
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা; রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক। সংরক্ষিত নারী আসন-৫০ থেকে নির্বাচিত একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। ২০১৯ সালের ২৮ মে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচিত হন। ২০২২ সালের ১১ ডিসেম্বর সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিএনপির অবস্থান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন
কালবেলা: বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের ৯ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সময় তাদের পারফরম্যান্স আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
রুমিন ফারহানা: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আমাদের এবং দেশের মানুষের বিরাট প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু আমরা দেখছি অন্তর্বর্তী সরকারের ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও সেই প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রাপ্তিটা খুবই সামান্য। হাসিনার পতনের পর মানুষ আশা করেছিল আওয়ামী লীগের মূল আসামিরা বিচারের মুখোমুখি হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই সরকার কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি, বরং তারা নিরাপদে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা, তাদের কারাগারে নেওয়া হচ্ছে বা বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে। কিন্তু শত শত হত্যাকাণ্ডের, গুম-খুন-অবিচারের মূল নির্দেশদাতা, যারা এসব অপরাধ তত্ত্বাবধান করেছিল তাদের আইনের আওতায় আনতে সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগ আমলের সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ রাতের অন্ধকারে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। আমরা নেত্র নিউজের একটি প্রতিবেদন থেকে দেখেছি—রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই এবং ডিজিএফআইর ক্লিয়ারেন্স নিয়েই তিনি বের হয়েছেন। অথচ এ ঘটনায় সাসপেন্ড করা হলো কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে। অথচ পুলিশ এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিল না। অনেকে বলেছিলেন, আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে আদালতের আদেশ দিয়েই কেবল তাকে থামানো সম্ভব। আমি তাদের পাল্টা প্রশ্ন করতে চাই—আওয়ামী লীগের ১৫ বছর আমাকে দেশের বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি, এমনকি প্রথম ৭-৮ বছর আমার বিরুদ্ধে তেমন কোনো মামলাও ছিল না; তবুও আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমি হাইকোর্টের আদেশ নিয়ে এয়ারপোর্টে গেলেও পুলিশ আমাকে থানায় ৪-৫ ঘণ্টা বসিয়ে রাখত। সুতরাং, কারও মামলা না থাকলেও যাত্রা আটকে যাবে আবার কারও মামলা থাকা সত্ত্বেও তার যাত্রা হবে মসৃণ—এটা তো হতে পারে না। এই সরকারের কাছে এটা আমরা আশা করিনি।
দ্বিতীয়ত, আমরা দেখলাম সংস্কার নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এই সরকার কোন সংস্কারগুলো করবে, তা নয় মাসেও সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। সরকার এখনো তার রোডম্যাপ স্পষ্ট করতে পারেনি। উল্টো বারবার আমরা দেখেছি, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্সে অন্তর্বর্তী সরকারকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ যে ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, তা তারা ভঙ্গ করছে। সংবিধানে বলা হয়েছে, এ ধরনের সরকার শুধু নির্বাহী কাজগুলো করতে পারবে। এর বাইরে এ সরকারের কোনো ধরনের পলিসি ডিসিশন নেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই। কিন্তু আমরা দেখলাম সরকার সংবিধান সংশোধনের মতো বড় বিষয়ও তাদের এজেন্ডার মধ্যে আনার চেষ্টা করছে।
তৃতীয়ত, এ সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি কমন প্লাটফর্মে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার কিছু দলকে তাদের পোষ্য দল হিসেবে অলিখিতভাবে এক ধরনের স্বীকৃতি দিয়েছে। আর অন্য দলগুলোকে বৈরী অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। বিশেষ করে যে দলটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল এবং যারা লাগাতার ১৭ বছর নানা রকমের নির্যাতন ও নিপীড়নের মধ্যেও শেখ হাসিনার সরকারের সমালোচনা করে এসেছে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে এসেছে এই দলটিকে এই সরকার মুখোমুখি দাঁড়া করানোর এক ধরনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা দেখলাম বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রথমে বললেন, এই সরকার আমাদের সরকার, কোনোভাবেই এ সরকারকে আমরা ব্যর্থ হতে দেব না। কিন্তু সরকার যদি নিজেই নিজেকে ব্যর্থ করে আমরা কী করতে পারি!? আমার মনে হয় সরকার যেন নিজেই নিজেকে ব্যর্থ করার দিকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের বিনিয়োগ ৫৮ শতাংশ কমে গেছে। দেশি এবং বিদেশি কোনো বিনিয়োগই এ সরকার আকৃষ্ট করতে পারেনি। যতদিন পর্যন্ত দেশে একটি রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা না আসবে ততদিন পর্যন্ত সরকার বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারবে না। সুতরাং একমাত্র রেমিট্যান্স প্রবাহ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রতিটি খাত আমরা সংকুচিত দেখতে পাচ্ছি।
কালবেলা: রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধসহ বেশ কিছু ইস্যুতে হঠাৎ হঠাৎ আন্দোলন হতে দেখা গেছে। বিষয়গুলো কীভাবে দেখছেন?
