Image description
 

১৯৭০-এর দশকের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন চীনে সফর করেছিলেন। অনেকেই বিশ্বাস করেছিল, চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা গেলে শক্তিশালী জোট এবং পারস্পরিক সুবিধার পথ খুলবে।

তখনকার ধারণা ছিল, একটি সমৃদ্ধ চীন উদার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে মিলিত হবে। অর্থনৈতিক আন্তনির্ভরতা রাজনৈতিক সমন্বয় আনবে। পশ্চিমারা ভেবেছিল, চীনের উত্থান হুমকি নয়, বরং সুযোগ।

রাজনৈতিক তাত্ত্বিক জন মিয়ারশাইমার সতর্ক করেছিলেন, অর্থনৈতিক আন্তনির্ভরতা দেশগুলোকে কৌশলগত ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ব্যাপারে তিনি ইঙ্গিত করেছিলেন। মিয়ারশাইমার বলেছিলেন, অর্থনৈতিক সংহতির বিষয়টি থাকুক বা না থাকুক, একটি উদীয়মান শক্তি স্বাভাবিকভাবেই প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করবে।

আজ এই বিতর্ক ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিভাজনের প্রতিফলন। চীন ও রাশিয়া মিলিত হয়ে পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে। পশ্চিমা বৈদেশিক নীতির একটি মৌলিক ভুলকে উন্মোচন করেছে।

একটি বদ্ধ ও বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র থেকে চীন বৈশ্বিক অর্থনীতির মহাশক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এর শুরুতেই চীনের নেতৃত্ব ও মতাদর্শে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছিল। ১৯৭৬ সালে চীনের কিংবদন্তি কমিউনিস্ট নেতা মাও সে–তুংয়ের মৃত্যুর সময় দেশটি দরিদ্রপীড়িত ও কৃষিভিত্তিক ছিল। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বিশৃঙ্খলা তখনো সমাজে দৃশ্যমান।

মাওয়ের স্ত্রীর নেতৃত্বাধীন চারজনের দল দেশটিকে আরও গভীর সংকটে ফেলে দেয়। তারা আদর্শগত কঠোরতা ও নীতিবদ্ধ বিশুদ্ধতাবাদের মাধ্যমে ক্ষমতা সংহত করেছিল। তারা গ্রেপ্তার হওয়ার পরই চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো সদস্যদের মধ্যে বাস্তববাদী একটি গোষ্ঠী দেশকে স্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা নেন। দেং জিয়াওপিংকে মুক্তি দেওয়া হয়। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় তিনি মাওয়ের নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। দেং জিয়াওপিংকে লক্ষ্য ছিল চীনকে আধুনিয়াকায়নের পথে নিয়ে যাওয়া।

দেং জিয়াওপিংয়ের নেতৃত্বে চীন মাওবাদী মতাদর্শ থেকে বাস্তব অর্থনৈতিক সংস্কারের দিকে এক গভীর পরিবর্তনের সূচনা করে, যা আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম বিস্ময়কর অর্থনৈতিক রূপান্তরের পথ তৈরি করে।

ফলে বর্তমানে ভূরাজনৈতিক মানচিত্রও বদলে গেছে। চীন ও রাশিয়ার নতুন অক্ষ গড়ে উঠেছে। এই শক্তি পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে। অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা এ জোটকে শক্তিশালী করেছে। এটি পশ্চিমাদের অদূরদর্শী আর্থিক লক্ষ্য ও রাজনৈতিক উদারতার ওপর ভুল অনুমানের ফল।

দেংয়ের দর্শন ছিল বাস্তবধর্মী। তিনি বলতেন, ‘পাথর অনুভব করে নদী পার হতে হয়।’ তিনি চীনের দরজা পশ্চিমের বিনিয়োগ ও সহযোগিতার জন্য খুলে দেন। রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি ভেঙে বাজারভিত্তিক সংকর মডেল আনেন। পশ্চিমা কোম্পানির জন্য চীনের বিশাল বাজার ও সস্তা শ্রমশক্তি ছিল প্রধান আকর্ষণ। ফলে বহু কারখানা পশ্চিম থেকে চীনে চলে আসে এবং কোটি কোটি ডলার মুনাফা হয়।

দেং বলতেন, ‘ধনী হওয়া গৌরবজনক।’ এ ধারণা সাধারণ চীনা নাগরিকদের মানসিকতা বদলে দিল। মানুষ শ্রমের ক্লান্তি থেকে ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি অর্জনের দিকে মন দিল। পলিটবুরোর সহকর্মীদের তিনি সময় মেনে চলার জন্য সতর্ক করেছিলেন, যেন যুদ্ধ ও সংকট এসে চীনের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে বিঘ্ন না ঘটাতে পারে।

চীনের অর্থনৈতিক বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ সময়টাতে পশ্চিমারা সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকেই মনোযোগ দিয়েছিল। শীতল যুদ্ধের সময়ে পশ্চিমারা চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারসাম্য আনার জন্য। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন বিশ্বমানচিত্রে পরিবর্তন আনে। যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র মহাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন অনেক পশ্চিমা নেতা বিশ্বাস করলেন, একটি সমৃদ্ধ চীন স্বাভাবিকভাবে গণতন্ত্রের পথ গ্রহণ করবে।

হেনরি কিসিঞ্জার ও জবিগনিউ ব্রেজিনস্কি (মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা) বলেছিলেন, একটি ধনী চীন পশ্চিমের সঙ্গে মিলিত হবে এবং রাশিয়ার উত্থান ঠেকাতে পশ্চিমা জোটের সঙ্গী হবে। তবে জন মিয়ারশাইমার মনে করতেন, এটা অদূরদর্শী ধারণা। চীনকে প্রতিহত করার জন্য নীতি নেওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেছিলেন। অন্যদিকে ব্রেজিনস্কি বলেছিলেন, চীনের ধনী হওয়া মানে এমনিতেই একদিন দেশটি গণতন্ত্র গ্রহণ করবে। বাস্তববাদকে তখন ঢেকে দিয়েছিল উদার আশাবাদ।

আজ দেখা যাচ্ছে, মিয়ারশাইমারের সতর্কতা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। চীন উদার গণতন্ত্র গ্রহণ করেনি। বরং অর্থনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করেছে, সামরিক ক্ষমতা বাড়িয়েছে এবং বিশ্বে তার প্রভাব দেখাচ্ছে। অর্থনৈতিক আন্তনির্ভরতা একসময় শান্তির রক্ষাকবচ হিসেবে দেখা হলেও এখন সেটাকে কৌশলগত ঝুঁকি হিসেবেই দেখা হয়।

ফলে বর্তমানে ভূরাজনৈতিক মানচিত্রও বদলে গেছে। চীন ও রাশিয়ার নতুন অক্ষ গড়ে উঠেছে। এই শক্তি পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে। অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা এ জোটকে শক্তিশালী করেছে। এটি পশ্চিমাদের অদূরদর্শী আর্থিক লক্ষ্য ও রাজনৈতিক উদারতার ওপর ভুল অনুমানের ফল।

জাসিম আল-আজ্জাওয়ি