Image description
এলাহী নেওয়াজ খান
 

রাজনৈতিক শাসনের বাইরে গিয়ে আজ অন্য কিছু লিখতে চাই। কারণ রাজনীতির বিষয়ে লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে, এর বাইরে বুঝি আমাদের সমাজে আর কোনো সংকট নেই; যদিও এ দেশের মানুষ রাজনীতির চর্চাকে ধর্মীয় চর্চার থেকেও অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ফলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক সমস্যা ও সংকট নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না। এমনকি সংবাদপত্রগুলোর বেশিরভাগ জায়গা দখল করে রাখে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ। আবার সেইসঙ্গে এটাও সত্য, পাঠকদের মধ্যে রাজনৈতিক ঘটনাবলি জানার আগ্রহ অনেক বেশি। তবুও আজ আমি একটু অন্য বিষয়ে আলোচনা করতে চাই, যাকে বলা যায় চলার পথের গল্প। অর্থাৎ চলতে-ফিরতে যে অভিজ্ঞতা আমরা অর্জন করে থাকি, তার ওপর ভিত্তি করে কিছু কথা।

যেমন ১৯৮৮ সালের একটি ঘটনা। আমি প্রথমবারের মতো মালয়েশিয়ায় বেড়াতে গিয়েছি—কোনো পেশাদারি কাজের জন্য নয়, নিছক ঘুরেফিরে দেখা। বিদেশি কোনো একটা বিমান সংস্থার বিজ্ঞাপনে আলো ঝলমল কুয়ালালামপুরের একটি চমৎকার দৃশ্য আমার অন্তর ছুঁয়ে গিয়েছিল। তাই সেখানে যাওয়া। প্রথমে ব্যাংকক তারপর ট্রেনে কুয়ালালামপুর। পরে সেখান থেকে সিঙ্গাপুর। এখানে উল্লেখ করতে হয়, তখন ওইসব দেশে যেতে ভিসা লাগত না। এয়ারপোর্টে পৌঁছে ভিসা নেওয়া যেত, যাকে বলা হয় ‘অন অ্যারাইভাল’ ভিসা।

তখনো মালয়েশিয়ার চেহারায় ফুটে ছিল তৃতীয় বিশ্বের চাপ। সবে ডা. মোহাম্মদ মাহাথিরের নেতৃত্বে উঠি-উঠি করছে। এর ১৯ বছর পর দ্বিতীয়বার যখন সেখানে যাই, তখন তো বিস্ময়ের ঘোর কাটতে বেশ সময় লেগেছিল। কারণ মাত্র ১৯ বছরের ব্যবধানে এত উন্নতি সত্যিই বিস্ময়ের ব্যাপার।

যাহোক, আবার আসল কথায় আসা যাক। সেই ’৮৮ সালে কুয়ালালামপুরের খোলা জায়গাগুলোয় ছোট ছোট অনেক রেস্টুরেন্টে মানুষজন খাওয়াদাওয়া করত। এক রাতে সেখানে একটি রেস্টুরেন্টে বসে খাচ্ছিলাম। একজন মালয়েশীয় মুসলিম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি ভারতীয়?’ আমি বললাম, ‘জি না, আমি বাংলাদেশি।’ ‘ওহ! আচ্ছা বলুন তো আপনাদের দেশে এত ঝড়, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস কেন হয়?’ আমি বললাম, ‘এটা তো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কারো কিছু করার নেই।’ সঙ্গে সঙ্গে লোকটি বলে উঠল, ‘নিশ্চয়ই, আপনাদের লোকেরা মিথ্যা কথা বলে আর মাপে কম দেয়।’ কথাটা শুনে আমি চমকে উঠলাম। সত্যই তো আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে ওই দুটি বৈশিষ্ট্য ভালোভাবে বিদ্যমান আছে। মিথ্যা কথা বলা এবং ওজনে কম দেওয়া ভয়াবহ পাপ। যে জাতির মধ্যে এর প্রসার থাকবে, সে জাতির ওপরে নানারকম দুর্যোগ নেমে আসবে। পবিত্র কোরআন‌ ও হাদিস শরিফে এ ধরনের পাপের ভয়াবহ শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। অতীতে এ ধরনের পাপের জন্য হজরত শোয়েব (আ.)-এর কওম সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এখনো যে সেটা ঘটবে না, সেটা কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়।

