
আলফাজ আনাম
দুনিয়ার সব স্বৈরশাসকদের পাশে থাকে কিছু পোষা ব্যবসায়ী। ধনবান ও প্রভাবশালী এই ব্যবসায়ীরা ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। পশ্চিমা বিশ্বে এদের ডাকা হয় অলিগার্ক নামে। এই ব্যবসায়ীরা স্বৈরশাসকদের লুটপাট ও অর্থপাচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। আবার এরা অনেক ক্ষেত্রে স্বৈরশাসকদের পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা পালন করে থাকে। ফলে এদের বিনিয়োগের একটা বড় ক্ষেত্র হচ্ছে প্রচারমাধ্যম।
স্বৈরশাসন আছে, দুনিয়ার এমন সব দেশে অলিগার্করা সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তারা প্রচারমাধ্যমে মোটামুটি তিনটি কারণে বিনিয়োগ করে থাকে—১. নিজের ভাবমূর্তি উন্নত করা; ২. প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো এবং ৩. সরকার ও প্রশাসনের সহানুভূতি অর্জন করা। রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য অলিগার্কদের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রচারমাধ্যমের ওপর সরকার নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করে তারা নিজেদের রাজনৈতিক পছন্দ বা এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে পারে। অলিগার্করা যেমন রাজনীতিবিদদের সমর্থন করে, তেমনি প্রচারমাধ্যম সে অনুযায়ী প্রচার চালায়। এর মধ্য দিয়ে ‘মিডিয়া-পলিটিক্স-করপোরেট’ ত্রিভুজ তৈরি হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রুশ অলিগার্করা রাশিয়ার অনেক প্রচারমাধ্যম কিনে নেয়। বেরেজোভস্কির মালিকানাধীন ওআরটি বা চ্যানেল ওয়ান রাশিয়া পুতিনের পক্ষে ব্যাপক প্রচার চালায়। একসময় এসে পুতিন অলিগার্কদের মিডিয়া সীমিত করেন। শুধু তার একান্ত পছন্দের ব্যবসায়ীদের হাতে মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়। হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ওরবানের বন্ধু ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী লরেন্স মেসজারোস বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেল কিনে নেন এবং ওরবানের পক্ষে প্রচার চালান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পোষা ব্যবসায়ী গ্রুপ আদানি দেশটির অনেকগুলো সংবাদমাধ্যম কিনে নিয়েছে। এর মধ্যে এনডিটিভিও আছে। স্বাধীন গণমাধ্যম হিসেবে এনডিটিভি একসময় ভারতে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। এখন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রচারমাধ্যমে পরিণত হয়েছে।
অলিগার্করা কীভাবে প্রচারমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে, তার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যম। এখানে বলে রাখা ভালো, এগুলোকে ঠিক গণমাধ্যম না বলে আমরা প্রচারমাধ্যম বলতে পারি। কারণ ক্ষমতাসীন দলের প্রচারবিদরা এই সংবাদমাধ্যমগুলোকে তাদের পক্ষে জনমত গঠনে ব্যবহার করেছেন। যখন এসব প্রচারমাধ্যম অলিগার্কদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে, তখন স্বাধীন সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হয়, জনগণের সত্য জানা কঠিন হয়ে যায়। কারণ এসব প্রচারমাধ্যমের ভাষ্য হয়ে পড়ে একতরফা। হাসিনা সরকার অলিগার্কদের হাতে প্রচারমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমে ভিন্নমতের সব সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছিল। সাংবাদিক ও সম্পাদককে জেলে ভরে ও রিমান্ডের নামে নির্যাতন করে অনেককে দেশান্তরী করা হয়েছিল।
এরপর শেখ হাসিনার দেড় দশকের দুঃশাসনের সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি হয়ে ওঠে এ দেশের অলিগার্ক-নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যম। যারা এসব প্রচারমাধ্যমের মালিক ছিলেন, তারা সবাই ছিলেন হাসিনার লুটপাটতন্ত্রের সহযোগী। আবার যারা এসব প্রতিষ্ঠানে বড় পদে দায়িত্ব পালন করেছেন, তারাও ছিলেন স্বৈরশাসকের অনুগত প্রচারবিদ, যারা মাফিয়া শাসনকে টিকিয়ে রাখার জন্য জনমত গঠনের চেষ্টা করে গেছেন। প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যাতে ভিন্নমতের কেউ এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ না পায়।
আমরা দেখেছি, হাসিনার দেড় দশকের শাসনে সরকার, অলিগার্ক-নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যম ও হাসিনার বিশ্বস্ত প্রচারবিদদের মধ্যে একটি চক্র গড়ে ওঠে। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগে তার অনুগত দুটি গোষ্ঠীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। এসব বৈঠকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দমনে নানা ধরনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এর একটি ছিল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে, অপরটি সাংবাদিকদের সঙ্গে।
শেখ হাসিনা ২২ জুলাই সাংবাদিকদের সঙ্গে এবং ২৪ জুলাই অলিগার্ক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। উভয় গোষ্ঠীর সদস্যরা ছাত্র আন্দোলনকে চিহ্নিত করেছিলেন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে। আন্দোলনকারীদের নির্মূল না করা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে থাকার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সাংবাদিক নামে যে প্রচারবিদরা সরকারের হয়ে অলিগার্কদের প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করতেন, তারা শুরু থেকেই নানা ধরনের বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে কঠোরভাবে এই আন্দোলন দমনের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
