
আবদুল লতিফ মাসুম
ছাত্ররাজনীতি নিয়ে বিভেদ-বিরোধ আছে। কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো বিরোধ নেই, কোনো বিতর্ক নেই। সচেতন নাগরিক সাধারণ সবাই একমত যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দায়িত্ব পালনের উপযোগী করে তোলার জন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিকল্প নেই। আগেকার প্রবাদটি ছিল এ রকম ‘ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ’। ছাত্রদের একমাত্র তপস্যা অধ্যয়ন করা। পড়াশোনা নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকবে— এটাই ছিল আগের ধারণা। ক্রমেই বদলেছে পৃথিবী। বদলেছে আমাদের সমাজ। এখনকার ছাত্ররা নীরব নিভৃতে শুধু পড়াশোনা করে না। আর আমরা নাগরিক সাধারণ আশা করি, ছাত্ররা আমাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গড়ে তুলবে।
সবাই চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও প্রশাসক হবে না। কেউ না কেউ রাজা হবে, উজির হবে, রাজনীতিবিদ হবে। যদিও রাজনীতির সেই মহৎ শব্দাবলি হারিয়ে গেছে। সম্পদের কর্তৃত্বপূর্ণ বণ্টনই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাজনীতির লক্ষ্য। সুতরাং ক্ষমতা এবং অর্থবিত্ত আজকে রাজনীতির বাহন। এখনো সমাজে সেই সনাতন আত্মবাক্যগুলো বলাবলি হয় বটে; কিন্তু ময়দানে তা বাস্তবায়িত হয় না। যাই হোক, ভালো কিংবা মন্দ রাষ্ট্রকে তো কেউ না কেউ পরিচালনা করবে। সুতরাং ছাত্রসমাজের একাংশ অন্যান্য পেশাভিত্তিক কর্ম তৎপরতার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিও করবে—এটাই স্বাভাবিক। তাই সমাগত ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে আমাদের আশাবাদের শেষ নেই।
ইতোমধ্যে দেশের প্রধান প্রধান সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা এসেছে। ঠিক এ সময় নির্বাচনটি সঠিক না বেঠিক, এ নিয়েও বাদানুবাদ আছে। যারা ছাত্র সংসদ নির্বাচন রাজনীতি ঘনিষ্ঠ দেখতে চান এবং সেটি ক্ষমতার বাহন করতে চান, তারা যুক্তি দিচ্ছেন নির্বাচনের জন্য এটি অসময়। জাতীয় নির্বাচনের দোহাই দিলেও তারা চাচ্ছেন রাষ্ট্রক্ষমতায় কারা আরোহণ করেন, তার দিক-দিশা দেখে নির্বাচনের আয়োজন করা। এখানে ক্ষমতাশ্রয়ী রাজনীতির যুক্তিটি ইঙ্গিতবহ। ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো নিয়ে ইতোমধ্যেই সংবাদপত্রে দু-চারটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তাতে একটি সাধারণ প্রবণতা বা ছাত্র-আকাঙ্ক্ষা বা নির্বাচন কৌশল আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। অন্যান্য সময় দলভিত্তিক নির্বাচনের ডামাডোল বাজতে থাকে। অতীতের তেমন কোনো নির্বাচনই রাজনীতি বিশ্লিষ্ট ছিল না। এখন প্রতিবেদনগুলোয় দেখা যাচ্ছে, রাজনীতি বিচ্ছিন্নতাই একটি ইতিবাচক ইস্যু। ছাত্রনেতৃত্বের পরিবর্তে সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে প্যানেল গঠনের প্রক্রিয়া সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার, অধিকাংশ ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের নিজ নামে অথবা তাদের মূল সংগঠনের সরাসরি সমর্থনকে স্পষ্ট করতে চাইছেন না।
প্রথমেই ডাকসু নির্বাচনের দিকে চোখ রাখা যাক। ডাকসুকে বলা হয় মিনি পার্লামেন্ট। পরবর্তী পার্লামেন্টে কারা যাবেন, তার একটি ধারণা বা ইঙ্গিত ডাকসু থেকে পাওয়া যায়। বিদ্বজনরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘বাংলাদেশের রাজনীতির হৃৎপিণ্ড’ বলে মনে করেন। সামগ্রিক অর্থেই ডাকসু নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে অতিমাত্রিক বা দলভিত্তিক বা লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি যে ইতোমধ্যে সাধারণ ছাত্রদের সাধারণ ভাষা হয়ে উঠেছে, ডাকসুর প্রচার-প্রবণতা থেকে এটি স্পষ্ট। সংগতভাবেই এই ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখে বেশি আলোচনা হচ্ছে জুলাই বিপ্লবের সারথিদের গড়া গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ নিয়ে। কয়েক মাস আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সমন্বয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে এই সংগঠনটি গঠিত হয়েছে।
ইতোমধ্যে ভিপি ও জিএস পদে তাদের প্রার্থীও ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত এই গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ নিজেদের নামে প্যানেল ঘোষণা করবে না। ভিন্ন কোনো নামে তারা ডাকসুতে নির্বাচন করবে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সব শিক্ষার্থী যাতে এই প্যানেলের বিষয়ে আগ্রহী হন। এবারের ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে। নানা সূত্র থেকে জানা গেছে, তাদের বেশ শক্ত ভিত্তি রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে তারা এখন নানা অনুষ্ঠানে ব্যস্ত। আগামী সপ্তাহে হল ও ছাত্র সংসদের প্যানেল ঘোষণা করতে পারে ছাত্রশিবির। তাদের প্যানেলের ভিপি, জিএস পদের নামও প্রকাশিত হয়েছে।
তবে নিশ্চিতভাবেই জানা গেছে, শিবির নিজেদের নামে নির্বাচন না করে অন্য নামে অন্য ধামে প্যানেল ঘোষণা করবে। তারা বলছেন, তাদের ব্যাপ্তি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। তারা এই কৌশল নিয়েছে, যত দল ও সংগঠনকে তারা তাদের মধ্যে একীভূত করতে পারবে, ততই তাদের বিজয়ের সম্ভাবনা বাড়বে। দেখা গেল, এখানেও শিবিরের মতো একটি আদর্শিক সংগঠন সাধারণ ছাত্রদের মন জয় করতে চাইছে। গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটও এবারের ডাকসু নির্বাচনে যৌথ প্যানেল ঘোষণা করবে বলে জানা গেছে। যৌথ প্যানেলের মানে হচ্ছে আরো আরো সমমনা ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন নিয়ে লড়াইয়ের চেষ্টা।
তাদের বক্তব্য, গণতন্ত্রমনা যত শিক্ষার্থী ও আন্দোলন-সংগ্রামের যত মুখ আছে, সবাইকে নিয়ে গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের একটি প্যানেলকরণের চেষ্টা করবে তারা। এখানেও একটি জোট বা যৌথ প্যানেলের চেষ্টা লক্ষণীয়। ছাত্র সংগঠন বা তাদের অভিভাবকদের উল্লেখ থাকছে না। তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপি এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলও ডাকসুতে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বড় দল হওয়ার কারণে প্রার্থী নির্বাচনেও তাদের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে। ছাত্রদলের শীর্ষপর্যায়ের একাধিক নেতা বলেছেন, সরাসরি সংগঠনের নামে না হয়ে ভিন্ন একটি নামে প্যানেল হতে পারে।
বড় বড় ছাত্র সংগঠনের স্বনামে স্বধামে নির্বাচনে অবতীর্ণ না হওয়ার প্রবণতাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা এর আগে এই কলামে লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে ছাত্রসমাজের অনীহার কথা উল্লেখ করেছিলাম। আপনাদের মনে করিয়ে দিই যে, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ বেশ সরব হয়ে ওঠে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ নিয়ে সংঘর্ষ পর্যন্ত ঘটে। ক্ষমতাশ্রয়ী ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের স্বনামে অর্থাৎ তাদের অভিভাবকত্বের জানান দিতে চায়। আর সাধারণ ছাত্ররা সেই বিষয়টিকেই তাদের জন্য বিপজ্জনক মনে করে।
আপনাদের আরো মনে করিয়ে দিই, গত কয়েক মাসে পরিচালিত যথার্থ গবেষণাকর্মে, জনমত যাচাইয়ে দেখা গেছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসমাজ রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ চায় না। ডাকসুর প্রচারের মধ্য থেকেও একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। জানা গেছে, দলীয় বিভিন্ন প্যানেলের বাইরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক উমামা ফাতেমার নেতৃত্বে একটি স্বতন্ত্র প্যানেলের আলোচনা চলছে।
