Image description

কেন বড় পলিটিক্যাল পার্টিগুলোতে সাবেক বাম বা সাবেক শিবিরদের দেখা যায়? কেন বিএনপি বা আওয়ামীলীগে প্রচুর বাম নেতা দেখা যায়? বিএনপি বা নতুন হওয়া এনসিপিতে অনেক সাবেক শিবির ও সাবেক বাম নেতা যোগ দিয়েছে। সাবেক মুসলীম লীগ থেকে অনেকেই যুক্ত হয়েছিলো বিএনপির শুরুর দিকে। কেন বাম বা শিবির নেতাদের একটা অংশ তাদের নিজ নিজ মাদার-সংগঠনের রাজনীতি না করে অন্য দলগুলোতে গিয়ে নেতা হয়?


মনোপোলি বা অলিগোপলি ইন্ডাস্ট্রিতে বড় (ডমিনেন্ট) ফার্মগুলোর মার্কেট পাওয়ার বেশি হওয়ায় তারা বেশি রিসোর্স অ্যাট্রাক্ট করতে পারে- দক্ষ কর্মী থেকে শুরু করে বিনিয়োগ, লোন, টেকনোলজি-ইনোভেশন, সাপ্লাই চেইন ম্যাটেরিয়াল, ব্রান্ড রেপুটেশন, লিগ্যাল সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি ইত্যাদি। রিসোর্সের দিক থেকে আপার-হ্যান্ডে থাকায় তারা ছোট ফার্মগুলোর রিসোর্সকেও অ্যাট্রাক্ট করতে পারে (দক্ষ কর্মী), এবং বিজনেস স্কেল-আপ করতে পারে বলে উৎপাদন খরচ কমে যায়, চাইলে তুলনামূলক কম দামে প্রডাক্ট বাজারজাত করেও প্রফিট করতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় তারা ছোট ফার্মগুলোর কনজুমারদেরও (গ্রাহক) নিয়ে নেয়।  


আবার কর্মীদের দিক থেকে চিন্তা করলে তারা ডমিনেন্ট কোম্পানিতে সুইচ করলে বড় নেটওয়ার্ক পায়, প্রভাব তৈরি করতে পারে। ছোট কোম্পানিগুলোর দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার চান্স বেশি থাকে, ক্যারিয়ার গ্রোথের পসিবিলিটি কম। বেনেফিট বনাম রিস্ক তুলনা করে কর্মীরা বড় কোম্পানিতে সুইচ করতে চায়।
আমজনতার দলের তারেক রহমান (সাবেক গণ অধিকার পরিষদ) ফেস দ্যা পিপলের একটা টকশোতে বলেছেন তার দলটা খান খান হয়ে গেছে কারণ কর্মীরা এনসিপিতে চলে গেছে। 


আদর্শিক বিভাজনের বাইরে গিয়ে অধিকারকে ফোকাস করে সাম্প্রতিক সময়ে দুটো দল হয়েছে বাংলাদেশে- গণ অধিকার পরিষদ এবং এবি পার্টি। এনসিপি হওয়ার পর এই দুই পার্টি থেকেই অনেক তরুন নেতারা এনসিপিতে চলে এসেছে। অনেকটা দুইটা দল তরুন নেতৃত্ব বা কর্মীশূন্য হয়ে গেছে বলা চলে। শুনেছি গণ অধিকার বিলুপ করে নুরের পার্টির সবাই চলে আসতে চেয়েছিলো এনসিপিতে, এনসিপি সবাইকে নিতে রাজি হয় নাই। 


আবার পরবর্তীতে গণঅভ্যুত্থানের আরেক গ্রুপের হাত ধরে আপ বাংলাদেশ হওয়ার পর এনসিপির কর্মীদের একটা গ্রুপ আপে চলে গেছে। এ কারণে এনসিপি অনেকটা কর্মীবিহীন নেতারদের দল হয়ে গিয়েছে। অনেকে মনে করেন এনসিপি-জামায়াতের মধুর সম্পর্ক থেকে ক্রাইসিস শুরু হয়েছে আপ বাংলাদেশ হওয়ায়। এনসিপির কেউ কেউ মনে করেন এনসিপির মতোই আপ বাংলাদেশকে জামায়াত ব্যাক দিচ্ছে বলে এনসিপির কর্মীরা সেখানে চলে গিয়েছে এবং এনসিপির অনুষ্ঠানে মানুষের সমাগম কমে গেছে। এনসিপি ও আপ বাংলাদেশ এবং এবি পার্টি ও আপ বাংলাদেশের মধ্যেও সম্ভবত এক ধরণের টানাপোড়ন চলছে সাপ্লাই চেইন ইস্যুতে ভাগ বসানোর কারনে।


শিবির বা বাম থেকে তৈরি হওয়া ছাত্রনেতাদের একটা গ্রুপ কেন অন্যান্য দলে চলে যায় নিজেদের মাদার অর্গানাইজেশন জামায়াত বা সিপিবি/জাসদে না গিয়ে?
বাম বা শিবিরের মতো ছাত্রসংগঠনগুলো আদর্শিক দল হওয়ায় তাদের রাজনৈতিক ও আদর্শিক ট্রেনিং তুলনামূলকভাবে অন্যদের চেয়ে ভালো হয়। কিন্তু রাজনীতিতে আদর্শিক গোলের সাথে সাথে আরো অনেক ম্যাটেরিয়াল ব্যাপার জড়িত আছে। রাজনৈতিক নেতা হলে নিজের বলয়ে মানুষ প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে, বৈষয়িক অনেক সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে পারে, ক্যারিয়ারে সুবিধা পায়, নিজের পরিবার-আত্মীয়স্বজন সহ কাছে মানুষদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিতে পারে, সেলিব্রেটি ইমেজ তৈরি হয়, ব্রডার নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারে দেশে বিদেশে এবং অর্থবিত্তের মালিক হওয়াসহ আরো অনেক অপরচ্যুনিটি আসার পথ তৈরি হয়।


ছাত্রজীবনে আদর্শিক বোধ অনেক প্রকট থাকলেও (নিঃস্বার্থভাবে আদর্শের জন্য/সত্যের জন্য জীবন দিয়ে দেয়ার অনুপ্রেরণা) বয়স বাড়ার সাথে সাথে রাজনৈতিক জীবনের অপর অংশ তাদের আকর্ষণ করে। এটা খুব স্বাভাবিক হিউম্যান ন্যাচার। বড় দলগুলো বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা দলগুলো যেহেতু এ রিসোর্সগুলো বেশি দিতে পারে তাই তারা বিভিন্ন দল থেকে দক্ষ নেতাদের অ্যাট্রাক্ট করতে পারে। এজন্য ছাত্রদল বা ছাত্রলীগ থেকে ইন্টেলেকচ্যুয়াল কর্মী তৈরি না হলেও বিএনপি বা আওয়ামীলীগের প্রব্লেম হতো না বা হয় না। বিভিন্ন দল থেকে তৈরি হওয়া লোকেদের তারা অ্যাট্রাক্ট করে নিয়ে আসতে পারে।


একজন নেতা/অ্যাক্টিভিস্ট যখন দেখবে এনসিপি করলে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা যাবে, সে তখন তারেকের আমজনতার দল বা নুরের গণ অধিকার পরিষদে থাকাকে র‍্যাশনাল মনে করবে না। রাজনৈতিক অ্যাসপাইরেশন তৈরি হওয়া শিবির বা বাম ছাত্রনেতারা যখন দেখে বিএনপি বা এনসিপিতে গেলে আমার হাতে বেশি রিসোর্স আসবে, আমি ক্ষমতার কাছাকাছি থাকবো তখন সে সেখানে চলে যায়। যদিও কেউ কেউ অনুপ্রবেশ বলে এটাকে ব্যাখ্যা করতে চায়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে অনুপ্রবেশ বলে কিছু নেই, ব্যক্তিস্বার্থই প্রধান নিয়ামক। আবার ছোট দলে থাকার রিস্কও আছে। বেনিফিট রিস্ক তুলনা করে কর্মীরা ডোমিনেন্ট পার্টিতে চলে যায়। যারা আদর্শকে বেশি প্রায়োরিটি দেয় সেটা ভিন্ন ব্যাপার।


বিএনপিকে টানা দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে রাখার লীগ এবং ভারতের একটা প্ল্যান ছিলো দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকলে এক সময় মুসলিম লীগের মতো বিএনপি নিঃশেষ হয়ে যাবে, কেউ কেউ লীগে যোগ দিবে, কেউ রাজনীতি ছেড়ে দিবে দীর্ঘদিন ক্ষমতার সুযোগ-সুবিধা পাবে না পেয়ে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকলে ক্ষমতার রাজনীতি করা দলের কর্মীরা অন্যদিকে চলে যাওয়ার চান্স থাকে। 


ক্ষমতা কাঠামোর বাইরে থাকা দলগুলো এজন্য ভাংগনের মুখে পড়ে বেশি। বামদের মধ্যে কেন ডজন খানেক দল, জামায়াতের মধ্যে কেন ভাংগন ধরতেছে, কওমী মাদ্রাসা বেইজড দলগুলো কেন ভেংগে যায় বা ডজন খানেক দল হয় এগুলোর একটা উত্তর হলো এখানে। ক্ষমতাসীন দল বা ক্ষমতায় যেতে পারবে আশা রাখে এমন দলে ভাংগন কম হয়। এনসিপিতে কেন ঐক্য কমে আসতেছে এটারও একটা কারণ হচ্ছে  ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়ার যে স্বপ্ন নিয়ে তারা যাত্রা শুরু করেছে সেটা এখন কিছুটা ফিকে হয়ে আসছে।

শিব্বির আহমদ