ঢাকায় একটা সময় ছিল আমরা সাধারণত গরুর গোশত কিনতে যেতাম ঠাটারী বাজারে। সে বাজারে গোশতের মাপে কম দেওয়ার বিষয়টি সবাই জানত। তারপরও লোকেরা ওখানে যেত, কারণ তখন ঠাটারী বাজারই ছিল গরুর গোশতের সবচেয়ে বড় বাজার। এই বাজার নিয়ে মাপে কম দেওয়া ছাড়াও আরো অনেক গল্পকাহিনি রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে মোষের গোশতকে গরুর গোশত বলে চালিয়ে দেওয়া। এসব সত্ত্বেও আমরা ওখানেই যেতাম গরুর গোশত কিনতে। মাপে কম হতোই। যাহোক, একদিন আমি গোশত কিনতে গিয়ে কসাইকে বললাম, ‘আল্লাহকে হাজির-নাজির রেখে মাপ দেন, কম দিয়েন না।’ লোকটি কিছুক্ষণ চুপ থেকে গোশত কাটা শুরু করলেন। তারপর ওজন দিয়ে বললেন, ‘মাপে কম দিইনি, নিয়ে যান।’ পাশে আমার এক বন্ধুর দোকানে গিয়ে মাপ দিয়ে দেখলাম, ঠিক আছে। এটা ছিল একটা অবাক করা ঘটনা। হয়তো কিছুক্ষণের জন্য হলেও তিনি আল্লাহকে ভয় পেয়েছিলেন।

এ রকম অনেক ঘটনা আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘটছে। ঢাকা নগরীর ব্যাপক সম্প্রসারণ এবং লোকসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এ ধরনের ঘটনার ব্যাপকতা এখন অতীতের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। এ রকম আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। সময়টা ছিল ২০০১ সাল। আমি তখন ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এ কর্মরত ছিলাম। কাজ শেষে রাতে ফেরার পথে প্রায় ফকিরাপুল বাজারে কেনাকাটা করতাম। এক রাতে মাছের বাজারে ঢুকতেই ভালো কিছু ইলিশ মাছ দেখে লোভ হলো। মাছ বিক্রেতা বৃদ্ধ একজন। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘চাচা, এগুলো কোথাকার ইলিশ?’ তিনি ঘাড় নেড়ে বেশ আস্থার সঙ্গে বললেন, ‘কেন, পদ্মার ইলিশ।’ এ প্রসঙ্গে আজ একটু বলে রাখা দরকার যে, বহুদিন ধরে ঢাকায় চট্টগ্রামের ইলিশকে পদ্মার ইলিশ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। সে কারণেই ‘কোথাকার ইলিশ’—এটা সবাই জিজ্ঞেস করে থাকে। আমিও তা-ই করেছিলাম। তবে আমি বৃদ্ধের কথায় আস্থা না রেখে আমি শুধু বললাম, ‘চাচা আল্লাহর কসম খেয়ে বলেন তো এটা পদ্মার ইলিশ।’ লোকটি এবার একদম চুপসে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলে উঠলেন, ‘বাবা, সত্যি কথার ভাত নেই।’

আমাদের সমাজে এটাই এখন প্রতিষ্ঠিত যে, সত্যি কথার ভাত নেই। তাই এখন সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণ এমনভাবে ঘটেছে যে, কোনটা মিথ্যা আর কোনটা সত্য, তা এখন যাচাই করা দুঃসাধ্য একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার সীমাহীন মিথ্যাচার পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। অথচ মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রিত কোরো না। জানা সত্ত্বেও সত্য গোপন কোরো না (সুরা বাকারা, আয়াত-৪৩)। কুরআনুল করিমের এই আয়াতটি সেনানিবাসসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখতে দেখেছি।

কিন্তু বর্তমানে সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে শুধু মিশ্রণই করা হচ্ছে না, বরং লোকেরা আল্লাহর কসম খেয়ে অনবরত মিথ্যা বলতে থাকে। সমাজের উচ্চস্তরের মানুষদের কথা বাদই দিলাম; কিন্তু ঢাকায় আসা গ্রামের সেসব সরল-সোজা (!) মানুষগুলো যখন প্রতারণা ও মিথ্যার আশ্রয় নেয়, তখন আর যাওয়ার জায়গা থাকে না কোথাও। আজ ঢাকায় ছোট-বড় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বিক্রেতা গ্রামের ওই মানুষগুলো। আপনি কিছু একটা কিনবেন, তাদের ওপর বিশ্বাস রেখে বলবেন, ‘ভাই, খারাপটা দিয়েন না।’ কিন্তু বাসায় গিয়ে দেখবেন, বেছে বেছে খারাপগুলোই দিয়েছে বেশি। আবার আপনি যদি বেছে বেছে ভালোটা নিতে চান, তখন বলবে, ‘বেছে বিক্রি করি না।’ এখন শুধু সত্যের সঙ্গে মিথ্যার মিশ্রণই ঘটছে না, ভালোর সঙ্গে মন্দ জিনিসের মিশ্রণ ঘটিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। যেমন ধরুন এখন আমের সিজন। রাস্তার পাশে আম নিয়ে কেউ বসে আছে। আপনি দরদাম ঠিক করে একটা পলিথিনের ব্যাগে বেছে বেছে আম তুলছেন। বিক্রেতাও তুলে দিচ্ছেন। আপনি তাকে বললেন, ‘ভালোটা দিয়েন।’ তখন তিনি বলে উঠবেন, ‘সারা বছর এই এলাকায় ব্যবসা করি। ভালো না হলে ফেরত দিয়েন।’ বাসায় গিয়ে দেখবেন, বেছে বেছে খারাপটাই দিয়েছে বেশি।

