
যোবায়ের আল মাহমুদ
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নাগরিক সমাজের বিভিন্ন অংশ—বিশেষত সদ্য গঠিত নাগরিক কোয়ালিশন—নিজেদের সংস্কারের পক্ষে ‘সোচ্চার’ শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, তারা আসলে এমন কিছু সংস্কার প্রস্তাব করছে, যেগুলো কসমেটিক এবং উপসার্গিক; যা বাস্তবে সেই একই দমনমূলক ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ণ রাখবে অথচ যাকে তারা চ্যালেঞ্জ করার দাবি করছে।
ইচ্ছাকৃতভাবে হোক বা বিশ্লেষণী শক্তির অভাবে হোক, তারা রাষ্ট্রের মৌলিক ও গঠনমূলক পরিবর্তনের পথ রুদ্ধ করছে, যা বর্তমান ফ্যাশিস্ট-ঔপনিবেশিক-মাফিয়াচালিত কাঠামোকে ভেঙে পুনর্গঠন করতে পারত। উদাহরণস্বরূপ, তাদের সাম্প্রতিক সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবের কথাই ধরা যাক।
একটা গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধানের দাবিকে সামনে এনে ফ্যাসিবাদী সংবিধানকে উৎখাত করার বিপ্লবী আহ্বানের পরিবর্তে, নাগরিক কোয়ালিশন একটি দুর্বল সংস্কার প্রস্তাবে এসে থেমে গেছে, যা মূলত আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন কমিশনের প্রস্তাবগুলোর পুনরাবৃত্তি মাত্র। এই প্রস্তাবগুলো সরকার, সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে কিছু চেক অ্যান্ড ব্যালান্স তৈরি করতে চাইলেও, মূল ক্ষমতার আর্কিটেকচারকে অক্ষুণ্ণ রাখছে। তারা স্পষ্টভাবে নিচের তিনটি মৌলিক সমস্যাকে উপেক্ষা করছে-
ক. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিহিত ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার।
খ. রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের ফ্যাসিবাদী কলকবজা।
গ. সংসদীয় সার্বভৌমত্বের নামে চলমান লুটপাট ও স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা।
বাংলাদেশের মূল সংকট শুধু প্রতিষ্ঠানগত চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের অভাব নয়; সংকট হলো সার্বভৌমত্বের প্রকৃতিতে। বর্তমানে সার্বভৌমত্ব জনগণের হাতে নেই; বরং রাষ্ট্র, সরকার বা সংসদের হাতে, যারা বারবার জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর বিপরীতে, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান স্পষ্টভাবে একটি নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা প্রকাশ করেছে—যেখানে সার্বভৌমত্ব থাকবে নিরঙ্কুশভাবে জনগণ, ব্যক্তি ও সম্মিলিত মানুষের হাতে। নাগরিক কোয়ালিশন এই মৌলিক বিষয়টি ধরতে ব্যর্থ হয়ে এখন নিজেদের অজান্তেই সেই সংকটকেই বরং আরো দীর্ঘায়িত করে দিচ্ছে!