রুমিন ফারহানা: পর্দার সামনে যাই ঘটুক না কেন; প্রকৃতপক্ষে পর্দার আড়ালে কী ঘটছে সে সম্পর্কে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। আমার রাজনৈতিক পদযাত্রার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, পর্দার পেছনে অনেক দল একসঙ্গে কানেক্টেড। সেই দলগুলো আবার সরকারের সঙ্গে কানেক্টেড। সরকার ক্ষমতা প্রলম্বিত করার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ এই সরকার লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকতে চাইছে। আর যে দলগুলো এই সরকারকে আরেকটু লম্বা সময় রাখতে চায়, সেখানে তাদেরও স্বার্থ রয়েছে। তারা দল গোছাতে আরেকটু সময় চায়। দেশের সংবিধান ঠিক করা, নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থীদের জিতিয়ে আনার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা, এসবের জন্য তাদের সময় প্রয়োজন। ফলে এই দুই পক্ষের মধ্যে একটি অলিখিত চুক্তি হয়েছে যে, তারা একই সঙ্গে একটি সিনক্রোনাইজওয়েতে কাজ করবে।
যে সরকারের কাজ কেবল প্রতিদিনের নির্বাহী কাজগুলো সম্পাদন করা, তারা কীভাবে করিডোর দেওয়ার মতো একটি ভীষণ রকমের রাজনৈতিক ও দেশের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে যুক্ত কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করে! সরকার এই সংবিধান অনুযায়ী শপথ নিয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে রয়েছে, দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকা কোনো ব্যক্তি কোনোভাবেই এমপি-মন্ত্রী হতে পারবেন না। আপনাকে কেবল বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। অথচ এই সরকারের বেশিরভাগ উপদেষ্টার দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে। সুতরাং তাদের হাতে দেশ কতটা নিরাপদ; আমি সেই প্রশ্ন রাখতে চাই। এই সরকার ৯ মাসে কোনো নির্বাচনী রোড ম্যাপ দেয়নি। এমনকি ডিসেম্বর থেকে জুন—এই অর্ধবছরের মতো বিশাল সময়ের মধ্যে নির্বাচন যে কোনো সময় হতে পারে, এটা বলে মানুষকে এক ধরনের ধোঁয়াশার মধ্যে রাখা হয়েছে। সুতরাং এই সরকারের খুব দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা আছে অন্তত আমি মনে করি না।
কালবেলা: বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। আপনার কি মনে হয় সরকারের নির্বাচন আয়োজনের মতো যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে?
রুমিন ফারহানা: সরকার চাইলে আগস্টের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু সরকার সেটা চাইছে না। নির্বাচন করতে কোন কোন জায়গায় হাত দেওয়া দরকার? এক হলো—প্রশাসন ও পুলিশ, দুই. নির্বাচন কমিশন, তিন. নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে গঠিত হয়ে গেছে। এমনকি নির্বাচন কমিশন বলছে তারা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করতে প্রস্তুত। নির্বাচন-সংক্রান্ত আইনগুলোও মোটামুটি আপটুডেট করা আছে। ভোটার তালিকা কমপ্লিট হয়েছে, আর নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণ নির্বাচন কমিশনের কাজ। এটা করতেও দু-তিন মাসের বেশি সময় কোনোভাবেই লাগার কারণ নেই। সুতরাং নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই প্রস্তুত রয়েছে। এখন নির্বাচন না দেওয়ার সরকারের সামনে আর কোনো কারণ নেই। সরকার যদি ৯ মাসের মধ্যেও প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করতে না পারে, তাহলে সেটা আগামী ৯০ বছরেও পারবে না। সুতরাং সেই আলোচনায় না গিয়ে এ মুহূর্তে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করার জন্য যা যা করা দরকার সরকারের তাই করা উচিত।
কালবেলা: সরকার কিছু সংস্কারের পর নির্বাচন দেওয়ার কথা বলছে। একে আপনি কীভাবে দেখছেন?
