
আওয়ামী আমলের সর্বাপেক্ষা ঘৃণিত বিচারপতি যারা ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় মূল ভূমিকা রেখেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম খায়রুল হক গত সপ্তাহে বিলম্বে হলেও গ্রেপ্তার হয়েছেন। তার অপকর্মের পুরো চিত্র তুলে ধরতে হলে আমাকে কয়েক কিস্তি লিখতে হবে। এককথায় লোকটি বাংলাদেশ রাষ্ট্র ধ্বংসের অন্যতম প্রধান কারিগর। তবে সেই পুরোনো কথা লিখতে চাচ্ছি না, কারণ অনেক পত্রিকাতেই এখন সেসব কাহিনি প্রকাশ হচ্ছে। আমি আজ প্রাসঙ্গিক, তবে খানিকটা ব্যক্তিগত অন্য কথা বলার জন্য কলম ধরেছি।
যাই হোক, বিচার বিভাগ নিয়ে শেখ হাসিনার কূটচাল জনগণকে অবহিত করার মানসেই আমি অল্প দিনের মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই ২০১০ সালের প্রারম্ভে আওয়ামী বিচারব্যবস্থার স্বরূপ উদ্ঘাটনের জন্য মনস্থির করি। সেই সময় বিএনপিদলীয় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং সাবেক শিল্প ও তথ্য উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ দলটির আরো কজন নেতা জেলে ছিলেন। হাইকোর্ট তাদের জামিন দিলেও তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের ইঙ্গিতে চেম্বার জজ মোজাম্মেল হোসেন সেসব জামিনের আদেশ একের পর এক স্থগিত করে দিচ্ছিলেন। আদালতপাড়ায় কথিত ছিল, চেম্বার জজে জামিনের মামলা গেলেই মোজাম্মেল হোসেন নাকি জিজ্ঞাসা করতেন, ‘এ’ না ‘বি’। ‘এ’ মানে আওয়ামী লীগ এবং ‘বি’ মানে বিএনপি। ‘এ’ হলে জামিনের আদেশ বহাল থাকবে আর ‘বি’ হলে জামিন স্থগিত হয়ে যাবে। আমি হাইকোর্ট বিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমানকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে বললাম। সেই সঙ্গে আমি নিজেও একই বিষয় নিয়ে মন্তব্য প্রতিবেদন লিখতে মনস্থ করলাম। ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’ শিরোনামে আমার দেশ পত্রিকায় প্রধান সংবাদ প্রকাশ পেতেই চতুর্দিকে হইচই পড়ে গেল। ওই ডামাডোলের রেশ না কাটতেই ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’ শিরোনামে পরবর্তী বুধবারে লেখা আমার মন্তব্য প্রতিবেদন সেই সময় রীতিমতো আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছিল। আমার নামে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করা হলো। যেসব আওয়ামী আইনজীবী আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ পুরস্কারস্বরূপ পরবর্তী সময়ে হাইকোর্টের জজও হয়েছেন। হাসিনা আবার পুরস্কার দিতে কার্পণ্য করতেন না।
২০১০ সালের পহেলা জুন বিকাল থেকেই আমার দেশ কার্যালয় শত শত পুলিশ দিয়ে ঘিরে ফেলা হলো। শেষরাত ৪টা নাগাদ সম্পাদকের অফিস থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলাম। আমাকে অবশ্য সরাসরি আদালত অবমাননা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়নি। আগের দিন এনএসআই কার্যালয়ে প্রণীত একটি ভুয়া অভিযোগের ৪২০ ধারায় জিডি বানিয়ে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। অন্য মামলায় কারাগারে থাকা অবস্থায় মাস দুয়েক আগে দায়ের করা আদালত অবমাননা মামলায় আমাকে ‘শ্যোন অ্যারেস্ট’ দেখানো হয়েছিল। সরাসরি আপিল বিভাগে বিচার শুরু হয়েছিল, যাতে নির্ধারিত সাজার বিরুদ্ধে প্রতিকার চাইবার আমার আর কোনো সুযোগ না থাকে। আমি স্বভাব অনুযায়ী আপিল বিভাগে ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করেছিলাম।