পতিত প্রধানমন্ত্রীর কাছে একজন সাংবাদিক ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সন্ত্রাসীরা অংশ নিয়েছে বলে দাবি করেছিলেন। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে প্রতিদিন যখন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের মৃত্যুর খবর আসছিল, তখন প্রচারমাধ্যমে নিয়মিতভাবে পুলিশের বয়ান প্রচার করা হয়েছিল। এমনকি কিছু কিছু টেলিভিশন চ্যানেল শুধু পুলিশের হত্যাকাণ্ডের চিত্র আড়াল করেনি, নানাভাবে ভুল তথ্য প্রচার করে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল। ‘পানি লাগবে পানি’ বলে আন্দোলনরত মানুষের পাশে দাঁড়ানো মীর মুগ্ধ হত্যাকাণ্ড নিয়ে এসব মিডিয়ায় মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়েছিল।
একটি পত্রিকার শিরোনাম ছিল—‘শিবির ছাত্রদলের বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দেওয়ার পরদিন শিক্ষার্থী হত্যা’। এই খবরে বলা হয়, কোটা আন্দোলনে শিবির ও ছাত্রদলের অনুপ্রবেশ নিয়ে স্ট্যাটাস দেওয়ার পরই হামলায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) এমবিএর শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ ও ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজের মৃত্যু হয়েছে। এ মৃত্যুকে ঘিরে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই দুই শিক্ষার্থীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। এ ঘটনায় জামায়াত-শিবির ও বিএনপির নেতাকর্মীরা জড়িত থাকতে পারেন বলে অভিযোগ ওঠায় তদন্ত শুরু করছে পুলিশ।
অলিগার্কদের মালিকানাধীন মিডিয়া কীভাবে পুলিশের গুলিতে নিহত দুই ছাত্রের মৃত্যুকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য অসত্য খবর প্রচার করেছে, তার একটি উদহারণ মাত্র। এ রকম আরো অনেক উদাহরণ আছে। তবে এ কথাও সত্য, অনেক সাংবাদিক বিবেকের তাড়নায় এই আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। তারা যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন, সেসব প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনে তাদের ভূমিকা গোপন রাখতে হয়েছে।
শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনে এই প্রচারমাধ্যমগুলো নিজেদের মূলধারার গণমাধ্যম হিসেবে দাবি করত। কিন্তু এগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা বলতে তেমন কিছু ছিল না। মানুষ পুরোপুরিভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এসব প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচারিত খবরের চেয়ে বিদেশে থাকা ইউটিউবারদের কথা ছিল অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। ফলে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রাখা এবং আন্দোলনের কর্মসূচিগুলোয় অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্য, খবর ও বিশ্লেষণ মানুষ বিশ্বাস করেছে। ফলে আন্দোলন অল্প সময়ের মধ্যে সফল পরিণতির দিকে গেছে।
অলিগার্ক-নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যমের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের এক ধরনের ঘৃণা রয়েছে। এর কারণ হলো এই প্রচারমাধ্যমগুলো দেড় দশক ধরে ফ্যাসিবাদের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন ও ইসলামোফোবিয়ার পরিবেশ তৈরি করেছে। এক্ষেত্রে তারা কখনো কখনো আওয়ামী নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চেয়ে সরব ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে রাজধানীসহ সারা দেশে গুম-খুনের মহোৎসব চলে। ঢাকার রাস্তায় প্রকাশ্য মিছিল থেকে ধরে নিয়ে পুলিশ পায়ে গুলি করে বহু তরুণকে পঙ্গু করে ফেলে। সে সময় এ দেশের তথাকথিত গণমাধ্যম বন্দুকযুদ্ধ, জঙ্গি তৎপরতা এবং পুলিশের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের নেতাদের তাণ্ডব বলে এসব ঘটনাকে মানুষের সামনে হাজির করে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও বেশির ভাগ অলিগার্ক দেশে আছেন। তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াও রয়ে গেছে। তবে সেগুলোর কিছুটা রঙ বদল হয়েছে। কিন্তু এসব মিডিয়ার প্রোপাগান্ডামূলক চরিত্রে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। অলিগার্করা তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যারা থাকেন তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কাছে টেনে নেন। আগামী দিনে যাদের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা বেশি, এখন তাদের সঙ্গে সর্ম্পক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে এসব অলিগার্ক। এখন সম্ভাব্য ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছাপূরণের আশায় এসব মিডিয়া প্রতিপক্ষ দলের ও ব্যক্তির চরিত্রহননে লিপ্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে এর আলামত দেখা যাচ্ছে। সম্ভাবনাময় এক তরুণ নারী নেত্রীর অশ্লীল ফটোকার্ড প্রচার করছে মূলধারা বলে দাবি করা অলিগার্কদের একাধিক প্রচারমাধ্যম। এ ধরনের কর্মকাণ্ড শুধু সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য হুমকি নয়, ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্যও বিপজ্জনক।
ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা আছে, এমন রাজনৈতিক দলগুলো যদি অলিগার্কদের প্রশ্রয় দেয়, তাহলে তাদের জন্য এর পরিণতি শুভ হবে না। মনে রাখতে হবে, অলিগার্কদের লক্ষ্য হচ্ছে তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা করা। যখন কোনো ইস্যুতে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেবে, তখন তারা প্রচারমাধ্যমগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে। এমনকি রাজনৈতিক দলটি যদি কোনো কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে এখন প্রশ্রয় দেওয়া দলকে আঘাত করতে দ্বিধা করবে না। অলিগার্ক-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া স্বাধীন সাংবাদিকতা ও রাজনীতির জন্য বিপজ্জনক।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, আমার দেশ