রুমিন ফারহানা: সংস্কারের পর নির্বাচন বিষয়টাকে আমি অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার কৌশল হিসেবে দেখছি। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস কিছু বড় সংস্কার এবং কিছু ছোট সংস্কারের কথা বলেছেন। কিন্তু কোনটি বড় সংস্কার এবং কোনটি ছোট সংস্থার সেটি কে নির্ধারণ করবে? আপনার কাছে যেটা বড় সংস্কার সেটা আমার কাছে ছোট সংস্কার মনে হতে পারে। আবার আমার কাছে যেটা বড় সংস্কার সেটা আপনার কাছে ছোট সংস্কার মনে হতে পারে। সুতরাং সংস্কার কোনটি বড় এবং কোনটি ছোট সেটা মাপার কোনো উপায় নেই।
সরকার কয়েকটি সংস্কার কমিশন করেছে। তারা তাদের রিপোর্ট দিয়েছে। দলগুলোর সঙ্গে সেই রিপোর্টগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। দলগুলো কোন কোন সংস্কারগুলোয় একমত এবং কোনগুলোর সঙ্গে একমত নয় সেটাও পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে। সুতরাং যে বিষয়গুলোয় এখন রাজনৈতিক দলগুলো মোটামুটিভাবে একমত হয়েছে, সেগুলো তাড়াতাড়ি করে ফেললে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া যায়। আর সংবিধান সংস্কারের কোনো এখতিয়ার এই সরকারের নেই।
কালবেলা: দেশে ’৯১ সালসহ আরও কয়েকটি সময়ে সংস্কারের কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমরা দেখেছি সে সংস্কারগুলো আলোর মুখ দেখেনি। এবারের সংস্কার আলোর মুখ দেখবে কি?
রুমিন ফারহানা: কাগজে-কলমে লিখে কখনো প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালীকরণ বা দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বরং এটার জন্য একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যাতে আরেকজন ফ্যাসিস্ট তৈরি না হয়, যাতে আরেকটি দল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী না হয়, যাতে কেউ মেয়াদের পর মেয়াদ ভোট ছাড়া ক্ষমতায় থাকতে না পারে—সেজন্য আপনাকে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এখানে প্রাথমিকভাবে যদি একটি মোটা দাগে সুষ্ঠু নির্বাচন পাঁচ বছর পর পর নিশ্চিত করতে পারে, এ দেশের মানুষ তাহলে একটি পর্যায়ে গিয়ে পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে। চার-পাঁচ টার্ম টানা সুষ্ঠু নির্বাচন হলে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হবে। বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগকে সেপারেশন অব পাওয়ারের থিওরি অনুযায়ী আলাদা করা সম্ভব হবে।
প্রথমত, পাঁচ বছর পরপর একটি সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত. মানুষকে তার অধিকারের ব্যাপারে আওয়াজ তোলা জারি রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রতিষ্ঠান একদিনে ধ্বংস হয় না। বরং ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়। সুতরাং, প্রতিষ্ঠান গড়তে চাইলেও সেটা একদিনে কিছু আইন পাস করে গড়া সম্ভব নয়। মানুষ যে মুহূর্তে বুঝতে পারবে যে, সরকারে কিছুটা বিচ্যুতি হচ্ছে তখনই মানুষকে সংবিধানের রক্ষাকর্তা ও দেশের মালিক হিসেবে আওয়াজ তুলতে হবে।