উল্লেখ্য, উমামা একসময় ছাত্র ফেডারেশনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সে জন্য বামপন্থি সংগঠনগুলো তাদের প্যানেলে উমামাকে রাখার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু উমামা তাতে সম্মত হননি। এই জনপ্রিয় ছাত্রনেত্রীর অবস্থান ও উদ্যোগ প্রমাণ করে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে কতটা অনীহা প্রকাশ করে। এটি একটি ভালো প্রবণতা যে, এখন পর্যন্ত একটি উন্মুক্ত ও বাধা-বন্ধনহীন পরিবেশে ডাকসু নির্বাচনের অবাধ প্রচার চলছে। সেই সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন যে, যাদের মধ্যে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা আছে, তারা কিছুতেই পরাজয়কে মেনে নেবেন না। তারা নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া বা বানচাল করার মতো ঘটনা ঘটাতে পারে। এই ফ্যাসিবাদী প্রবণতা কোনো সংগঠনের একক দোষ নয়। যেখানে যারা শক্তিশালী, তারাই গায়ের জোরে জয়লাভ করতে চাচ্ছে।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচন কেন্দ্র করেই যে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষ রয়েছে, তাই নয়। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবণতাও অনুরূপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয় জাকসু নির্বাচন। সেখানে আনন্দমুখর পরিবেশে প্রচার চলছে। গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ এককভাবে প্যানেল দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারাও সব মত, সব পথকে একীভূত করার চেষ্টা করছে। শিক্ষার্থীদের তুষ্ট করার জন্য অধিকতর হারে সাধারণ ছাত্রদের সংশ্লিষ্ট করার উদ্যোগ নিয়েছে। ইসলামী ছাত্রশিবিরও সেখানে বেশ তৎপর রয়েছে।
এককভাবে লড়ার চেয়ে তারাও গণঅভ্যুত্থানপন্থি যেকোনো সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে চায়। তারা ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, তাদের প্যানেলে নারী, হিন্দু ও আদিবাসী শিক্ষার্থীও থাকবেন। প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে অন্তত দুটো প্যানেল জাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে পারে বলে জানা গেছে। তারাও তাদের বলয় বাড়ানোর জন্য সচেষ্ট রয়েছে। বড় দলের বড় ছাত্র সংগঠন সেখানে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা বড় হওয়ার কারণে সমস্যাও বড়। অবশেষে যে বা যারাই এ সংগঠন নিয়ে এগোতে যাবে, অবশ্যই তাদের সাধারণ ছাত্রদের সমর্থনপুষ্ট হতে হবে।
এবার আসা যাক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাকসু নির্বাচন নিয়ে। এই নির্বাচন ঘিরে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে নানা তৎপরতার শুরু হয়েছে। ডাকসু ও জাকসুতে যে প্রবণতা দেখা গেছে, সেখানেও একই অবস্থা। সেখানে সব সংগঠন ডান অথবা বাম সবারই কমন কৌশল হচ্ছে ‘সম্মিলিত প্যানেল’। শক্তিশালী ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য প্যানেল গঠনকেই প্রাথমিকভাবে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। সেই আগের মতো ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতানেত্রীর চেয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি অধিকতর গুরুত্ব অর্জন করেছে। ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখগুলো প্যানেলে টানতে নানাভাবে চেষ্টা করছেন ছাত্রনেতারা।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে, ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীদের বাইরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভোটের সমীকরণ পাল্টে দিতে পারেন। ফলে নানা মতের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সম্মিলিত শিক্ষার্থী প্যানেল গঠন করছে ছাত্র সংগঠনগুলো। বিভাগ ও অনুষদভিত্তিক কিছু পরিচিত মুখকে দলে টানতে চেষ্টা করছে ছাত্র সংগঠনগুলো। প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবির রাকসুতে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী’ প্যানেল গঠনের চেষ্টা করছে। সেখানে সব মতের প্রতিনিধিত্ব চায় তারা। তারা বলছেন, ‘আমরা ফ্যাসিবাদবিরোধী শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি সম্মিলিত প্যানেল গঠন করব। এখানে নারী, আদিবাসী, সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীরা প্রতিনিধিত্ব করবেন।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের মোর্চা গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট। এই জোটও সব স্তরের শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্যানেল গঠনের চেষ্টা করছে। এছাড়া বাম ও ডান ধারার অরাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের মতো করে সব শিক্ষার্থীকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছে। তারাও মেধা ও মননের খোঁজ করছেন। এদিকে ছাত্রদল নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তারা গণঅভ্যুত্থানবিরোধী শিক্ষকদের নাম তালিকা প্রকাশ করে তাদের বিচার চাইছে। ছাত্রদল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বলে মনে করে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।
উপর্যুক্ত তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনি প্রচার গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয় যে সাধারণ ছাত্ররা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহী ও আনন্দিত। কিন্তু তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে গরিষ্ঠভাবে বিরোধী। তার সরল অর্থ এই যে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি অনুমোদন করছে না। এসব নির্বাচন অবশেষে হয়তো দেখা যাবে, রাজনৈতিক দল নয়; বরং সাধারণ ছাত্রদের সমর্থিত জোট বা প্যানেল বিজয়ী হবে।
অতীতে বিশেষত ১৬ বছরে ছাত্রলীগ যে ফ্যাসিবাদের নিকৃষ্ট নমুনা শিক্ষাঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করেছে, সাধারণ ছাত্ররা কোনোভাবেই চাচ্ছেন না সেই ধারা, সেই অত্যাচার ও অনাচার ফিরে আসুক। বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতাশ্রয়ী। সুতরাং ক্ষমতার বাহন হিসেবে তারা ছাত্ররাজনীতি বহাল রাখতে চাইবে—এটাই স্বাভাবিক। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা আমরা বলছি না। ছাত্ররাজনীতিকে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির অবসানের কথা বলছি আমরা। নির্বাচিত সরকার এলে তা যে দলেরই হোক না কেন, ছাত্ররাজনীতির লেজুড়বৃত্তির ধারাটি তাদের নিজেদের স্বার্থেই তারা বন্ধ করবে না। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার অনেক সংস্কার করেছে।
ছাত্ররাজনীতির এই লেজুড়বৃত্তি বন্ধে তাদের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তারা ইচ্ছা করলে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতির লেজুড়বৃত্তির অবসান ঘোষণা করতে পারে। যেহেতু তারা রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে। শুধু দেশপ্রেম এবং দেশপ্রেম দ্বারা পরিচালিত, সুতরাং তারাই পারে ছাত্রসমাজের এই অবমূল্যায়নের অবসান করতে। যেহেতু সাধারণ ছাত্রসমাজ লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির অবসান চায় এবং যেহেতু ২৪-এর বিপ্লবের চেতনাসঞ্জাত এই দাবি, সেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্রসমাজকে ভবিষ্যৎ ফ্যাসিবাদ থেকে রক্ষার প্রয়াসে অনতিবিলম্বে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে—এটাই সচেতন মানুষের সুপারিশ।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাবেক অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়