিন প্রধানমন্ত্রীর অলিখিত পরামর্শ নিয়েই রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করতেন। ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে আপিল বিভাগের সিনিয়রমোস্ট বিচারপতিকেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করতে হবে। কোনো অপশন নেই। বিএনপি সিনিয়র দুজনের একজনের কথা বলেছিল, সেটিও শেষ পর্যন্ত রাখা হয়নি। সাংবিধানিক পদ ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে আগে সরকারই নিয়োগ দিত। এখন পুরো নির্বাচন কমিশন, দুদক চেয়ারম্যান, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং ন্যায়পাল নিয়োগে স্পিকারের নেতৃত্বে বিভিন্ন কমিটি এমন পদ্ধতিতে নিয়োগ দেবে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের তেমন ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকবে না।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে

সুনির্দিষ্টভাবে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে শুধু রাষ্ট্রপতির কাছে কয়েকটি নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই পদগুলো হলোÑবাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা, তথ্য কমিশনের প্রধান তথ্য কমিশনার ও কমিশনাররা, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা, আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা এবং বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা।

জরুরি অবস্থা জারির ক্ষেত্রেও কেড়ে নেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা। আগে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি এটি করতেন। এখন মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাও আবার বিরোধীদলীয় নেতা/উপনেতার উপস্থিতিতে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে।

পিআর নিয়ে বিরোধের মূল কারণ

দ্বিকক্ষের সংসদ এবং ১০০ আসনে উচ্চকক্ষের ব্যাপারে বিএনপির সম্মতি থাকলেও বিরোধ বেধেছে উচ্চকক্ষের ১০০ আসনের প্রতিনিধি নির্বাচন নিয়ে। বিএনপি চায় সংরক্ষিত মহিলা আসনের মতো সংসদের ৩০০ আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধি নির্বাচন হবে। জামায়াত ও এনসিপি চায় সারা দেশে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে (পিআর পদ্ধতি) উচ্চকক্ষে প্রতিনিধি নির্বাচন হবে। কমিশন বিএনপির আপত্তি উপেক্ষা করে পিআর পদ্ধতির পক্ষে গেছে। এখানে বিএনপি বড় আরেকটি সমস্যা দেখছে। এর কারণ, এখন কোনো দল সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেলেও সংবিধান সংশোধন করতে পারবে না দুই কারণে। এক. দলের যেকোনো এমপি সংবিধান সংশোধন বা অন্য যেকোনো বিলে দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবে। সংবিধানের বহুল আলোচিত ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে অর্থবিল ও অনাস্থা প্রস্তাব ছাড়া সব ক্ষেত্রে এমপিরা স্বাধীনভাবে নিজের মতো করে ভোট দিতে পারবেন। আগে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দেওয়া যেত না। সংবিধান সংশোধনে বড় সমস্যা দেখা দিতে পারে আপার হাউস বা সিনেটে। বলা হয়েছে, নিম্নকক্ষের দুই-তৃতীয়াংশের পাশাপাশি সিনেটের সিঙ্গেল মেজরিটি লাগবে সংবিধান সংশোধন করতে। অন্য বিলের ক্ষেত্রে সিনেটের অনুমতির কথা বলা হলেও সিনেট অনুমতি না দিলেও নির্দিষ্ট সময় পর বিল পাস হয়ে যাবে। কিন্তু সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে সিনেটের অনুমতি ম্যান্ডেটরি করা হয়েছে। একইভাবে জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তা প্রভাবিত করে এমন সব আন্তর্জাতিক চুক্তিও সংসদের উভয় কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে অনুমোদন করতে হবে।

উচ্চকক্ষে কোনো দলের সিঙ্গেল মেজরিটির সম্ভাবনা কম

বাংলাদেশের বাস্তবতায় পিআর পদ্ধতিতে কোনো দলেই সিনেটে মেজরিটি হওয়ার সুযোগ কম। কারণ ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ ভোট বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ছিল। ফলে কেউ নিম্নকক্ষে ২০০ আসনের পাশাপাশি দেশের মোট প্রদত্ত ভোটের ৫০ শতাংশ না পেলে এককভাবে সংবিধান সংশোধন করতে পারবে না।

বিদ্যমান সংবিধানে শেখ হাসিনা গণভোটের বিধান বাতিল করে দিয়েছিলেন। ঐকমত্য কমিশন এটি ফিরিয়ে এনে প্রস্তাব দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাও ফিরিয়ে আনা হয়েছে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে। এই দুটি বিষয়ে বিএনপি একমত হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের একটি উপধারায় বিএনপির জোর আপত্তি ও নোট অব ডিসেন্ট উপেক্ষা করেছে কমিশন। এই উপধারায় বিভিন্ন অপশনের একপর্যায়ে র‌্যাংক চয়েজ পদ্ধতিতে প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্য এক জায়গায় প্রধান উপদেষ্টার অনুপস্থিতিতে একইভাবে নতুন প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের কথা বলা হয়েছে।

মৃত্যুদণ্ড বা অন্য দণ্ডপ্রাপ্তদের রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের বিষয়েও আগে ক্ষমতা ছিল মূলত প্রধানমন্ত্রীর। এখন সিদ্ধান্ত হয়েছে আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে এটি করতে হবে। এছাড়া ভিকটিমের পরিবারের সম্মতি লাগবে।

সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ এখন মূলত সরকারে বা প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছানুযায়ী হয়। এটি প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি স্বাধীন কমিশনের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানেও বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে বলেছিল, তারা চায় একটি আইন প্রণয়ন করে তার মাধ্যমে বিচারক নিয়োগ করতে। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক নিয়োগ-সংক্রান্ত বিধানকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে বলেছিল সংবিধানে নয়, আইন প্রণয়ন করতে। স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিসের ব্যাপারেও বিএনপি আপত্তি জানিয়েছিল। কিন্তু এগুলো কিছুই আমলে নেওয়া হয়নি।

আরো কিছু বিষয়ে মতৈক্য

বিএনপি নেতারা বলছেন, ৬ সংস্কার কমিশনের অসংখ্য প্রস্তাবে তারা সায় দিয়েছেন। এমনকি ৮৫টি মূল সংস্কার প্রস্তাব, যার মধ্যে ৪৮টি সংবিধান-সংশ্লিষ্ট। সব মিলে মাত্র সাত-আটটিতে তারা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছেন। বাকিগুলোতে তারা সম্মতি দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ১০ বছরের বেশি ক্ষমতায় না থাকা, সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগকে পুরো স্বাধীন করে দেওয়া, গুরুত্বপূর্ণ চারটি সংসদীয় কমিটির প্রধান বিরোধী দল থেকে করা, স্পিকারের নেতৃত্বে কমিটি থেকে নির্বাচন কমিশন করা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে এমপিদের স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার অধিকার, রাষ্ট্রপতির হাতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ, জরুরি অবস্থা জারির ক্ষেত্রে সবার মতামত গ্রহণসহ অসংখ্য সংস্কার প্রস্তাবে সায় দিয়েছে বিএনপি।

এছাড়া বিরোধী দল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ, বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ, প্রতি বিভাগে হাইকোর্টের বেঞ্চ ও উপজেলায় আদালত স্থাপন, স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সিদ্ধান্ত সরকারের কাছ থেকে ইসির কাছে স্থানান্তরের মতো বিষয়ে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে।

বিএনপি বলেছে, রাষ্ট্রপতি জুলাই আদেশ জারি করবেন এবং অধ্যাদেশ জারি করবেন। কিন্তু প্রস্তাবে সরকারকে প্রকারান্তরে ড. ইউনূসকে এই সাংবিধানিক আদেশ জারির কথা বলা হয়েছে। জামায়াত ও এনসিপি এর পক্ষে। সাংবিধানিক সংস্কারের ব্যাপারে সংসদ নির্বাচনের আগেই গণভোটের ব্যাপারেও বিএনপি রাজি ছিল না। তবে শেষ পর্যন্ত একই দিনে সংসদ ও গণভোটে তারা সায় দিয়েছে। জামায়াত বলছে, তারা সংসদ নির্বাচনের আগে নভেম্বরেই গণভোট চায়। ঐকমত্য কমিশন এই একটি কার্ড হাতে রেখে দিয়েছে ড. ইউনূসের। বলেছে, গণভোট কবে হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। যদি বিএনপির দাবি মেনে নিয়ে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনেও আয়োজন করা হয়, তাতেও বিএনপির জন্য নোট অব ডিসেন্টের বাইরে গিয়ে বিনাবাক্য ব্যয়ে সব সংস্কার প্রস্তাব কবুল করা সম্ভব হবে কি নাÑতা সময়ই বলে দেবে। হয় সব কবুল করে নির্বাচন, নতুবা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নয়। এমনকি আরেকটি ওয়ান-ইলেভেনের জন্য বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। এমন এক নার্ভের খেলায় সরকার ও বিএনপি এখন মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।

জাহেদ চৌধুরী
লেখক : ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, আমার দেশ