কালবেলা: ছাত্রদের নেতৃত্বে এনসিপিসহ নতুন করে আরও কিছু রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে। এই নতুন দলগুলোর বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
রুমিন ফারহানা: ছাত্রদের নেতৃত্বে গঠিত নতুন দলটি কোন আদর্শে রাজনীতি করছে সেটি এখনো আমার কাছে পরিষ্কার নয়। এই দলটির গঠনতন্ত্র এবং মতাদর্শ এখনো পরিষ্কার করতে পারেনি। গঠনতন্ত্র তৈরি হয়েছে কি না, সেটাও আমি জানি না। দলের নেতারা বলছেন তারা একটি মধ্যপন্থি দল হিসেবে এগোতে চান। এখানে আমার প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের মধ্যপন্থি দল হিসেবে এরই মধ্যে বিএনপি রাজনীতি করছে। তারা যদি বলতো, নতুন দল মধ্য ডানের রাজনীতি করবে তাহলেও একটি অর্থ দাঁড়াত। আর মধ্য বামের রাজনীতি এতদিন আওয়ামী লীগ করে গেছে। ফলে নতুন দল ঠিক কোন মতাদর্শে এগোতে চাইছে, সেটা পরিষ্কার নয়।
নতুন দলের নেতারা কিছু কিছু নতুন শব্দ প্রচুর ব্যবহার করছেন। যেমন—বাইনারি, বন্দোবস্ত, সংস্কার.... এই শব্দগুলো তারা সম্প্রতি রাজনীতির মাঠে খুবই জনপ্রিয় করেছে। কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তারা প্রকৃতপক্ষে কোন নতুন বন্দোবস্তের কথা বলছে? বাংলাদেশের দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় দীর্ঘ ৫০ বছর কেটে গেছে। ফলে আমরা সেই রাজনৈতিক দলগুলোর চরিত্র, ধারা ও রাজনীতির ধরন এরই মধ্যে দেখেছি। শেখ হাসিনা যখন তার পিয়নের ৪০০ কোটি টাকার সম্পদের কথা বললেন তখন একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি খুবই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু নতুন বন্দোবস্তের কথা বলে যারা এখন রাজনীতির কথা বলছে, তাদের দেখতে পাচ্ছি আট মাসে তাদের পিএসরা ৪০০ কোটি টাকার মালিক হচ্ছে। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তারা নিয়মিত ইফতার পার্টি করেছে। তারা দেড়শ দুইশ গাড়ির বহর ব্যবহার করছে। অথচ তারাই এক মাস আগে বলেছে যে, তাদের পকেটে একটি টাকাও নেই। মানুষ এই দ্বিচারিতাগুলো পছন্দ করে না।
আমি নিজে যে পরিবার থেকে উঠে এসেছি সেখানে আমাকে কখনো পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চড়তে হয়নি। অথচ আমি রাজনীতিতে আসার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রিকশায় চলাচল শুরু করি। আমি মনে করি, যাদের জন্য আমি রাজনীতি করছি তাদের কাছাকাছি যেতে হলে আমাকে যতটা সম্ভব তাদের মতো চলতে হবে, তা না হলে তাদের চাওয়া-পাওয়া এবং তাদের মনের কথা আমি জানতে পারব না। আমি মনে করি রাজনীতি করতে হলে আমাকে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আমি কোন জীবনযাপন বেছে নেব। আমাকে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আমি কাদের জন্য রাজনীতিটা করব। আমাকে খেয়াল রাখতে হবে, আমার টার্গেট গ্রুপের সঙ্গে আমার সংযোগ স্থাপন হচ্ছে কি না। যদি এগুলো আমি নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে আমার যাত্রা আসলে কেবল যাত্রাই, এটা কোনো পলিটিক্যাল যাত্রা নয়।
কালবেলা: সরকার ও এনসিপির সঙ্গে বিএনপির একটি বড় ধরনের দূরত্ব আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই দূরত্বটা কেন তৈরি হলো?