নির্বাচনের সময়সীমা এবং বিপ্লবী সম্ভাবনার অপচয় : নাগরিক কোয়ালিশন সম্প্রতি ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের যে দাবি জানিয়েছে, তা মূলত বিএনপি নেতৃত্বাধীন প্রো-এস্টাবলিশমেন্ট শক্তিগুলোর প্রস্তাবিত সময়সীমারই পুনরাবৃত্তি। যদিও সময়ের পার্থক্য মাত্র দুই মাস, কিন্তু এ সময় নির্ধারণের মধ্য দিয়ে একটি গভীরতর রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট হয়—বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিকতার পক্ষের অবস্থান। এই তড়িঘড়ি নির্বাচনের আহ্বান জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মূল দাবিগুলো হালকা করে দেয়।
অথচ এই অভ্যুত্থান মামুলি সরকার পরিবর্তনের আহ্বান ছিল না, বরং একটা বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা ছিল—একটা রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে যেই আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়েছে—ফ্যাসিস্ট, ঔপনিবেশিক এবং মাফিয়াচালিত রাষ্ট্রকাঠামোর সম্পূর্ণ অবসান ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞের স্বচ্ছ বিচার পরবর্তী পুনর্গঠন এবং দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কারের। নির্বাচনকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পুরোনো প্রতিষ্ঠানের কাঠামো সংরক্ষণ করে শুধু ক্ষমতার প্রতীকী হস্তান্তরের আয়োজন করবে মাত্র, যা গণতন্ত্রের নামে একটা প্রহসন হবে শুধু—যা প্রকৃত অর্থে জনগণের অধিকার ও চাহিদাকে উপেক্ষা করবে।
জনগণের ইচ্ছা ও সম্মিলিত শক্তির ওপর ভর করে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য সময় ও প্রক্রিয়ার প্রয়োজন। ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন দাবি করা মানে সেই সম্ভাবনাকে অগ্রিম ধ্বংস করে অল্প সময়টাকে স্রেফ নির্বাচনকেন্দ্রিক করে দেওয়া।
বাংলাদেশ এখন একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান শুধু সরকারের পরিবর্তন নয়, বরং ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বের ধারণায় মৌলিক রূপান্তরের সম্ভাবনার জানালা খুলে দিয়েছে। দেশের নাগরিক সমাজের উচিত এই মুহূর্তকে ধারণ করা—সংকুচিত সংস্কার প্রস্তাব বা ‘তড়িঘড়ি’ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে নয়, বরং দীর্ঘ, জটিল পুনর্গঠন, বিচার এবং গণতন্ত্রায়ণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তা করা উচিত। এর চেয়ে কম কিছু হলে, তা হবে জুলাইয়ের রক্ত, ত্যাগ এবং আশার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা!
গত ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে যে একান্ত বৈঠক হয়, সেখানেও তড়িঘড়ি নির্বাচনই আলাপের প্রধান ইস্যু ছিল এবং ফলে রাষ্ট্র সংস্কার ও রাষ্ট্র পুনর্গঠনের ইস্যু রাজনীতির কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়ার উপক্রম হয়েছে। প্রফেসর ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার গণঅভ্যুত্থানের রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও রাষ্ট্রীয় সংস্কারের দাবিকে উপেক্ষা করে এবং ফ্যাসিবাদী ও ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রেখে অকাল নির্বাচনের মাধ্যমে বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোকে অটুট রেখে শাসক পরিবর্তনের এজেন্ডার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন বা বাধ্য হয়েছেন বলে অনেকেই মনে করছেন।
এটা আমাদের জন্য হতাশা এবং উদ্বেগজনক। অথচ এই অন্তর্বর্তী সরকারেরই রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামো ভেঙে দেওয়ার মতো মৌলিক কিছু রাষ্ট্রীয় সংস্কার করা উচিত ছিল, কিন্তু সরকার এই দায়িত্ব পরবর্তী সরকারের ওপর ছেড়ে দিচ্ছে, যা নিঃসন্দেহে বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোপন্থি একটি সরকার হবে। সংস্কার ধারণাগুলো নিয়ে বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তোলা এবং সেই ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ প্রণয়নের কৌশলটি একটি ভুল কৌশল, কারণ এটি মৌলিক পরিবর্তনের সনদ নয়; বরং উপরি উপরি প্রসাধনী সংস্কারের সনদ হবে। এই সনদ মৌলিক পরিবর্তনকে বাধাগ্রস্ত করবে এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে ৯০-এর দশকের মতোই ব্যর্থ অভ্যুত্থানে পরিণত করবে।
বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোপন্থি দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ প্রণয়ন করা হলো জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে ধ্বংস বা ছিনতাই করার একটি ফাঁদ। ইউনূস সরকার এবং আলী রীয়াজসহ এর নীতিনির্ধারকরা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন, গণঅভ্যুত্থানই ঔপনিবেশিক-ফ্যাসিবাদী-মাফিয়া ব্যবস্থাকে উৎখাত করার ম্যান্ডেট দিয়েছিল।
ফলত, যেসব দল এই ব্যবস্থার অংশ, তাদের কাছ থেকে ঐকমত্য চাওয়া হবে উল্টো ফলদায়ক। অন্তর্বর্তী সরকারের যা করা উচিত ছিল, তা হলো ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা, ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা এবং মাফিয়া অলিগার্কি উৎখাতের জুলাই ঘোষণাপত্র (July Proclamation) জারি করা। এই ঘোষণার ভিত্তিতে সরকারের উচিত ছিল বর্তমান সংবিধান বাতিল করা, যা সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ স্থাপনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে এবং একটি নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের জন্য কাজ করা।
বাংলাদেশে সবাই দাবি করেন যে তারাই জনগণ এবং জনগণের কাছ থেকে তাদের ম্যান্ডেট আছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আমরা অস্পষ্ট ‘জনগণ’ শব্দের বদলে ‘রাজনৈতিক সম্প্রদায়’ (political community) পরিভাষাটি ব্যবহার করি। তাহলে রাজনৈতিক সম্প্রদায় কারা? রাজনৈতিক সম্প্রদায় হলো সেই সমষ্টিগত শক্তি, যাদের একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র/সংস্থা গঠনের গাঠনিক ক্ষমতা (constitutive power) আছে।
এই রাজনৈতিক সম্প্রদায়ই তাদের গঠনতন্ত্র রচনা করবে। আমাদের পুরোনো সনাতনী রাজনৈতিক দলগুলো ফ্যাসিবাদ ও নব্য-ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের পরও একটি নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে; এমনকি গণআকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করে গণঅভ্যুত্থানে পরাভূত হওয়া ওই মৃত সংবিধানে নতুন করে দম দিয়েছে।
তাই তাদের কোনো গঠনমূলক যোগ্যতা নেই এবং এরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ম্যান্ডেট বহন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই দলগুলো রাজনৈতিক দল নয়, বরং এগুলো মাফিয়া অলিগার্ক ও ঔপনিবেশিক ধাঁচের শাসকদের সাধারণ ক্লাব মাত্র। আলী রীয়াজ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের অন্য নীতিনির্ধারকরা এই বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোপন্থি দলগুলোর আকাঙ্ক্ষা ও দাবি বাস্তবায়ন করতে কাজ করছেন এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তনের জন্য গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ও দাবিগুলো উপেক্ষা করছেন।
প্রকৃত গণতান্ত্রিক, জনকেন্দ্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের পথে এগোতে হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার অপরিহার্য এবং তাদের মাফিয়া অলিগার্ক ও ঔপনিবেশিক ধাঁচের শাসকদের সংঘ-সংস্থা হওয়া চলবে না; বরং তাদের একটি রাজনৈতিক সম্প্রদায় হিসেবে কাজ করতে হবে। বর্তমান কাঠামোর ভিত্তিতে, এই রাজনৈতিক দলগুলোরও সংস্কার সম্ভব নয়। তাই গাঠনিক ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল গঠন করতে হবে এবং প্রাচীনপন্থি সনাতনী রাজনীতির বিলোপ করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের যদিও উচিত ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের কৌশল বাস্তবায়ন করা, তা না করে তারা বরং নিজেদের এই দলগুলোর দাবির কাছে সমর্পণ করছে। এটা লজ্জা ও হতাশার।
আমাদের দরকার খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ‘বৈপ্লবিক সংস্কার’, ‘সংস্কার’ নয়। রুটিন ফরমায়েশি সংস্কার তো এখন আলাপের বিষয়ই নয়, সেটা একটা প্রতিষ্ঠান এমনিতেই করবে পরে। রাজনৈতিক দলগুলো এবং ডিপ স্টেট দেশের ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোকে অক্ষত রাখার জন্যই রাষ্ট্রকাঠামোর খোলনলচে পরিবর্তন করার আলাপকে ধামাচাপা দিয়ে সংস্কারের আলাপ হাজির করছে, যেন তারা বলতে পারে ‘সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া’, ‘সংস্কার নতুন সরকার করবে’। শব্দের রাজনীতি বোঝার চেষ্টা করুন।
আপনি সংস্কারের আলাপ হাজির করলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। দরকার সংবিধান, প্রশাসন, আমলাতন্ত্র, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, নির্বাচন কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খোলনলচে পরিবর্তন, দরকার রাষ্ট্রযন্ত্রে ফ্যাসিবাদী এবং ঔপনিবেশিক যেসব উপাদান আছে, তার মূলোচ্ছেদ করে গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রবর্তন।
তা না করে কসমেটিক সংস্কার করে পুরানা সব জুলুমতন্ত্রের কাঠামো অক্ষত রাখার আলাপ আনলেই জনগণের অধিকারের রাজনীতি নাই হয়ে যাবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে নিছক একটি ভোটবাক্স বিপ্লবে সীমাবদ্ধ করা উচিত হবে না। এটি রাষ্ট্রের গঠনমূলক রূপান্তরের জন্য জনগণের শক্তির সর্বোচ্চ প্রকাশ। অতএব, নির্বাচন আয়োজনের আগে রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি বদলাতে হবে। শুধু একটি নতুন, গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক ও মানবিক রাষ্ট্রকাঠামোই বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রকৃত উত্তর হতে পারে। অথচ ফ্যাসিবাদী ও ঔপনিবেশিক কাঠামো উৎখাত বা মৌলিক সংস্কার শুরুর দাবি ছাড়াই দ্রুত নির্বাচন চান অনেকেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু নির্বাচন নয়, প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মৌলিক রূপান্তর। পরিবর্তন ছাড়া দ্রুত নির্বাচন চাইলে তা হবে আরেকটি গণপ্রতারণা। সে জন্য নির্বাচন আয়োজনের আগে নিম্নোক্ত কাজগুলো অপরিহার্যÑ
১. জনগণের সার্বভৌমত্ব ও অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের ভিত্তিতে একটি নতুন র্যাডিক্যাল গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করা আবশ্যক।
২. ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন, ২০০৩ সালের র্যাব আইন, ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সব ঔপনিবেশিক ও দমনমূলক আইন বিলুপ্ত/ব্যাপক সংস্কার করতে হবে।
৩. বলপ্রয়োগ বা সহিংসতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রীয় কাঠামো বিলুপ্ত করে জনগণের অধিকার ও মর্যাদার ভিত্তিতে নতুন কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৪. সংবিধান, প্রশাসন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও নিরাপত্তা বাহিনীতে থাকা সব ফ্যাসিবাদী প্রবণতা, ফ্যাসিবাদী আইন, ফ্যাসিবাদী কাঠামো ও কলকবজা সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করতে হবে।
৫. নীতিনির্ধারণে আমলাতন্ত্রনির্ভরতা দূর করে, বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ ও স্টেকহোল্ডারদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নীতি প্রণয়ন করতে হবে। সংসদ সদস্যরা এই নীতির খসড়া পর্যালোচনা করবেন এবং তারপর আমলারা তা বাস্তবায়ন করবেন।
৬. সংসদ সদস্যদের ভূমিকা শুধু আইনপ্রণয়ন ও নির্বাহী ক্ষমতার ওপর নজরদারিতে সীমিত রেখে স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের হাতে উন্নয়ন কার্যক্রম ন্যস্ত করতে হবে।
৭. গুরুত্বপূর্ণ জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গণভোটের মাধ্যমে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
৮. প্রতিনিধিত্বশীল সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে যে ‘সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র’ চলছে, তা বিলুপ্ত করতে হবে। পরিবর্তে সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যেখানে রাষ্ট্রপতি হবেন নির্বাহী প্রধান এবং সংসদ তার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করবে।
৯. সমস্ত ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত বা মৌলিকভাবে সংস্কার করতে হবে। যেমনÑজমিদারের মতো ক্ষমতাসম্পন্ন ডিসিপ্রথা বিলুপ্ত করতে হবে।
১০. ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বর্তমান সংসদ ব্যবসায়ী অলিগার্কদের দ্বারা দখলকৃত এবং তাদের লুটপাট ও শোষণের আইনগত রক্ষাকবচে পরিণত হয়েছে। এই ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করতে হবে। নির্বাচনী ব্যবস্থায় মৌলিক সংস্কার এনে এই ‘মাফিয়া রাজনীতি’ বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষমতা কাঠামোর যেই লুটেরা মাফিয়া চরিত্র তা অক্ষত রেখে খালি রাষ্ট্রের তিন বিভাগের মাঝে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করলে তা হবে কসমেটিক সংস্কার, কোনো মৌলিক পরিবর্তন তাতে ঘটবে না। ‘পার্লামেন্টারি স্বৈরতন্ত্র’ এবং ‘পার্লামেন্টারি ক্লেপ্টোক্রেসিকে’ অক্ষত রেখে যে সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে, তাতে বিদ্যমান লুটেরা মাফিয়া রাজনীতি চলমান থাকবে।
লেখক : চিন্তক এবং সহযোগী অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়