তবে এ সত্য স্বীকার করতে হবে যে, গ্রামের মানুষগুলোর দ্বারা মধ্যবিত্ত নগরবাসী প্রতারিত হলেও ওরা টাকাগুলো পাঠায় গ্রামে আপনজনদের কাছে। আর উচ্চস্তরের রাষ্ট্রের সুবিধাভোগীরা তাদের অবৈধভাবে উপার্জিত টাকাটা পাচার করে বিদেশে। এদিক দিয়ে বিচার করলে অন্তত এই সান্ত্বনা পাওয়া যায় যে, গ্রামের ওই প্রান্তিক লোকেরা আমাদের প্রতারণা করলেও তাদের টাকাটা দেশেই থেকে যাচ্ছে।

পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়ে আছে যে, মিথ্যা ও প্রতারণার কারণে বাজারে ভেজাল ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। তাই অনেকে তামাশা করে বলে থাকে যে, ‘আজকাল বিষ খেলেও মানুষ মরে না, কারণ বিষেও ভেজাল থাকে।’ তবে একটা ভেজালের ব্যাপারে এদেশের মানুষ বহু বছর আগে থেকেই বেশ পটু, সেটা হচ্ছে দুধে ভেজাল। আমি নিজে দেখেছি নদীর পানি দিয়ে কলস ভরতে। এটা ছিল ষাটের দশকের শেষের দিকের একটি অভিজ্ঞতা। আমি যাচ্ছিলাম লঞ্চে করে খুলনা শহরের দিকে । লঞ্চটি ‘বড়দিয়া বাজারে’ ভিড়লে অনেকগুলো কলস উঠল। সবগুলোয়ই দুধ ছিল অর্ধেকটা। দিন-দুপুরে সবার সামনে কলসের বাকিটা পূর্ণ করা হলো পানি দিয়ে। আর পানিভরা দুধের কলসগুলো খুলনা শহরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল বিক্রি করতে। আর এভাবেই খুলনা শহরের মানুষেরা গ্রাম থেকে আসা ‘খাঁটি’ দুধ পান করত!

একসময়কার বিখ্যাত সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘বিচিত্রা’য় একবার দুধে ভেজাল দেওয়ার ওপর একটি প্রচ্ছদ কাহিনি প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবেদনে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে তাতে বলা হয়েছিল, একটি বাড়িতে যে গোয়ালা দুধ দিত, সে দুধের সঙ্গে বাড়িওয়ালা একটি টেংরা মাছ পেয়েছিল। তবে দুধের কাহিনি ছাড়াও একটা সময় ছিল, এ দেশেই আমরা অনেক জিনিস প্রশ্ন ছাড়াই কিনে ফেলতাম। ভেজাল আছে কি না চিন্তাই করতাম না। অথচ আজ অনেক জিনিস কিনতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি, ‘ভাই, খাঁটি আছে তো?’ আগে বাজারে গিয়ে খেজুরের গুড় কিনতে গিয়ে কোনো সন্দেহ হতো না। এখন বাজারে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘ভাই, খাঁটি গুড় আছে তো?’ ওরা তিন ধরনের গুড় দেখায়। শেষের দামি গুড়টাকে বলে খাঁটি। তারপরও বিশ্বাস হয় না। আখের গুড়ের ক্ষেত্রে একই অবস্থা। এখন খাঁটি জিনিস খেতে হলে গ্রামে নিজেদেরই উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু সে সাধ্য তো খুব কম লোকেরই আছে। নগরবাসীকে হয়তো এভাবেই প্রতিনিয়ত ঠকে ঠকেই জীবন পার করতে হবে। অথচ এরকম একটা সমাজ আমরা কখনোই কল্পনাই করিনি।