Image description

স্বাধীনতার পর হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনগুলোতে বরাবরই হেরেছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনগুলো। মুক্তিযুদ্ধের পর শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের আমলে প্রথম ডাকসু নির্বাচনে (১৯৭২ সালের ২০ মে) হেরে যায় ছাত্রলীগ। ১৯৭৯, ’৮০ ও ’৮২ সালে বিএনপির আমলে হওয়া তিনটি নির্বাচনে হারে ছাত্রদল। সবশেষ ২০১৯ সালের নির্বাচনের ২৫ পদের মধ্যে ২৩টিতে জিতলেও সহসভাপতির (ভিপি) পদ হারায় ছাত্রলীগ। এ পদে জয়ী হন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্রার্থী নুরুল হক নূর।

প্রায় ৬ বছর পর আবার ডাকসু নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। ভোটগ্রহণ হবে আগামী ৯ সেপ্টেম্বর। গত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ পদ পাওয়া ছাত্রলীগ এবার নিষিদ্ধ সংগঠন। সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারী সংগঠনগুলোর মধ্যে আছে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ছাত্র ইউনিয়ন ও কয়েকটি বাম ছাত্র সংগঠন। এবার হারবে কারা?

 
 

দল ক্ষমতায়, সংগঠন হারে
১৯৭২ সালে শেখ মুজিব সরকারের আমলের নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থেকে মনোনীত শেখ শহীদুল ইসলাম ও মনিরুল হক চৌধুরীর পরিষদ কোনো পদই পায়নি। শাজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন সিরাজপন্থী ছাত্রলীগের জিনাত আলী ও মোয়াজ্জেম হোসেনের প্যানেল ডাকসুর একটি সদস্যপদ পায়। ভিপি নির্বাচিত হন ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) হন একই সংগঠনের প্রার্থী মাহবুব জামান। 

দল ক্ষমতায় থাকলেও ছাত্র সংগঠনের হারের কারণ কী ছিল? এ নিয়ে ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনের আগে কথা হয়েছিল শেখ শহীদুল ইসলামের সঙ্গে। তখন তিনি বলেছিলেন, ছাত্রলীগের পরাজয়ের একমাত্র কারণ ছিল নির্বাচনের আগে দলে বিভক্তি। ছাত্রলীগ ভেঙে তখন জাসদ ছাত্রলীগের জন্ম হয়। ডাকসু নির্বাচনের মাস দুয়েক আগে এই ভাঙনের কারণে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া দ্বিধাদ্বন্দ্বের সুফল পায় ছাত্র ইউনিয়ন। 

ক্ষমতা থেকে পতন
১৯৭২ সালের নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সিরাজপন্থী ছাত্রলীগের জিনাত আলীর চেয়ে ১ হাজার ১৭৬ ভোট বেশি পান। অন্যদিকে মাহবুব জামান ছাত্রলীগের একই প্যানেলের মোয়াজ্জেম হোসেনের চেয়ে ৮৮৩ ভোট বেশি পেয়ে বিজয়ী হন। ডাকসুর অন্য পদেও ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ শ ভোট বেশি পেয়ে জয়লাভ করেন।

কিন্তু ছাত্র ইউনিয়নের ভরাডুবি হয় ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে। সেবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় মাহমুদুর রহমান মান্না সমর্থিত জাসদ ছাত্রলীগ। ভরাডুবির কারণ প্রসঙ্গে এই নির্বাচনে জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করা ছাত্র ইউনিয়নের আবদুল মান্নান খান বলেছিলেন (২০১৯ সালে), স্বাধীনতা যুদ্ধের পর জাতীয়তাবাদের চেতনা যতটা প্রকট ছিল, সেটা সময়ের ব্যবধানে কমে যায়। এ ছাড়া, তখন রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা এসেছিলেন তাদের মতাদর্শের সরাসরি প্রভাব পড়তে থাকে ছাত্রদের ওপর। এ পরিস্থিতির শিকার হয় ছাত্র ইউনিয়ন। 

উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালে ডাকসু নির্বাচন হলেও ভোট গণনা হয়নি। 

ছাত্রদলেরও একই দশা
১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের বিএনপি ক্ষমতায় ক্ষমতায় থাকলেও সুবিধা করতে পারেনি ছাত্রদল। ওই বছরের ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আরও অংশ নেয় ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন। প্রথমবার অংশ নেয় বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। মোট ১৯টি পদের বিপরীতে প্রার্থী ছিলেন ৩৫৬ জন। ভিপি নির্বাচিত হন মান্না সমর্থিত জাসদ ছাত্রলীগের মাহমুদুর রহমান মান্না। তাঁর সংগঠন পায় ১৫টি পদ।

পরের বছরের (১৯৮০) নির্বাচনে ১১টি হল সংসদের ১৩২ আসনের মধ্যে ২১টি পান ছাত্রদলের প্রার্থীরা। তবে কেন্দ্রীয় সংসদে পদশূন্য থাকে সংগঠনটি। টানা দ্বিতীয়বার ভিপি নির্বাচিত হন মাহমুদুর রহমান মান্না। আর ওবায়দুল কাদের ও বাহালুল মজনুন চুন্নুর ছাত্রলীগ পায় ৬টি সম্পাদক ও সাতটি সদস্যসহ ১৩টি পদ।

বিএনপির আরেক দফার ক্ষমতাকালে ডাকসু নির্বাচন হয় ১৯৮২ সালের ২৩ জানুয়ারি। সে বারও কেন্দ্রীয় সংসদে কোনো পদ পায়নি ছাত্রদল। ভিপি ও জিএস প্রার্থী ছিলেন গোলাম সারোয়ার মিলন ও নজরুল ইসলাম। তবে হল সংসদে আসন পায় ৬৫টি।

এবার ভিন্ন প্রেক্ষাপট
মুক্তিযুদ্ধের পর এবারই একটি ভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ডাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে। একক কোনো রাজনৈতিক দল এবার ক্ষমতায় নেই। গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের এই আমলের ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে পারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ। এ সংগঠনের বেশিরভাগ নেতাই গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ছিলেন। অপরদিকে বড় দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠনও নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহী।  

১৯৯০ সালের নির্বাচনে প্রথমবার বড় জয় পেয়েছিল ছাত্রদল। সে বারের নির্বাচনের জিএস খায়রুল কবির খোকন ২০১৯ সালে বলেছিলেন, তখন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ছাত্রদল। সে ডাকে সাড়া দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রদলকে ভোট দেন।

এবারের নির্বাচন নিয়ে ছাত্রদল কতটা আশাবাদী? সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হাসান শাকিল বলছেন, তাঁর সংগঠন তফসিলকে স্বাগত জানায়। কিন্তু অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত দলীয়ভাবে হবে। 

জাহিদ হাসান বলেন, এবার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ছাত্রলীগ না থাকলেও তাদের রাজনীতি করা অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে আছে। যারা নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে। এসব জায়গায় সংস্কার জরুরি। কিন্তু প্রশাসন এমন কিছু না করেই তফসিল দিয়েছে। তারপরও এটিকে স্বাগত জানাই। কিন্তু অংশগ্রহণের বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত আসবে। 

প্যানেল নিয়ে আলোচনা চলছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের। সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দীন খান বলেন, শুধু ছাত্রশিবির থেকে নয়, সংগঠনের বাইরে জুলাই আন্দোলন ও ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যারা সক্রিয় ছিলেন তাদের নিয়েই প্যানেল হতে পারে। এরই মধ্যে তাদের অনেকে প্যানেলে থাকার বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন। সবাইকে নিয়ে প্যানেল হলে সেটি শক্তিশালীই হবে।