বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবারও আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা চলছে। এক দশক আগে যেটি সংবিধান থেকে মুছে দেওয়া হয়েছিল, সেটি আজ আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আদালত, সংসদ ও রাজপথে সমানতালে ঘুরছে এই প্রশ্ন নির্বাচনের সময় কে থাকবে ক্ষমতায়? বর্তমান পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আবার ফিরে আসবে কিনা তা নিয়ে রাজনীতির মারপ্যাঁচে পড়ে গেছে। বিষয়টি এখন উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের পরবর্তী শুনানি আজ মঙ্গলবার ধার্য করেছেন সর্বোচ্চ আদালত। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে হাইকোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার আপিল শুনানি শেষে এই তথ্য জানিয়েছেন আইনজীবী শিশির মনির।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে রাজনীতিবিদ ও আইনজীবীরা তাদের মতামত তুলে ধরেছেন। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরশেদ জনণ্ঠকে বলেন, আমার এনালাইসিস হলো এখন রাজনীতি চাল চলনে যা মনে হয় এটার মধ্যে একটা রাজনীতি ঢুকে গেছে। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেউ চায় বিএনপি বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এরাই হয়ে যাক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রায় কিন্তু এখন চায় না। অন্তর্বর্তী সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকার হয়ে যাক।
ওই রায়ের দিকে তাদের দৃষ্টি নাই। ইউনূস সাহেবই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে থাকুক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলে তো ইউনূস সাহেব থাকতে পারেন না। উনার বয়সতো এলাউ করে না। যার ফলে এখন রাজনৈতিক দলগুলো যারা ইউনূস সাহেবের সমর্থক আছেন তারা এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইবে কিনা এটা একটা প্রশ্ন। তত্ত্বাবধায়ক আসবে কিনা রাজনীতির মারপ্যাঁচে পড়ে গেছে।
পুরনো ব্যবস্থার নতুন বিতর্ক ॥ ১৯৯৬ সালে জনগণের দাবিতে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। তিনটি জাতীয় নির্বাচন ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ এই ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। সেই সময় দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মতে, ওই তিন নির্বাচন তুলনামূলকভাবে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু ২০১১ সালে উচ্চ আদালতের রায় ও সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা বাতিল করে সরকার। তখন যুক্তি ছিল-গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকা সংবিধানের চেতনার পরিপন্থি। আজ, ২০২৫ সালে এসে সেই বিতর্ক আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিরোধী দলগুলো বলছে, বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনই এখন একমাত্র গ্রহণযোগ্য সমাধান।
আদালত যা বলেন ॥ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরলে সংসদের ক্ষমতাকে খর্ব করবে কিনা, তা জানতে চেয়ে প্রশ্ন রেখেছেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরাতে আপিল বিভাগে দ্বিতীয় দিনের শুনানিতে গত ২২ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি এ প্রশ্ন তোলেন। এ সময় আদালতে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে দিয়ে ১৪তম জাতীয় নির্বাচন থেকে তা কার্যকর চেয়ে আপিল বিভাগে শুনানি করেন।
বিরোধী দলের অবস্থান ॥ বিরোধী দলগুলো দাবি করছে, জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হলে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া বিকল্প নেই। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘বর্তমান সরকারকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা নিতে হবে। প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ তৈরি করতে হবে।’ বিএনপিসহ কয়েকটি দলও বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নিরপেক্ষ ভোট সম্ভব নয়। তারা মনে করে, নির্বাচনের আগে সরকারকে পদত্যাগ করে নির্দলীয় প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা দিতে হবে।
আইনজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের মত ॥ আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিতর্কের মূলে রয়েছে রাজনৈতিক আস্থার সংকট। কেউ কেউ মনে করেন, সংবিধান সংশোধন ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। আবার অনেকে বলছেন, রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি হলে সাংবিধানিক সমাধান খোঁজা যেতে পারে।
এক জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর ভাষায় ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরুক বা না ফিরুক মূল প্রশ্ন হলো জনগণের আস্থা। যদি রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে না পারে, তবে যে ব্যবস্থাই আসুক, সংকট থেকেই যাবে।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এখনকার আলোচনায় জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ছে। অনেকেই বলছেন, ‘এটি শুধু নির্বাচনের প্রশ্ন নয়; এটি গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের প্রশ্ন।’