রোজার মাসে টানা শুনানি করেছিলেন আওয়ামী ‘মাই লর্ডের’ দল। আমার কোনো আইনজীবী ছিলেন না। দিনভর রোজা রেখে জেলখানার নির্জন সেলে রাত জেগে আমি আত্মপক্ষ সমর্থনের সব খসড়া লিখতাম। বিচারকালে আপিল বিভাগের বিচারপতিদের দুর্ব্যবহারের কোনো সীমা ছিল না। তারা সম্ভব হলে দলবেঁধে বোধহয় আমাকে পেটাতেন। যে ব্যবহার সেদিন ‘লর্ডশিপরা’ করেছিলেন, সেটা বাংলাদেশের সংবিধানে একজন নাগরিককে প্রদত্ত মানবাধিকারের অনুচ্ছেদের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। আমার বক্তব্য প্রদানে তারা বারবার বাধা সৃষ্টি এবং বক্তব্য প্রদানের মাঝেই অপমানজনকভাবে জেরা করছিলেন। সংবিধানের রক্ষকরাই সেদিন দ্বিধাহীনভাবে সংবিধান ভেঙেছিলেন। শুনানি চলাকালে একদিন জ্ঞান হারিয়ে পড়েও গিয়েছিলাম। তাতেও কিন্তু শুনানি থেমে থাকেনি। মাথা-মুখে পানি ছিটিয়ে আমাকে ধাতস্থ হতে কিছুক্ষণ বিরতি দিয়েই ‘ফুল বেঞ্চ’ তাদের জিঘাংসা মেটাতে আবার ফিরে এসেছিলেন। বেশ কয়েক দিনের শুনানি শেষে আমাকে দেশের আইনে নির্ধারিত সর্বোচ্চ সাজারও অতিরিক্ত সাজা দেওয়া হয়েছিল। এটা নাকি তাদের ‘Inherent Right’ ছিল।
আমার আত্মপক্ষ সমর্থনের একেবারে শেষ অংশে আমি বলেছিলাম, ‘This is the price one has to pay for pursuing the path of truth. I know truth is no defence here. However, truth is becoming a defence in other places as has been seen in the case of most recent Delhi High Court judgement. Most importantly, truth is the only defence in the ultimate court which every Muslim should fear. With this I conclude my submission.’ (সততার রাস্তায় গেলে এই মূল্য দিতেই হবে। আমি জানি এখানে ‘সত্য’ নাকি কোনো যুক্তি নয়। তবে বিশ্বের অন্যত্র ‘সত্য’ আইনি যুক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেটা দিল্লি হাইকোর্টের সাম্প্রতিক এক রায়ে দেখা গেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রতিটি মুসলমানের যে শেষ বিচারকে ভয় করা উচিত, সেখানে সত্যই একমাত্র বিচার্য বিষয়। এটুকু বলেই আমার আত্মপক্ষ সমর্থন শেষ করছি।) মনে আছে, মামলার রায় হয়ে যাওয়ার পর ব্যারিস্টার রফিকুল হক আমাকে বলেছিলেন, ‘মাহমুদ, আপনার ভাগ্য ভালো যে ফাঁসির রায় দেয়নি। বেঞ্চ যে অ্যাটিচুড দেখাচ্ছিল, তাতে অন্তত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ভয় পাচ্ছিলাম।’
কেন আমি আদালত নিয়ে এতটা ঝুঁকি নিয়েছিলাম—সেই প্রশ্ন গত দেড় দশকে আমাকে দেশে-বিদেশে অনেকেই করেছেন। আমার একেবারে সৎ স্বীকারোক্তি হলো, আমি একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বিচার বিভাগকে অবশ্যম্ভাবী ভয়াবহ পতন থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। সেদিন যদি আমার ধাক্কায় ‘লর্ডশিপদের’ সংবিৎ ফিরত তাহলে ফ্যাসিবাদ জাতির ঘাড়ে চেপে বসতে পারত না এবং বিচার বিভাগেরও এমন অধঃপতন আমাদের দেখতে হতো না। মহান জুলাই বিপ্লবের পর একজন ব্যতীত আপিল বিভাগের সব বিচারপতিকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। যে একজন সৌভাগ্যবানকে পদত্যাগ করতে হয়নি, তিনি সম্ভবত উচ্চ আদালতের ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে বেঁচে গেছেন। ১৫ বছর আগে আমার সতর্কবার্তায় কেউ কান দেননি বলেই