
ইরানের ওপর ইসরাইল সম্পূর্ণ অবৈধভাবে হামলা চালিয়ে অবশেষে যুদ্ধবিরতিতে গেল। কেন অবৈধ? কারণ অনেক। একে তো ওই ভূখণ্ডটিই দখলকৃত ভূমি। উড়ে এসে জুড়ে বসা কিছু পশ্চিমা ইহুদিবাদীর সামরিক দুর্গ এটা। যুক্তরাষ্ট্রসহ কতিপয় পশ্চিমা দেশের অস্ত্র ও গোলাবারুদের ভান্ডার। পরোক্ষ আলোচনা চলছিল ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের। ইরান কোনোভাবেই অকারণে চুক্তি ভঙ্গকারীর সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি ছিল না।
ট্রাম্পের আলোচনার প্রস্তাব ইরান ফিরিয়ে দিচ্ছে-এটা তার জন্য সম্মানহানিকর। সেজন্য ইরানের দেওয়া সব শর্ত মেনে নিয়েই আলোচনা চলছিল। পঞ্চম দফা আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া একটি প্রস্তাব মেনে নিতে রাজি হলো না ইরান। প্রস্তাবটি ছিল ‘ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধকরণ পুরোপুরি বন্ধ রাখতে হবে।’ আলোচনার সূচনাতেই ইরান শর্ত দিয়েছিল-এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। তবু ওই প্রস্তাব দিয়ে বসল মার্কিন পক্ষ। পরিণতিশূন্য আলোচনা শেষ হলো। পরবর্তী আলোচনায় হয়তো একটা ভারসাম্য তৈরি হতো। কিন্তু ঝামেলা করে বসল ইসরাইল। কারণ পরবর্তী আলোচনায় যদি সত্যিই কোনোরকম সমঝোতা হয়ে যেত, তাহলে জেসিপিওএ (জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন) স্বাক্ষরের দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতো। আর সেটা যদি হয়েই যেত তাহলে ইসরাইলের গুরুত্ব যেমন হারানোর আশঙ্কা ছিল তেমনি তার দীর্ঘদিনের ভিত্তিহীন, অবাস্তব বাগাড়ম্বরের বিষয়টি প্রমাণ হয়ে যেত।
গাজাকে ঘিরে ইরানের ওপর দীর্ঘদিনের খেদ আছে ইসরাইলের। ইসরাইল গাজায় কোনোভাবেই সামরিক বিজয় পাচ্ছে না ইরানের কারণে। ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের পাশাপাশি লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি, আনসারুল্লাহ বাহিনী, ইরাকের প্রতিরোধ গোষ্ঠীসহ আরও অনেক বাহিনী ফিলিস্তিনের সমর্থনে ইসরাইলের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে লড়ে যাচ্ছে। এইসব প্রতিরোধ বাহিনীর কারণে ইসরাইল কোনোভাবেই লক্ষ্য অর্জন করতে পারছে না। এই প্রতিরোধ বাহিনীগুলোর অনুপ্রেরণা হলো ইরান। সুতরাং এই খেদ মেটানোর সুযোগ তো কাজে লাগাতেই হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো আলোচনা চলছিল দুপক্ষের মাঝে। ইসরাইল ওই আলোচনার কোনো পক্ষ নয়। তাহলে ইসরাইল কেন হামলা চালাল? এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর কারও জানা আছে কিনা জানি না। যদিও ইসরাইল অদ্ভুত এক কারণ দেখিয়েছে। বলেছে ইরানের পরমাণু স্থাপনা তাদের জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে, তাই তারা আগাম প্রতিরোধমূলক হামলা চালিয়েছে আত্মরক্ষার্থে। ওই হামলা চালানোর পরপরই ট্রাম্প বলেছিলেন এতে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। একা হয়ে গেল ইসরাইল। কিন্তু বিশ্ব দেখল-দ্রুতই ট্রাম্পের অবস্থান পালটে গেল।’
ইসরাইল ছেড়ে পালাবার ধুম লেগেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, বিশ্ববাসী জেনে গেছে ইরানের কাছে ইসরাইল মারাÍকভাবে পরাজিত হয়েছে। এই গ্লানি তাদের ভেতর থেকে উসকানি দিলেও পুনরায় হামলা চালানোর মতো দুঃসাহস দেখানোর পর্যায়ে এ মুহূর্তে নেই ইসরাইল।
১৩ জুন ইসরাইলের আক্রমণের পরেও ট্রাম্প হস্তক্ষেপ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। ইরানের ওপরও তিনি সামরিক আগ্রাসনে অংশ নেবেন না বলে বারবার ঘোষণা করেছেন। পরে বললেন ১৫ দিন দেখবেন। এমন কী দেখেছেন যে হুট করেই যুদ্ধে যোগ দিলেন? এ প্রশ্নের জবাব রয়েছে ট্রাম্পের প্রথম পর্যায়ের শাসনামলে কোনোরকম কারণ ছাড়াই ক্ষমতার দোর্দণ্ড প্রতাপ দেখিয়ে পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মধ্যে। বারাক ওবামার সরকার দীর্ঘদিন আলোচনার পর ওই সমঝোতাটি স্বাক্ষর করেছিল। সেই ইতিহাসে ট্রাম্পের নাম থাকবে না-তা কী মেনে নেওয়া যায়? সুতরাং গোল্লায় যাক ওই সমঝোতা। গেছেও। কিন্তু ইতিহাসে নাম লেখানোর তাড়া তিনি খুব করে অনুভব করলেন এবং নতুন করে আলোচনা শুরু করলেন। ১৪ জুন সকালে ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘুম থেকে উঠে ফক্স নিউজ দেখেন। সেখানে গভীরভাবে লক্ষ্য করলেন ইরানে হামলার জন্য ইসরাইলের ভূয়সী প্রশংসা করা হচ্ছে। আর যায় কোথায়! নড়েচড়ে বসলেন তিনি। ইরানি সামরিক স্থাপনাগুলোসহ তাদের সামরিক কমান্ডার এবং পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করার ঘটনাকে মহান বিজয় হিসাবে ফলাও করে তুলে ধরা হচ্ছে চ্যানেলগুলোতে। সেখানে শুধু নেতানিয়াহুরই প্রশংসা। আ-হা! এই সুযোগ কী করে হাতছাড়া করা যায়? ইতিহাসের পাতায় তো নাম লেখাতেই হবে।
অপরদিকে তার ক্রীড়নক ইসরাইলের অবস্থাও ইরানে হামলায় গাজার মতো হয়ে গেছে। তাকেও তো বাঁচাতে হবে। সুতরাং সিদ্ধান্ত পালটে গেল। কংগ্রেস-সিনেটের অনুমোদন কিংবা পরামর্শ ছাড়াই মি. ট্রাম্প যুক্ত হয়ে গেলেন যুদ্ধে। ক্রেডিট নিলেন। কিন্তু যেভাবে অবাধে তিনি যোগ দিলেন তাতে বিবেকবান মানুষের মনে কতরকম ধারণা যে জন্ম নিয়েছে তার কোনো শেষ নেই। যার যার মোড়লিপনা ঠিক রাখতে ‘রণাঙ্গনে অবাধ সাঁতরালেন উভয়পক্ষ।’ ‘আমি দাঁড়িয়ে যাব, আপনি আমাকে বসিয়ে দেবেন’ মতো খেলা কিনা; কে জানে! যাক গে! আমরা ক্রেডিট নেওয়ার যে গল্পটি শোনালাম সেটি কিন্তু কাল্পনিক নয়। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদক হেলেন কুপার ফক্স-নিউজে কথাটি জানিয়েছেন। ট্রাম্প অবশেষে ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোতে হামলা চালালেন।
যুক্তরাষ্ট্রের দুটি সামরিক ঘাঁটি এবং ইসরাইলের অভ্যন্তরে পালটা হামলা করেছে ইরানও। মার্কিন বোমা আর বাঙ্কার বাস্টারের আগুনে তো পুড়ে যেতেই পারে পরমাণু স্থাপনার অবকাঠামো। কিন্তু ইসরাইলের বিভিন্ন স্থাপনায় ইরানের কঠিন জবাবের আগুন সহজে নেভানো যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ফরেন পলিসি লিখেছে-ইসরাইল ও আমেরিকার যৌথ হামলার পর ইরান থেকে যেসব স্যাটেলাইট চিত্র পাওয়া গেছে সেগুলো ইঙ্গিত দেয় যে তেহরানের স্থাপনাগুলোর অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাদের পারমাণবিক অর্জন ও প্রযুক্তিগুলো ধ্বংসের কোনো লক্ষণ নেই। ৬০ মাত্রায় সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়ামের পরিমাণ কত কিংবা সেগুলো কোথায়-এসব ব্যাপারে কোনো তথ্যই দিতে পারেননি ট্রাম্পের গোয়েন্দারা। তারা সবকিছু ধ্বংস করে দেওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা। এদিকে ইরান যে সেন্ট্রিফিউজগুলো সরিয়ে নিয়েছে; সেগুলো যে এক সময় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে মার্কিন কর্মকর্তারা তাদের জনগণকে সে বিষয়ে ভাববারও অবকাশ দিচ্ছে না।
বোমা মেরে না হয় পরমাণু স্থাপনা ধ্বংস করে দেওয়াই হলো, কিন্তু পরমাণু প্রযুক্তির জ্ঞান? সেটা ধ্বংস করবে কী করে? পুড়বে কী করে? জ্ঞান তো মৌসুমি বায়ু। আর বৃষ্টির পরশে লকলক করে বেড়ে উঠবেই। সুতরাং গায়ের জোর কিংবা ক্ষমতার জোর দেখিয়ে লাভ নেই!
পশ্চিমা অনেক দূরদর্শী চিন্তাবিদের প্রশ্ন, বোমা মেরে না হয় পরমাণু স্থাপনা ধ্বংস করে দেওয়াই হলো, কিন্তু পরমাণু প্রযুক্তির জ্ঞান? সেটা ধ্বংস করবে কী করে? পুড়বে কী করে? জ্ঞান তো মৌসুমি বায়ু। আর বৃষ্টির পরশে লকলক করে বেড়ে উঠবেই। সুতরাং গায়ের জোর কিংবা ক্ষমতার জোর দেখিয়ে লাভ নেই! কূটনীতিই একমাত্র পথ এবং এ পথেই রয়েছে সমাধান। যুদ্ধের লাভ-ক্ষতির হিসাব কষলে দেখা যাবে মার্কিন দাবির বিপরীত চিত্র। কাতার এবং ইরাকের মার্কিন বিমান ঘাঁটিগুলোতে ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে ইরান। একই ভাবে খায়বার শেকান নামের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরাইলের অভ্যন্তরে। ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীরা এখন দুঃস্বপ্নের রাত-দিন কাটাচ্ছে। তারা ভেবেছিল ইসরাইল অভেদ্য, দুর্ভেদ্য। কিন্তু এখন দেখল সবই অসত্য। সুতরাং তারা আর থাকবে না সেখানে, চলেই যাবে! কারণ অনিশ্চিত জীবন নিয়ে হবেটা কী! এটা তো তাদের পিতৃভূমি নয়, উড়ে এসে জুড়ে বসেছে তারা। ফিরে যাবে এখন নিজেদের ঠিকানায়। এখানে থাকবে শুধু ভূমির মালিক হামাসের জ্ঞাতি-গোষ্ঠীরাই। পক্ষান্তরে পারমাণবিক অধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত রাখা হবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইরান। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ যথারীতি চলবে বরং আরও তীব্র গতিতে। হরমুজ প্রণালির জলবোমার ব্যবহারও বিবেচনায় রাখা হয়েছে, যে কোনো মুহূর্তেই বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে। এনপিটি থেকে বেরিয়ে যেতে পারে ইরান। রাফায়েল গ্রোসি (আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা-আইইএইর বর্তমান মহাপরিচালক) এখন কাকুতি-মিনতি শুরু করেছেন ইরান যেন আণবিক শক্তি সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ না করে।
বলাবাহুল্য, ইরানের পালটা হামলায় হতবাক হয়ে গেছে পশ্চিমা বিশ্ব। স্বয়ং ট্রাম্প ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের প্রশংসা করেছেন। আবার ইসরাইলের সমরবিদ বলেছেন-ইরান এখনো তাদের ভয়ংকর মিসাইলগুলো ব্যবহার করেনি। ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু আন্তর্জাতিক কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না তাই তারা যা খুশি তাই করে বসতেই পারে। যুদ্ধবিরতির পরদিন ন্যাটোর বৈঠকে যোগ দিতে যাওয়ার সময় ট্রাম্প বলেছেন-পুনরায় যুদ্ধের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ইরান সে বিষয়টি মাথায় রেখেই প্রস্তুত রয়েছে। ১৩ জুন অতর্কিত হামলার দুর্বলতাগুলো এরই মধ্যে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে। বিশেষ করে মোসাদের চরগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড় হয়েছে এবং অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ইরান তো মূলত আক্রান্ত হয়েছে অভ্যন্তরীণ গুপ্তচরদের মাধ্যমে। সেই আখড়াগুলোর বেশির ভাগই এখন ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলোও এখন সক্রিয়।
অপরদিকে ইসরাইলের অভ্যন্তরে গাজার চিত্র দৃশ্যমান। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। ক্ষতিপূরণ চেয়ে দৌড়াচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। ইসরাইল ছেড়ে পালাবার ধুম লেগেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, বিশ্ববাসী জেনে গেছে ইরানের কাছে ইসরাইল মারাত্মকভাবে পরাজিত হয়েছে। এই গ্লানি তাদের ভেতর থেকে উসকানি দিলেও পুনরায় হামলা চালানোর মতো দুঃসাহস দেখানোর পর্যায়ে এ মুহূর্তে নেই ইসরাইল। অপরদিকে ট্রাম্পের গোয়েন্দা বিভাগ ইরানের পরমাণু স্থাপনা সম্পর্কে ইসরাইলের দেওয়া তথ্যগুলোকে অসত্য বলে অভিমত দিয়েছে। পশ্চিম এশিয়ায় কাপুরুষ মিত্রের চেয়ে স্মার্ট শত্রুর দিকে হাত বাড়ানোর কথা কি ভাববে ট্রাম্প? উত্তর ইতিবাচক হলে পুনরায় যুদ্ধ ইসরাইলের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া ইসরাইল শূন্য। সুতরাং বোকামি করলে পতনই ত্বরান্বিত হবে। তবে ট্রাম্পের বাড়ানো হাতের দিকে ইরান হাত বাড়াবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত গভীর পর্যালোচনার দাবি রাখে। মনে রাখতে হবে, ইরান উম্মাদ নয় ঠান্ডা মাথার খেলোয়াড়।
লেখক পরিচিতি : নাসির মাহমুদ। সিনিয়র সাংবাদিক ও বিশ্লেষক। ওয়ার্ল্ড সার্ভিস, ইরান ব্রডকাস্টিং