ভূমিকা নিতে হবে সরকারকে ॥ বর্তমান সরকারকে এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। গত শুক্রবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির ‘গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন ও নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিতকরণ’ স্লোগান এক সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা জরুরি। তাহলেই গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা ও একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব হবে।
বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়নি ॥ বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়নি, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষ ভূমিকা চেয়েছে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। গত বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। আইন উপদেষ্টা বলেন, আমি বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় যেটা বুঝেছি, উনারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাননি। অন্তর্র্বর্তী সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে সেটা বলেছে। তারা আমাদের কাছ থেকে নিরপেক্ষ ভূমিকা চেয়েছে।অন্তর্র্বর্তী সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকাই পালন করছে জানিয়ে তিনি বলেন, নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করার নিশ্চয়তা প্রধান উপদেষ্টা দিয়েছেন। জনপ্রশাসন বা অন্যান্য ক্ষেত্রে বড় বদলির ব্যাপারটা উনি নিজে দেখবেন।
নির্বাচনের সময় উপদেষ্টা পরিষদ ছোট হবে কিনা জানতে চাইলে ড. আসিফ নজরুল বলেন, এ ধরনের কথা কোথাও আলোচনা হয়নি। এটা উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনার বিষয়। নির্বাচনকালীন সরকার ছোট হবে কিনা এ ধরনের কোনো দাবিও কোনো মহল থেকে উত্থাপন হয়নি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় যেতে হবে ॥ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার কাছে এসেছিলাম আমাদের কতগুলো রাজনৈতিক কনসার্ন নিয়ে কথা বলার জন্য। বিশেষ করে, আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সেই নির্বাচনকে অর্থবহ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে এই মুহূর্তে যেটা প্রয়োজন, অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে নিতে হবে। অর্থাৎ একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় তাদের যেতে হবে। এ জন্য প্রথমেই যেটা প্রয়োজন হবে, প্রশাসনকে পুরোপুরিভাবে নিরপেক্ষ একটা ধারণা জনগণের মধ্যে তৈরি করতে হবে।’
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
ফিরে দেখা ॥ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়। এর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৮ সালে অ্যাডভোকেট এম সলিম উল্লাহসহ তিন জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট রুল জারি করেন। তবে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট চূড়ান্ত শুনানি শেষে রিটটি খারিজ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।
পরে ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করা হয়। আদালত এ মামলায় আট জন অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) নিয়োগ করে তাদের মতামত শোনেন। তাদের মধ্যে পাঁচজন সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। তারা হলেন- ড. কামাল হোসেন, টিএইচ খান, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ও ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ। অপর অ্যামিকাস কিউরি ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কেসি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে মত দেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক ও ড. এম জহির তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের পক্ষে মত দিয়ে তাদের প্রস্তাব আদালতে তুলে ধরেন।
এ ছাড়া তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মত দেন। এরপর আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় এবং ৩ জুলাই গেজেট প্রকাশিত হয়। এরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচন আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। তবে এরই মধ্যে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বর্তমানে নিষিদ্ধ দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয়।
সরকার পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরাতে আপিল বিভাগের ২০১১ সালের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে ২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট প্রথম আবেদন করেন বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। বাকিরা হলোন- তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজউদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান। পরবর্তী সময়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একই বছরের ১৬ অক্টোবর এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার গত বছরের ২৩ অক্টোবর পৃথকভাবে পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন।
এছাড়া নওগাঁর রানীনগরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনও একই ধরনের আবেদন জানান। ফলে রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিগতভাবে মোট চারটি রিভিউ আবেদন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানিতে ওঠে। সেসব আবেদনের শুনানি নিয়ে ২৭ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি দেন আপিল বিভাগ। পুনরায় এ বিষয়ে আপিল শুনবেন বলে জানান আদালত। এরই ধারাবাহিকতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত মামলাটি পুনরায় আপিল বিভাগের শুনানিতে ওঠে।