Image description

আলফাজ আনাম

 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যেন এক অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছে ভারত। এ দেশে রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানকে শুধু অস্বীকার করেনি, শত শত ছাত্র-জনতার হত্যাকারী হাসিনা ও তার দোসরদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে নয়াদিল্লি।

গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার গঠনের দিন থেকে বাংলাদেশের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগের কৌশল নিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ভারতের প্রোপাগান্ডা মিডিয়ার প্রধান টার্গেট হন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এর পর থেকে এই সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চারটি ফ্রন্টে কাজ শুরু করে ভারত।

প্রথমে শুরু করা হয় ড. ইউনূস ও অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা। আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত নোবেলজয়ী একজন সরকারপ্রধানকে ভারতের গণমাধ্যমে তুলে ধরা হয় ইসলামপন্থি হিসেবে, যিনি চরমপন্থিদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রচারণা চালানো হয় তার মন্ত্রিপরিষদ, সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্র হিজবুত তাহরীরের হাতে। ভারতের গণমাধ্যমের এই মিথ্যা প্রচারণা বাংলাদেশ তো বটেই পশ্চিমের কোনো দেশেও হালে পানি পায়নি। সম্প্রতি পাক-ভারত যুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণার পর দেশটির গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা একেবারেই শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।

ভারতের গণমাধ্যমের বাংলাদেশবিরোধী উসকানিমূলক এসব প্রচারণার কোনো প্রভাব ইউনূস সরকারের ওপর পড়েনি। বরং সাধারণ মানুষ আরো দৃঢ়ভাবে মনে করে ভারতের প্রচারমাধ্যম যেহেতু ইউনূসের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে, সে কারণে ভারতের ব্যাপারে তার নীতি সঠিক পথে আছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণার পাশাপাশি বাংলাদেশের ওপর অর্থনৈতিক আঘাত হানার চেষ্টা করে ভারত। ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার আওয়ায় বাংলাদেশের কিছু পণ্য ভারতের বিমানবন্দরগুলো দিয়ে রপ্তানি করা হতো। হঠাৎ করে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের অল্প কিছু ভারতের বিমানবন্দর দিয়ে রপ্তানি করার কারণ ছিল এতে রপ্তানি খরচ কম হতো। কারণ ভারতে জেট ফুয়েলের দাম কম থাকায় কার্গোতে পণ্য রপ্তানি খরচ কম হতো।

ভারতের এই সিদ্ধান্তের পর বাংলাদেশ এ সমস্যা সমাধানে দ্রুত দুটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। প্রথমত, সিলেট ও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য রপ্তানি শুরু করে। একই সঙ্গে জেট ফুয়েলের দাম কমানো হয়। এর ফলে ভারত থেকে পণ্য রপ্তানিতে যে খরচ হতো, তা এখন বাংলাদেশ থেকে হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারতনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুলে যায়।

এরপর বাংলাদেশকে কাবু করতে স্থলপথে ভারতে বেশ কিছু পণ্য রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। বাংলাদেশি পণ্য ভারতে খুব সামান্যই রপ্তানি হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে মাত্র ১৫৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। অথচ বাংলাদেশ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৪ হাজার ২১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এ থেকে বোঝা যায়, ভারতের বাজারে বাংলাদেশের খুব কম পণ্য রপ্তানি হয়। এ দেশের অর্থনীতিতে এর বড় কোনো প্রভাব কখনো ছিল না।

এর আগে বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া কমিয়ে দেয় ভারত। বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে যেতেন, তাদের বেশিরভাগ কেনাকাটা ও চিকিৎসা নিতে যেতেন। এখন ভিসা বিধিনিষেধের কারণে সামান্য অসুস্থতায় যারা ভারত যেতেন, তারা দেশে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যাদের একান্ত যাওয়া দরকার, তারা থাইল্যান্ড বা চীন যাচ্ছেন। ঈদে ভারতে কেনাকাটা একেবারেই কমে গেছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশকে বড় ধরনের আঘাত করতে ব্যর্থ হওয়ার পর ভারত সীমান্তজুড়ে অস্থিরতা শুরু করে। বলা যায়, বাংলাদেশ সীমান্তে সন্ত্রাস চালাচ্ছে ভারত। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত রয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার। রাতের আঁধারে কিংবা ভোরবেলায় পাহারাহীন সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় নাগরিকদের জোর করে বাংলাদেশে পুশ ইন করা হচ্ছে। এর মধ্যে ভারতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারাও রয়েছে।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, যদি কোনো বাংলাদেশি নাগরিক ভারতে থেকে থাকে, তাহলে প্রমাণসাপেক্ষে তাদের গ্রহণ করা হবে। কিন্তু এর পরও ডাকাতের মতো অস্ত্রধারী বিএসএফ রাতের অন্ধকারে মানুষদের ঠেলে দিচ্ছে। এর একটাই লক্ষ্য হচ্ছে সীমান্তজুড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা।

সীমান্তে অস্থিরতা সৃষ্টির পাশাপাশি বাংলাদেশকে এখন সামরিকভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে ভারত। সম্প্রতি তিস্তার অববাহিকায় চিকেন নেকের নিরাপত্তার অসিলায় ‘তিস্তা প্রহার’ নামে সামরিক মহড়া চালানো হয়েছে। ভারতের গণমাধ্যমের দাবি, বাংলাদেশকে বার্তা দিতে নাকি এই সামরিক মহড়া চালানো হয়। এই মহড়ায় ইনফ্যানট্রি, আর্টিলারি, আর্মড কোর, আর্মি অ্যাভিয়েশন, ইঞ্জিনিয়ার্স ও সিগন্যালস অংশগ্রহণ করেছিল। মহড়ায় ড্রোনসহ সব ধরনের যুদ্ধপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল।

এসব দৃশ্যমান চাপ প্রয়োগের বাইরে দেশের ভেতরে অস্থিরতা সৃষ্টিতে ভারতের ভূমিকা রয়েছে। পতিত শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীরা এখনো দিল্লি থেকে হুমকি দিচ্ছেন। কলকাতা থেকে তার সহযোগী জুলাই অভ্যুত্থানের খুনের নির্দেশদাতা মন্ত্রীরা নানাভাবে তৎপর হয়ে উঠেছেন। এদের একটাই লক্ষ্য, দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তী সরকারের পতন ঘটানো, যাতে বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করা যায়।

প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে সম্প্রতি দেওয়া এক বিবৃতিতে সম্প্রতি স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে, ‘শত বাধার মাঝেও গোষ্ঠীস্বার্থকে উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তী সরকার তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকারের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হয়, তবে সরকার সব কারণ জনসমক্ষে উত্থাপন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।’ সরকারের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করতে পরাজিত শক্তি ও বিদেশি ষড়যন্ত্র যে কাজ করছে, সেটি বোঝা খুব কঠিন বিষয় নয়।

এই বিবৃতির পর প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদ বাংলাদেশের পরিবর্তনকে স্বীকার করতে চায় না। আমরা অনেক সংকটের মধ্যে আছি। পারলে আমাদের এক দিনে ধ্বংস করে দিতে চায়। সেজন্য যা যা করা দরকার তারা সব করছে।’ প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের সংকটের আসল কারণ ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছেন। আধিপত্যবাদী শক্তি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ধ্বংস করার চেষ্টা করে গেছে।

গত দেড় দশকে বাংলাদেশকে কার্যত দিল্লির উপনিবেশে পরিণত করা হয়েছিল। ভারত এখন তার হারানো উপনিবেশ ফিরে পাওয়ার জন্য নানাভাবে ষড়যন্ত্র করবে, এটি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, ভারতের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে দেশের অনেক রাজনৈতিক দল। তারা এখন দিল্লির ভাষায় কথা বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে ডাকছে অনির্বাচিত সরকার বলে। অথচ এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। ফ্যাসিবাদের সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট বামপন্থিরা আবারও তৎপর হয়ে উঠছে। হাসিনার শাসনে লুটপাটের সঙ্গে জড়িত অলিগার্ক ব্যবসায়ীরা মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন। কারণ তাদের লুটপাটের সাম্রাজ্যে আঘাত এসেছে।

ভারত একদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংস ও পুশ ইনের নামে সীমান্ত পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার চেষ্টা করছে, অপরদিকে দেশের ভেতরে বিভক্তি ও বিভাজন সৃষ্টি করছে। দিল্লিতে টিকিবাঁধা বাম দলগুলোকে দিয়ে আবারও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতি চালুর চেষ্টা করা হচ্ছে। ইসলামোফোবিয়ার রাজনীতি করে যারা গুম, খুন ও বিচারের নামে হত্যার রাজনীতি চালু করেছিল, তাদের আবারও আমরা রাজনীতির দৃশ্যপটে একই বয়ান নিয়ে হাজির হতে দেখছি। এগুলো সবই হচ্ছে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক রকম ব্যর্থতা থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, এই সরকার প্রতিষ্ঠার পর থেকে এক হাজারের বেশি আন্দোলন হয়েছে, এখনো চলছে। কিন্তু এত কিছুর পর ড. ইউনূস বাংলাদেশের মানুষের আত্মমর্যাদা ফিরিয়ে এনেছেন। আধিপত্যবাদী বৃহৎ প্রতিবেশীর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছি। বাংলাদেশের মানুষ এখন সত্যিকার অর্থে একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেদের ভাবতে শুরু করেছে। এটি এখন ভারতের সবচেয়ে বড় ভয়।

ভারত গত দেড় দশকে হাসিনার নিপীড়নমূলক শাসনের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের আত্মমর্যাদা বোধকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। দিল্লির দাস হয়ে থাকা যেন হয়ে উঠেছিল এ দেশের মানুষের নিয়তি। ড. ইউনূস দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে আধিপত্যবাদী শক্তির রূপ দেখছেন। তিনি সাহসিকতার সঙ্গে জনগণের সামনে তাদের তৎপরতার কথা তুলে ধরেছেন। কিন্তু তার একার পক্ষে এই আধিপত্যবাদী শক্তিকে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়, এজন্য দরকার জাতীয় ঐক্য। আমরা যদি তা না করতে পারি, তাহলে আমাদের ওপর দিল্লির অনুগত আরেকটি ফ্যাসিস্ট সরকার চেপে বসবে।