অশীতিপর বৃদ্ধ খায়রুল হককে আজ মাথায় হেলমেট ও বুকে নিরাপত্তা বর্ম লাগিয়ে আদালতে ও কারাগারে যেতে হয়েছে, বিচারপতি নামধারী আওয়ামী ক্যাডার শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে ভারতে পালাতে যাওয়ার সময় পাগলের বেশে ধরা পড়ে জনগণের হাতে নিগৃহীত হয়ে হত্যা মামলার আসামি হতে হয়েছে এবং জনরোষের ভয়ে ফ্যাসিস্ট আমলের অধিকাংশ ডাকসাইটে বিচারপতিকে আজও পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, লড়াইটা আমাকে একা করতে হয়েছিল। কোনো রাজনৈতিক দল এবং কোনো তথাকথিত সুশীল সমাজ আমার পাশে এসে দাঁড়ায়নি। এমনকি সাংবাদিকদের বিশাল একটি অংশ আমাকে গ্রেপ্তার এবং আমার দেশ বন্ধ করতে অবৈধ ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে সর্বতোভাবে উৎসাহ জুগিয়েছেন। বিচার বিভাগ নিয়ে আমার ২০১০ সালের মূল্যায়ন ইতিহাসের নিরিখে সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।
একটা মজার গল্প বলে আজকের লেখা শেষ করব। ২০১৩ সালে স্কাইপে কেলেঙ্কারি প্রকাশ এবং শাহবাগের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আমি তখন পত্রিকা অফিসে বন্দি জীবনযাপন করছি। স্কাইপে কেলেঙ্কারি প্রকাশের অপরাধে সরকার আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা রুজু করে রেখেছে। ‘শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’ লিখে আমার গ্রেপ্তার নিশ্চিত করে ফেলেছি। আমার আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী ও অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান। তারা আমাকে পরামর্শ দিলেন হাইকোর্টে গিয়ে আগাম জামিনের চেষ্টা করতে। সেই পরামর্শমতো একদিন হঠাৎ করে কারওয়ান বাজারের অফিস থেকে আমি পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে হাইকোর্টে গিয়ে পৌঁছলাম। মওদুদ ভাই ও মোহাম্মদ আলী ভাই আমাকে নিয়ে একটি পূর্বনির্ধারিত বেঞ্চে গিয়ে জামিন প্রার্থনা করলে সিনিয়র বিচারপতি অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখে শেষমেশ মামলা শুনতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। তখন বিকাল প্রায় ৪টা বাজে। আমি হাইকোর্ট থেকে চলে আসতে চাইলেও মওদুদ ভাই শেষ চেষ্টা হিসেবে আরেকটি বেঞ্চে গেলেন। সেখানে তখন অন্য মামলার শুনানি চলছিল। আমাদের দেখামাত্র শুনানি বন্ধ করে দুই বিচারপতি এত তাড়াতাড়ি নেমে যাওয়ার চেষ্টা করলেন যে, আরেকটু হলে মহিলা বিচারপতি হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতেন।
কিছুদিন আগে সেই দুই বেঞ্চের চার বিচারপতির একজন তার চাকরি রক্ষার জন্য আমার কাছে ফোন করে খুব কাকুতিমিনতি করলেন। তিনি আমার একজন নিয়মিত পাঠক এবং একনিষ্ঠ ভক্ত হওয়ারও দাবি করলেন। আমি তাকে বিনয়ের সঙ্গে আমার ক্ষমতাহীনতার কথা জানালাম। তাকে বললাম, আমি একজন অতিসাধারণ সম্পাদক মাত্র। আমার সুপারিশ সরকার শুনবে কেন? সময় পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের চেহারার পরিবর্তনের উদাহরণ দেওয়ার জন্যই ঘটনাটা উল্লেখ করলাম। বিচারপতিকে বিব্রত না করার জন্য তার নাম আর বললাম না। সময় তো তার প্রতিশোধ ঠিকই নিয়েছে। আজ লিখতে গিয়ে মওদুদ ভাই ও মোহাম্মদ আলী ভাইয়ের কথা বড় মনে পড়ছে। দুজনেই কোনো প্রতিদান ছাড়া আমার শুধু উপকার করে গেছেন। ঋণ শোধ করা হয়নি। মহান আল্লাহ তাদের বেহেশত নসিব করুন।