রুমিন ফারহানা: এই গণঅভ্যুত্থানকে এনসিপি শুধু তাদের অবদান এবং তাদের অর্জন বলে দাবি করা শুরু করল, তখন গণঅভ্যুত্থানের অন্যান্য অংশীদার তা মেনে নিতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক। এনসিপির তরুণ নেতারা যখন বিএনপিসহ গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসা দলগুলোকে নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্য শুরু করে, সেটা অন্যরা মেনে নিতে পারেনি। এনসিপির এই তরুণ নেতারা যখন রাজনীতি বুঝতেও শিখেনি, তখন আমরা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছি, আমাদের কর্মীরা গুম হয়েছে, খুন হয়েছে, বছরের পর বছর ধরে আমাদের কর্মীদের পালিয়ে থাকতে হয়েছে। এই সব ত্যাগকে তারা এক পাশে সরিয়ে দাবি করল গণঅভ্যুত্থান মাত্র ৩৬ দিনে কিছু ছাত্র মিলে করে ফেলেছে। কিন্তু বিষয়টি এমন নয়।
বিষয়টি এমন নয় তার একটি পুরো প্রমাণ হলো—সাম্প্রতিক সময়ে এনসিপির নিজেদের দলের মধ্যে যখন মিটিং হয়, তারা যখন জনসভা ও পথসভা করে সেখানে আমরা কিছু মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আর তাদের নিজেদের ছাড়া আর কোনো জনসম্পৃক্ততা দেখি না। তাদের সমাবেশে সাধারণ মানুষকে দেখা যায় না। অর্থাৎ বিএনপি এবং জামায়াতের অগণিত নেতাকর্মী যদি জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে আগস্টের ৫ তারিখ পর্যন্ত মাঠে না থাকত, তাহলে এই অভ্যুত্থান সম্ভব হতো না। এখন যেহেতু অন্যান্য রাজনৈতিক দল যার যার শিবিরে ফিরে গেছে, এজন্য এখন এনসিপির মিটিংয়ে আর জনসমাগম দেখা যায় না। কিন্তু সব কিছুর ক্রেডিট নিজেদের মধ্যে নিয়ে নেওয়ার প্রবণতা এটি অন্যান্য রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপিকে হতাশ করেছে।
দ্বিতীয়ত, এনসিপি এখনো ঠিকমতো গঠিতই হয়নি, তাদের এখনো নিবন্ধন বাকি রয়েছে; কিন্তু তারা এরই মধ্যে সরকারের সব সুযোগ-সুবিধা নেওয়া শুরু করেছে। এটি একটি রাজনৈতিক দলের কালচার হতে পারে না, বিশেষ করে যে দলটি নতুন বন্দোবস্ত এবং নতুন রাজনীতির কথা বলে। দেখতে পেলাম সরকারের মধ্যে উপদেষ্টা হিসেবে তাদের প্রতিনিধি রয়েছে। তাদের দলের অনেকে সচিবালয়ে তদবির, টেন্ডারবাজি ও নিয়োগ বাণিজ্য করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে এগুলোর কারণেও তাদের প্রতি এক ধরনের হতাশা, দুঃখ, ক্ষোভ মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে। এই সব কিছু মিলে বিএনপির সঙ্গেও তাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
কালবেলা: দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং বিএনপির আগামীর পরিকল্পনা কী?
রুমিন ফারহানা: সরকার নিজেই এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করতে চাইছে এবং সে অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার চেষ্টা করছে। বিএনপি এতদিন পর্যন্ত ভীষণ রকমের ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তার নেতৃত্বে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যরা সঠিক সিদ্ধান্তটাই নেবেন। আমরা একটি কথা বারবার পরিষ্কার করেছি—আমাদের কাছে দেশের স্বার্থ এবং দেশের মানুষের স্বার্থ সবচেয়ে আগে। সুতরাং এই দুটি জায়গায় যদি কোনো রকম কম্প্রোমাইজের প্রশ্ন আসে; বিএনপি সেটা মেনে নেবে না, বরং রুখে দাঁড়াবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এবং বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থের ওপরে অন্য কোনো দেশের স্বার্থ রক্ষা বিএনপি হতে দেবে না।
দেশনেত্রী খালেদা জিয়া সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। এটা পুরো বাংলাদেশের জন্য এটি বড় স্বস্তির বিষয়। বেগম জিয়াকে আমি কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের ফ্রেমে বন্দি করতে চাই না, বরং তিনি পুরো বাংলাদেশের নেতা। তিনি ফিরে আসা মানে বাংলাদেশে অনেকটা স্থিতিশীলতা ও শান্তি ফিরে আসা। তিনি বাংলাদেশের মাটিতে আছেন, এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটি ভরসার বিষয়। ইনশাআল্লাহ আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দ্রুতই বাংলাদেশে ফিরবেন এবং বিএনপি তার পরিকল্পনা অনুযায়ী সামনে এগিয়ে যাবে। বিএনপি অতীতেও কখনো সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেনি, আমরা আশা করি ভবিষ্যতেও ভুল করবে না। অতীতেও বাংলাদেশ বিএনপির হাতে নিরাপদ ছিল এবং ভবিষ্যতেও বিএনপির হাতেই নিরাপদ থাকবে।
শ্রুতলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম