
আগে এক লেখায় বলেছিলাম, জাতীয় পার্টিকে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হবে এবং তাদের সুযোগ আসবে। জাতীয় পার্টির (জাপা) ভাগ্যের চাকা সম্ভবত আবার নড়তে শুরু করেছে। দলটিকে নানাভাবে বাতিলের তালিকায় ছুড়ে দিয়েছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। সরকারও জাপাকে নিষিদ্ধ করবে করবে করে শেষমেশ নানা কারণে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। ঘরের বাতিল জিনিসও কখনো কখনো কাজে লেগে যায়, আবার ঘষেমেজে ঘরে তোলা হয়। জাতীয় পার্টির অবস্থাও হয়েছে তা-ই।
এর আগে জাতীয় পার্টির ভাঙাভাঙির কাজটা সম্পন্ন হয়ে গেছে। চেয়ারম্যানের পদ একটা। দুজন জ্যেষ্ঠ নেতা চেয়ারম্যান হতে চাইছিলেন—জি এম কাদের ও আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। অনেক রকম সমাধান ছিল। যা হোক, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। দলটা দুই ভাগ হয়ে গেল। যাঁরা আফসোস করছেন, তাঁদের জন্য বলে রাখি, এটা জাতীয় পার্টির ষষ্ঠতম ভাঙন। আগের ভাঙনগুলো ছিল এই রকম—মঞ্জু (১৯৯৬), নাজিউর (১৯৯৯), মতিন (২০০৩), জাফর (২০১৩), রওশন (২০২৪)। আশা করি, সব ভাঙনের হিসাব মিলেছে।
জি এম কাদের ও আনিসুল ইসলাম কে দলের কত অংশ ভেঙে নিতে পারলেন, সাংবাদিকেরা বসে তার হিসাব-নিকাশ শেষ করার আগেই গণ অধিকার পরিষদের নুরুল হক নুরের কর্মসূচিকে ঘিরে একটা বড় অঘটন ঘটে গেল। নুরুল হকের গণ অধিকার পরিষদ জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে জাপার প্রধান কার্যালয়ের সামনে একটা মিছিল করল, তাতে একটা হাঙ্গামা বেঁধে গেল।
ইটপাটকেল, লাঠিসোঁটা সবকিছুর চর্চা হলো। নুরের দল জন্ম নিয়েছিল গণ-অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে—হাসিনার দোসর জাপাওয়ালাদের রাজনীতি করার অধিকার মানতে তারা নারাজ। হাঙ্গামার দ্বিতীয় দিনে নুর গুরুতর আহত হলেন। তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো। সরকারও ছিল দারুণ চাপের মুখে। দাবি উঠল, শুধু ‘ফ্যাসিস্ট’ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করলে হবে না, তাদের ভাইবেরাদার, নাতি-পুতিদেরও নিষিদ্ধ করতে হবে। জাতীয় পার্টির সদ্য প্রসূত দুই ভাগেই ‘ফ্যাসিস্টদের’ মন্ত্রী-যন্ত্রী আছে।
নির্বাচনে জাতীয় পার্টির জন্য আওয়ামী লীগের ২০ শতাংশ ভট বেঁধে রাখা আছে। অনেকেই মনে করেন নির্বাচনের বাইরে থাকা আওয়ামী লীগের এই ভোট হুড়মুড় করে জাতীয় পার্টির বাক্সে চলে আসবে। তার সঙ্গে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে যদি আরও কিছু ভোট যোগ করা যায়! রংপুরে জাতীয় পার্টির ভোট ব্যাংক নাই হয়ে গেছে এমন তো নয়।
কাকে রেখে কাকে নিষিদ্ধ করা হবে? তার ওপর আছে ফ্যাসিস্টদের ১৪ দলের সাথিরা। আইনের ব্যাপার, এত সব দল নিষিদ্ধ করা কি ভালো দেখাবে? আর সরকার নিষিদ্ধ করতে চাইলেই কি পারবে? আশপাশে বিদেশে কত মুরুব্বি আছেন। তাঁরা বলেন, ‘সব দল নিষিদ্ধ হয়ে গেলে মানুষ ভোট দেবে কাকে?’ তাঁদের কথায়ও যুক্তি আছে। বিএনপিও রাজি নয়। ‘উত্তরপন্থী’ সব দল যদি নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে তারা জোট করবে কার সঙ্গে?
বেচারা নুর! আওয়ামী আমলে ছাত্রলীগাররা তাঁকে যেখানেই দেখত, তাঁর ওপর হামলা করত। কতবার যে রাস্তার রিকশাওয়ালারা তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে রেখে গিয়েছিলেন! দুঃখের বিষয়, সেখানে নুরকে এখনো আসতে হচ্ছে!
নুরই শুরু করেছিলেন কোটাবিরোধী আন্দোলন। তাঁর পেছনে যাঁরা স্লোগান দিতেন, তাঁরা এখন বড় নেতা হয়ে গেছেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণও করছেন। তাঁর কথা এখন কারও মনে নেই। যাই হোক, নুর আবার সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছেন। আপনারা যদি ভাবেন, নুরের দল এ ঘটনা থেকে অনেক পাবলিসিটি পেয়েছে, সেটা নিশ্চয় মিথ্যা নয়। তবে এ জন্য নুরুল হককে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে।
কিন্তু আসল জিতটা হলো কার? অনেকেই বলছেন, জি এম কাদেরের। কীভাবে? তার ফিরিস্তি অনেক লম্বা।
ভাঙনের পর সবাই ধরে নিয়েছিল, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলামের ভাগটাই হয়ে যাবে আসল জাতীয় পার্টি। হাজার হোক, জাপার সব বড় নেতা জোট বেঁধেছেন তাঁর সঙ্গে। তাঁর প্রোফাইলও ভালো। তিনি দুই দুইবার মন্ত্রী ছিলেন বিরোধী দল থেকে। কিন্তু নুর নিষিদ্ধের দাবি নিয়ে আঙুল তুললেন জি এম কাদেরের দিকে। তাতেই সবাই হুড়মুড় করে জি এম কাদেরকেই আসল জাতীয় পার্টি বানিয়ে দিলেন। হাজার হোক রক্তের সম্পর্ক, জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আপন ছোট ভাই।
শুধু নুর নন, পরবর্তী সময়ে পুলিশও তাদের পুরোপুরি স্বীকৃতি দিয়ে দিল কাকরাইল অফিসের সামনের সভায় লাঠিপেটা করে! সভার কথা বলতে গেলে, অফিসটা কাকরাইল না হয়ে নয়াপল্টন রোডে হলে পুলিশ হয়তো ছাড় দিত। সেখানে বিএনপির কত ছোট-বড় সভা হরদম হচ্ছে।
ভাঙনের পর আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার ভেবে পাচ্ছিলেন না, কীভাবে দলের কেন্দ্রীয় অফিসটা তাঁদের দখলে নেবেন। দখল না পেয়ে একদিকে ভালোই হয়েছে। কে চায় এসব ইটপাটকেল, লাঠি পেটাপেটির মধ্যে অফিস করতে? মাঝখানে লাভটা হলো জি এম কাদেরের। ঝামেলা ছাড়াই দখল পেয়ে গেলেন জাতীয় পার্টির অফিস বিল্ডিংটা।
সব ক্রেডিট আবার জি এম কাদেরকে দিলে অন্যায় হবে। তাঁর মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী চৌকস লোক। টিভিতে কথা বলেন ঠান্ডা মাথায়।
জনসংযোগেও আস্তে আস্তে জি এম কাদেরের দল এগোচ্ছে। জি এম কাদের বলেছেন, কারও শক্তি নেই তাঁদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখার। রাজনৈতিক পণ্ডিতেরাও তা-ই বলছেন। সরকারের পক্ষে সম্ভব হলে নুর হাসপাতালে থাকতেই জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হতো।
জাতীয় পার্টি নির্বাচনমুখী দল। আওয়ামী লীগের সময়ে কত কত বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করল, কিন্তু জাতীয় পার্টি কখনো করেনি। এখন গণতন্ত্রের সময়, নির্বাচনে করার জন্য ভালো পরিবেশ—সব দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। তা ছাড়া সনদের বিবাদে জাতীয় পার্টি ছিল না, কেউ তাদের ডাকেওনি। সুতরাং অনেক কঠিন প্রশ্ন তারা এড়িয়ে যেতে পারবে। তাই বলে নির্বাচন তাদের জন্য একদম ঝামেলাবিহীন হবে, তা ভাবার কারণ নেই। কিছু জায়গায় প্রার্থীদের ওপর শারীরিক লাঞ্ছনা হতে পারে, দোসরের লিস্ট থেকে নাম কাটাতে চাঁদা দিতে হতে পারে। এসব ঝামেলা সব ইলেকশনেই কমবেশি হয়ে থাকে।
নির্বাচনে জাতীয় পার্টির জন্য আওয়ামী লীগের ২০ শতাংশ ভোট বেঁধে রাখা আছে। অনেকেই মনে করেন নির্বাচনের বাইরে থাকা আওয়ামী লীগের এই ভোট হুড়মুড় করে জাতীয় পার্টির বাক্সে চলে আসবে। তার সঙ্গে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে যদি আরও কিছু ভোট যোগ করা যায়! রংপুরে জাতীয় পার্টির ভোট ব্যাংক নাই হয়ে গেছে এমন তো নয়।
বেশ কয়জন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞ এরই মধ্যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, জাতীয় পার্টিই হবে প্রধান বিরোধী দল। জাতীয় পার্টিও সম্ভবত তা-ই চায়। সরকারি দল কারা হবে, তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। জি এম কাদের ও জাতীয় পার্টির জন্য কীভাবে যেন সব মিলে যাচ্ছে!
-
সালেহ উদ্দিন আহমদ লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক