Image description
 

জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একের পর এক নতুন পরিভাষা উঠে এসেছে—জুলাই ঘোষণাপত্র, জুলাই সনদ, ঐকমত্য কমিশন, রিফর্ম কমিশন, গণপরিষদ, পিআর, এমনকি ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ পর্যন্ত। কিন্তু এই শব্দগুলো দেশের সাধারণ জনগণের কাছে একেবারেই অপরিচিত। এমনকি শিক্ষিত সমাজের বড় অংশেরও এসব টার্ম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই।

 

সম্প্রতি এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে জুলাই সনদের ওপর রেফারেনডাম বা গণভোট আয়োজনের আলোচনা। কেউ একে জনগণের মতামতের প্রতিফলন বলছেন, কেউ দেখছেন রাজনৈতিক বৈধতা অর্জনের কৌশল হিসেবে, আবার কিছু রাজনৈতিক দল রাজপথে নেমে আন্দোলনের হুমকিও দিচ্ছেন।

প্রশ্ন হলো—এই জুলাই সনদ আসলে কী?কেন এটি নিয়ে এত আলোচনা? ২৪-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আলোচিত শক্তি এনসিপি (জাতীয় নাগরিক পার্টি) জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাঁকজমকভাবে বিএনপি, জামায়াত সহ ২৫ টি দলগুলোকে নিয়ে সনদে স্বাক্ষর করেছেন।

এই সনদে মোট ৮৪টি প্রস্তাবনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর মূল কাঠামো এসেছে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গঠিত ১১টি রিফর্ম বা সংস্কার কমিশনের মধ্য থেকে ৬টি কমিশনের দেওয়া প্রস্তাবনা থেকে। পরবর্তীতে এবছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দীর্ঘ সংলাপের মাধ্যমে এটিকে চূড়ান্ত রূপ দেয়।   

এ সনদের তৈরিতে প্রায় এক ডজনেরও বেশি মৌলিক বিষয়ে বিএনপিসহ বেশ কিছু দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে—অর্থাৎ তারা কিছু ধারার সঙ্গে প্রকাশ্যে দ্বিমত জানিয়েছে। ফলে এই সনদ যে সর্বজনীন ঐকমত্যের দলিল নয়, তা ইতোমধ্যেই স্পষ্ট।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষণা দিয়েছে রাজনৈতিক দল গুলো ক্ষমতায় আসার দুই বছরের মধ্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে; এ বিষয়ে ৭ দফা অঙ্গীকারে স্বাক্ষর করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু এখানেই মূল বিতর্ক—এই সরকার নিজেই কোন সাংবিধানিক কাঠামোর অধীনে পরিচালিত হচ্ছে?

 

 

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহাদীন মালিকের মতে, সংবিধান সংশোধন বা সংস্কারের একমাত্র বৈধ পথ সংসদীয় প্রক্রিয়া। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরাই সংবিধান পরিবর্তনের অধিকার রাখেন। যেহেতু সকল প্রস্তাবনার সাথেই সাংবিধানিক রিফর্মেশনর একটা যোগসূত্র রয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বর্তমান সংবিধান বিরোধী প্রস্তাব করা হয়েছে। তাই একটি রিফর্ম কমিশন—যার সদস্যরা নিযুক্ত, নির্বাচিত নয়—তারা সংবিধান রূপান্তরের বৈধতা রাখে না। এই যুক্তিতে বলা যায়, রিফর্ম কমিশনের তৈরি জুলাই সনদ আইনি ও নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি ভবিষ্যতে যদি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা না দেন, তবে তার গৃহীত সব সিদ্ধান্তই অবৈধ ঘোষিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো—এই পুরো আলোচনায় জনগণ কার্যত অনুপস্থিত। রেফারেনডাম আয়োজনের আগে মানুষকে জানানো দরকার ৮৪টি প্রস্তাবনা, ৩০ টি ধারা ও ৭টি অঙ্গীকারনামায় কী বলা আছে, তা তাদের জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলবে। কিন্তু বাস্তবে নাগরিকদের অধিকাংশই এসব বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তাই রেফারেনডাম আয়োজন হলেও তা হবে অজ্ঞ ভোটের প্রতিফলন—যেখানে দলীয় প্রভাব, প্রচারণা ও বিভ্রান্তি ভোটের ফল নির্ধারণ করবে, জনগণের সচেতন মত নয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সম্প্রতি সতর্ক করেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের সময় সহিংসতার জন্য মুখিয়ে আছে। তার কথার সূত্র ধরে বলতে হয়, বাস্তবতা হচ্ছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল নয়; এমন অবস্থায় রাজনৈতিক সংঘাত   এড়ানো আসলেই কঠিন হবে।

 

অপরদিকে, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করতে হলে সহিংসতা থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া বিকল্প নেই। ফেব্রুয়ারির আগে সম্ভাব্য রেফারেনডাম বা গণভোট  এক ধরনের পরিক্ষামূলক হিসেবে কাজ করতে পারে যা নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা যাচাইয়ের সুযোগ দেবে। তবে রেফারেনডাম যদি সত্যিকার অর্থে জনমতের প্রতিফলন হতে চায়, তাহলে জনগণকে বিষয়বস্তুর সঠিক ধারণা দিতে হবে। না হলে এটি কেবল রাজনৈতিক বৈধতা অর্জনের কৌশল হিসেবেই দেখা দেবে।

বাংলাদেশে আইনের লিখিত ধারা যতটা স্পষ্ট, তার প্রয়োগ ততটাই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত। আইন ও সংবিধান ব্যাখ্যা হয় ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে; বিচার হয় সিলেক্টেভলি বা নির্বাচিতভাবে। এই সংস্কৃতির মূল উৎস ক্লায়েন্টিলিজম যেখানে রাজনীতিবীদ, ব্যবসায়ী, আইনজীবী,  সাংবাদিক ও বিভিন্ন পেশাজীবীরা পরস্পরের ওপর নির্ভর করে লাভবান হয়। ন্যায়বিচারকে প্রভাবিত করে, আর আইনের প্রয়োগ নির্ভর করে ক্ষমতা প্রদর্শনের উপর ভিত্তি করে। ২৪-পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক দলগুলো আইনি সংস্কার ও সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তাদের আচরণে দেখা যাচ্ছে পুরোনো অসহিষ্ণুতা ও কূটনীতিক স্বার্থরক্ষা। ফলে ন্যায়বিচারের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার যে আশা ছিল, তা এখনো পূরণ হয়নি, বরং জনগণের মাঝে হতাশা সৃষ্টি হচ্ছে। 

বাংলাদেশ এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। জনগণের আস্থা ও অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না। যদি জুলাই সনদ, রিফর্ম কমিশন, বা রেফারেনডাম—সবই রাজনৈতিক ছলচাতুরীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা জনগণের নয়, কেবল ক্ষমতার খেলা হিসেবেই ইতিহাসে জায়গা পাবে।

নৈতিক ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ ছাড়া রাষ্ট্র টেকসই হয় না। সম্প্রতি দক্ষিণপন্থীদের উত্থান, অসহিষ্ণু রাজনীতি ও বিভক্ত সমাজ ব্যবস্থা; বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। রাজনীতিকে যদি সত্যিই জনগণের কাছে ফিরিয়ে আনতে হয়, তবে সংলাপ, স্বচ্ছতা, ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। জুলাই সনদ বা সংবিধান; সবকিছুর উপরে থাকতে হবে জনগণের স্বার্থ ও নাগরিক চেতনা।

লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক