Image description

হৃদয়ভেদ করা মর্মান্তিক ঘটনায় রাজধানী ঢাকার মাইলস্টোান স্কুল অ্যান্ড কলেজের অনেক শিশু ও শিক্ষকের মৃত্যু আমাদের অসম্ভব কষ্টে মুহ্যমান রেখেছে। ক্ষোভে-দুঃখে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ করেছে মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীরা। সেখানে প্রায় নয় ঘণ্টা অবরুদ্ধ থেকেছেন দুই উপদেষ্টা এবং প্রেস সচিব। পরে সেই ক্ষোভ সচিবালয় পর্যন্ত পৌঁছে। এইচএসসি পরীক্ষা পেছানো নিয়ে কেন সরকার এতটা সময় নিল এবং মধ্যরাতে সেটির সিদ্ধান্ত হলো সঙ্গত কারণেই এই বিষয়ে শিক্ষার্থীরা সেখানে গিয়ে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে। সেখানে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের’ মতো তাদের ওপর পুলিশি লাঠিচার্জ হয়েছে। বন্ধু, স্বজন হারিয়ে সবাই ট্রমাটাইজড। এর ওপর আবার পুলিশের লাঠিচার্জ!

মাইলস্টোনের মর্মান্তিক ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেল অভিভাবকরাও অনেকেই সন্তানকে স্কুলে পাঠাচ্ছেন না। স্কুল থেকে বার্তা আসে কী কারণে স্কুলে আসেনি শিক্ষার্থী সেটি জানাতে। কিন্তু এই ধরনের মানসিক কারণ কীভাবে জানাবেন? অভিভাবকরা এখন অনেকটাই ভীত। কোথাও নিরাপত্তা নেই কারও। স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই, তবু সন্তান বেঁচে থাকুক, থাকুক চোখে চোখে, থাকুক বাবা-মায়ের কাছে।

গত জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের পর প্রথম ধাক্কাটি লাগে শিক্ষাঙ্গনেই। সেখানে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। এই চিত্র ছিল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে এবং বিভিন্ন দেয়ালের গ্রাফিতিতে সেই চাওয়া ফুটিয়ে তুলেছিল।

তবে শিক্ষার্থীদের সেই শক্ত অবস্থান আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে যায়। তাই ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ ক্ষীণ হতে থাকে। তারা আর সেই জায়গায় নেই। ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতি আছে এবং লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতিই আছে। পার্থক্য হলো ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ আর এতদিন ধরে নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে রাখা এবং অন্যান্য দলের মধ্যে থাকা ছাত্রশিবির নিজ পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। সেই শিবিরের ছাত্রী ইউনিট হিসেবে ইতোমধ্যে সামনে এসেছে ইসলামী ছাত্রী সংস্থা। কয়েক মাস আগেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের একজন নেতাকে খুনও করা হয়েছে। সেই খুনের বিচারের বিষয় খুব একটা আগায়নি।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন আদৌ হবে কিনা সে বিষয়ে অনেকটাই যেন সংশয়ে আছে জনগণ। নির্বাচনের তারিখ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কয়েক দফা জুন-এপ্রিল-ফেব্রুয়ারি ঘোরাঘুরি জনমনে এই শঙ্কাকে আরও ভিত দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি এখনই জাতীয় নির্বাচনের বিরোধিতা করে আসছিল। জাতীয় নির্বাচনের বিরোধিতা করলেও কিন্তু তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি ছাত্র সংগঠন ডাকসুর দাবি করে আসছিল। ডাকসুকে তারা তাদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের টেস্ট কেস হিসেবে দেখতে চায় কিনা বলা কঠিন। তবে বেশ কয়েকটি সংগঠন এই সময়ে ডাকসু নির্বাচনের বিরোধিতাও করেছিল।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডাকসু নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর মধ্যে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি ও কমিশন ঘোষণা করা হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেটি হলো আগামী ২৯ জুলাই ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। পাশাপাশি সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভোটগ্রহণের ঘোষণাও দিয়েছে ডাকসু নির্বাচন। যদি সবকিছু ঠিকভাবে এগোয় তা হলে ছয় বছরের বেশি সময় পর ডাকসু হতে যাচ্ছে।

বর্তমানে ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল সবচেয়ে বেশি ছাত্রদল এবং ছাত্রশিবির। যদিও ছাত্রশিবির এখন পর্যন্ত নিজেদের নামে খুব বেশি কর্মকাণ্ড করছে না। যা করছে তা এখনও অন্য নামে কিংবা ‘সাধারণ’ ছাত্রের ব্যানারে নিজেদের লুকিয়ে। তবে মাঝে মাঝে শিবির নেতাদের বক্তব্য গণমাধ্যম সূত্রে সামনে আসে। তবে এনসিপির কর্মসূচিতে শিবিরের অংশগ্রহণ এবং জামায়াতে ইসলামীর কর্মসূচিতে এনসিপির অবধারিত অংশগ্রহণ তাদের একে অন্যের ওপর নির্ভরতার আভাস দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে মিটফোর্ডে একজন ব্যবসায়ী হত্যার সঙ্গে যুবদল যুক্ত থাকার অভিযোগ আসায় শিবির বিএনপির বিরুদ্ধে মিছিল করলে তখন ছাত্রদল-শিবিরের মধ্যকার হইচই শোনা গিয়েছিল। আছে বাম সংগঠনগুলোও। সেজন্য ডাকসু নির্বাচন একভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগে বলা হতো যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যার নিয়ন্ত্রণে থাকবে সে দলই ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাবে। আবার এর উল্টাটাও হয়েছে। অর্থাৎ যে দল ক্ষমতায় থাকে সে দলের সংগঠনই ডাকসুতে জয়লাভ করেছে। তবে সর্বশেষ ডাকসুতে ভিপি পদেই ছাত্রলীগ নেতাকে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন নূর। হলগুলোতেও বিভিন্ন পদে ছাত্রলীগ হেরে গিয়েছিল।

বলতেই হবে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। ছাত্রদল এবং ছাত্রশিবির উভয়েই এককভাবে জিততে চাইবে, ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা চাইবে। ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতাও হতে পারে, ঘটতে পারে বড় ধরনের ঘটনা। সংশয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে। যদিও এখন ‘সাধারণ’ ব্যানার কিংবা পরিচিতি নিয়েও নানা ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে। কারণ প্রথমে ‘সাধারণ’ শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দিলেও পরে ঠিকই হয়তো সুযোগ বুঝে রাজনৈতিক পরিচয় বের করছেন। কিন্তু আমি বলছি সেসব শিক্ষার্থীর কথা যারা আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে দু-তিনটি টিউশনি করে শুধু কবে পাষ করে বের হবে সেই আশায় বসে থাকে। হয়তো তারা ভয়ে বিভিন্ন সংগঠনের মিছিলে যায়, কিন্তু তাদের মনোজগতে থাকে শুধু নিজে বাঁচা এবং অন্য ভাইবোন ও পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম। ইতিহাস বলে, যে কোনো সহিংসতায় এরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই ডাকসু নির্বাচন একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য সহায়ক, অন্যদিকে এটিকে কেন্দ্র করে যদি সহিংসতা, হুমকি, ভয়ভীতির পরিবেশ তৈরি হয় তা কোনোভাবেই শিক্ষার পরিবেশের জন্য কাক্সিক্ষত হবে না। তাই ডাকসু নির্বাচন অনেকটাই এক বড় ধাক্কা। সব সময়ই ডাকসু একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এবারের চ্যালেঞ্জের মালমসলা ভিন্ন ধরনের। সঙ্গত কারণেই প্রশাসনকে অনেক বেশি প্রস্তুতি নিতে হবে।

এক বছর ধরে সবচেয়ে বড় যে সংকট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মোকাবিলা করছে সেগুলোর একটি হলো শিক্ষার্থীরা আর পড়াশোনায় ফিরতে চাচ্ছে না। কেউই তাদের বলছে না, তোমরা তোমাদের কাজ করেছ, এবার তোমরা পড়াশোনায় মন দাও। তোমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাও। তাদের অনেকেই এখন অনেকটাই ব্যস্ত রাজনৈতিক দল নিয়ে (আগেও ছিল), মব করছে, কেউ কেউ আবার ধরা পড়ছে ছিনতাই করতে গিয়ে। অনেকেরই মনে হচ্ছে ছাত্ররা একটা আন্দোলন করে সরকার পরিবর্তন করেছে তাই এখন তারাই এ দেশের মালিক। তাদের কথাই সবাই শুনতে বাধ্য থাকবে। আগেও এগুলো ছিল। তাহলে প্রশ্ন হলো একটি বড় আন্দোলনের পর এগুলোই যদি বাস্তবতা হয় তাহলে কী পরিবর্তনই বা করা গেল?

ছাত্রদের এই মনস্কতা অন্যদেরই সুযোগ করে দিচ্ছে। এ ওকে ধমকে বলছে, ‘বেশি বাড়াবাড়ি করলে ছাত্রদের ডাকব, তখন বুঝবা।’ শিক্ষকদের অনেকেই ভয় পাচ্ছেন শিক্ষার্থীদের। অপমানের ভয়, অসম্মানের ভয়।

ভয়ের সংস্কৃতি এখনও ক্রিয়াশীল। যারা এই মার মার-কাট কাট অবস্থান পছন্দ করছেন না তারাও কিছু বলতে পারছেন না। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, এমনকি একই ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা বর্তমানে শিবির এবং ছাত্রদল করছেন তাদের ভয়ে অন্যরা ভিন্নমত থাকলেও জানাতে চান না। তারা ভয়ে জানাতে চান না। ট্যাগের ভয়, বয়কটের ভয়।

বর্তমানের অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলের নয়, কিন্তু এটিও রাজনৈতিক সরকার। এখন প্রশ্ন হলো আগের নিয়ন্ত্রণবাদী সরকারের ছাত্র সংগঠনের দাপটে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়ের অবস্থা জারি থাকত। এখনও তা থেকে মুক্তি মেলে না কেন? ছাত্ররা কেন ‘ভয়ের’ প্রতীক হচ্ছে। অথচ এক বছর আগেও এই বাংলাদেশের মানুষ শিক্ষার্থীদের ওপর ভর করেছিল। তাদের ওপর আস্থা এনেছিল। তাদের ওপর বিশ্বাস করে, তারা বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল। কিন্তু এক বছরে আবারও কেন ভয়ের সংস্কৃতিতেই থাকতে হচ্ছে?

লেখক: ড. জোবাইদা নাসরীন, শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়