Image description

কয়েক সপ্তাহ আগে আমি বাংলাদেশের একটি টেলিভিশন টকশো দেখছিলাম। সেখানে জামায়াতে ইসলামীর নেতা ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ ও বিএনপির নেতা আজিজুল বারী হেলালের মধ্যে উত্তপ্ত আলোচনা হচ্ছিল। ড. মাসুদ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন—“এখন আর সেই যুগ নেই, রাজাকারের ট্যাগ দিয়ে আমাদের রাজনীতি থামানো যাবে না।” তিনি আরো এক ধাপ এগিয়ে বললেন, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান এই ধারণাগুলোকে বাতিল (!?!) করে দিয়েছে । 

আমার প্রশ্ন হলো—ড. মাসুদের আত্মবিশ্বাস কি বাস্তবতার প্রতিফলন? না কি কোনো বড় বাস্তবতা তিনি উপেক্ষা করছেন? কারণ এর পরই আমরা দেখলাম, শাহবাগে আওয়াজ উঠল—“গোলাম আযমের বাংলায় আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই”, জাতীয় সংগীত ইস্যুতে জামায়াতের পুরনো অবস্থান সামনে আসতেই সবার ক্ষোভ আরও বেড়ে গেল। সোশ্যাল মিডিয়ায় আবার সরব হলো “৭১”, “রাজাকার”, “মুক্তিযুদ্ধ”—এই শব্দগুলো। অনেকেই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম। 

এই ইস্যুতে বিএনপিও শুরুতে কিছুটা সরব হয়েছিল, কিন্তু পরে বিষয়টির দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে এর লাভ-ক্ষতির প্রভাব বুঝে তারা নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নেয়। এই জায়গায় আমি মনে করি, জামায়াতে ইসলামীর উচিত বিএনপিকে অন্তত ধন্যবাদ জানানো—তারা ইস্যুটিকে মাঠপর্যায়ে বড় হতে দেয়নি। যতটা চাপ তৈরি হয়েছে, সেটা হয়েছে মূলত সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন বিতর্কের ভেতরেই। 

এসব মিলিয়ে বোঝা যায়, শুধু গলাবাজি, চাপাবাজি,  ফেসবুক লাইক, ভুয়া তথ্য, বট বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে মানুষের মন জয় করা যায় না। বাংলাদেশের মানুষ এখনো মুক্তিযুদ্ধের বিষয়গুলো ভীষণ গুরুত্ব দিয়ে দেখে। তাই ড. মাসুদ যদি ভাবেন, পুরনো ইতিহাস ভুলে গেছে সবাই, তাহলে সেটা বড় রাজনৈতিক ভুল। উনাকে বিনয়ের সাথে অনুরোধ করব, একজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী গবেষক, সর্বোচ্চ জুলুমের শিকার ও ত্যাগী নেতা হিসাবে এই এইসব ব্যাপার নিয়ে আরো যেন গভীরভাবে চিন্তা করে।

যাহোক মূল প্রসঙ্গে আসি, আমার প্রশ্ন তাই খুব সহজ কিন্তু ভাবনার: জামায়াতে ইসলামী কি এই শতাব্দীর সেরা রাজনৈতিক সুযোগটা শুধু আত্মবিশ্বাস, ভুল কৌশল আর বাস্তবতা না বোঝার কারণে হারিয়ে ফেলছে? এই লেখাটি একটু দীর্ঘ, ধৈর্য ধরে পুরোটা পড়বেন। কারও অনুভূতিতে আঘাত নয়, বরং চিন্তার জায়গা তৈরি করাই আমার লক্ষ্য। “ওই সব দলই তো একই কাজ করেছে” - এই ধরনের বিতর্কে আমি এখনই যাব না। পড়ার সময় আপনাদের মাথায় রাখতে হবে যে, আমরা বাঙালিরা তার নিজের দলের বা পছন্দের লোকদের সমালোচনা শুনতে চাই না। কিন্তু হাদিসে এসেছে, “বুদ্ধিমান সে, যে আত্মসমালোচনা করে ও পরকালের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে” (মুসনাদে আহমাদ: ২৪২১৫)। 

আন্দোলনের পর হঠাৎ আত্মপ্রকাশ

আমরা জানি, জামায়াতে ইসলাম ও ইসলামী ছাত্রশিবির সাংগঠনিকভাবে আলাদা হলেও, বাস্তবতার চোখে সাধারণ মানুষ তাদের এক বলয়েই দেখে। কাজেই আলোচনার ক্ষেত্রে দুটি সংগঠনকে আমি একই কাতারে রাখছি। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা দেখলাম, ইসলামী ছাত্রশিবির হঠাৎ করে আন্দোলন সফল হবার পরই তারা 'ক্রেডিট' নেওয়ার চেষ্টা করল। এরপর শুরু হলো ‘ব্রিলিয়ান্স’ দেখানোর প্রতিযোগিতা—শিবির-ঘনিষ্ঠ অনেকে বললেন, তাদের কর্মীরা খুব মেধাবী, তাদের CGPA অনেক ভালো। তাহলে প্রশ্ন আসে—এই ‘ব্রিলিয়ান্স’ দিয়ে আসলে কী প্রমাণ হয়? “আমরা ভালো ছাত্র, তাই আমরাই সেরা”— এই মনোভাবটা তো আসলে সেই ব্রিটিশ আমলের রেখে যাওয়া মানসিকতা। যারা শাসন করত, তারা বলত “আমরা শিখেছি, তোমরা শিখো নাই, তাই আমরা শাসক, তোমরা প্রজা।” আজকে যারা নিজেদের মেধা আর রেজাল্টের দোহাই দিচ্ছেন, তারা কি নিজের অজান্তেই সেই ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিই আবার ফিরিয়ে আনছেন না? কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাজনীতি কি CGPA দিয়ে চলে? যদি তা হতো, তাহলে আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল CRI তো হার্ভার্ড, অক্সফোর্ডের ডিগ্রিধারী দিয়ে ভর্তি। তাদের অনেকে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছে। কিন্তু তারা কি আওয়ামী লীগকে সৎ করতে পেরেছে? পারেনি। 

আপনারা কি একবার ভেবে দেখেছেন, এই কথাগুলো যখন ছাত্রদল বা অন্য সংগঠনের সেই ছাত্ররা পড়ে—যারা বছর বছর জেল খেটেছে, মামলার ভয়ে আত্মগোপনে থেকেছে, পড়াশোনা বিসর্জন দিয়েছে—তারা কেমন অনুভব করে? তারা তো এই আন্দোলনে নিজেদের নাম, পরিচয়, নিরাপত্তা—সবকিছু ঝুঁকিতে ফেলে লড়েছে। এখন যদি বলা হয়, "আমরা মেধাবী, তাই আমরাই আসল নেতা", তাহলে সেটা কি তাদের প্রতি একধরনের উপহাস নয়? এটা শুধু ভুল বার্তা নয়, বরং একধরনের হৃদয়হীনতা। ১৭ বছর ধরে যেসব ছাত্র বাস্তবে জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করেছে, তাদের আত্মত্যাগকে আপনি কি একরকম মুছে দিচ্ছেন না? এটা রাজনৈতিক সৌজন্যের অভাব তো বটেই, মানুষের সম্মানবোধের বিরুদ্ধেও যায়। 

আমি এসব বলছি কাউকে অপমান করার জন্য নয়। আমি শুধু বোঝার চেষ্টা করছি—এই আন্দোলনের মধ্যে যে ঐক্যটা ছিল, সেটা কোথা থেকে নষ্ট হওয়া শুরু করল। আমার মনে হয়, সবচেয়ে বিপজ্জনক ছিল এই 'ক্রেডিট নেওয়ার প্রতিযোগিতা'। বিষয়টি আপনার কাছে ক্ষুদ্র মনে হতে পারে। কিন্তু এই ক্ষুদ্র বিষয়টি কারো অজান্তেই হোক পরবর্তীতে এর মধ্য দিয়েই ছাত্র রাজনীতির ভেতরে একটা বিভাজন তৈরি হয়েছে, যা জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। মিশরের তাহরির স্কয়ার বিপ্লবের (২০১১) নেতৃত্বে ছিল ছাত্ররা, তরুণ নাগরিক সমাজ, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা। কিন্তু হোসনি মোবারকের পতনের পর মুসলিম ব্রাদারহুড এবং সেনাবাহিনী উভয়ই ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতায় নামে এবং মূল আন্দোলনকারীরা ধীরে ধীরে ছিটকে পড়ে। ফলাফল: আন্দোলনের ক্রেডিট একতরফাভাবে নেওয়া হয়, ঐক্য ভেঙে যায়, কৃতিত্বের লড়াইয়ে বিভাজন সৃষ্টি হয় এবং শেষে সামরিক শাসন ফিরে আসে। 

বিশাল সুযোগ হাতছাড়া ও ভুল আত্মবিশ্বাস

এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, ইসলামী ছাত্রশিবির গোপনে হোক বা প্রকাশ্যে হোক এই আন্দোলনের সময় সত্যিই এক ধরনের ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল । অনেকেই বলেন, সভাপতি সাদিক কায়েমসহ (ড. মির্জা গালিব এবং এডভোকেট শিশির মনির) শিবিরের কিছু নেতাকর্মীর কাজের কারণে জনমনে একটি নতুন ইমেজ তৈরি হয়েছিল। মানুষ ভেবেছিল, হয়তো জামায়াতে ইসলাম অতীত ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোতে চায়। গণঅভ্যুত্থানে অবদানের কারণে তাদের প্রতি সমাজে এক ধরণের সহানুভূতি ও কৃতজ্ঞতাবোধ তৈরি হচ্ছিল । 

কিন্তু দুঃখজনকভাবে অতি আত্মবিশ্বাসের কারণে তারা সেই অর্জিত "গুড উইল" কাজে না লাগিয়ে বরং ফিরতে শুরু করে পুরনো কৌশলে— ভিন্ন ব্যানারে ক্যাম্পাস দখলের রাজনীতি, গোপন অবস্থান এবং এক ধরনের আত্ম-অহংকারের জোরে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায়। অথচ এটাই ছিল সেই মুহূর্ত, যখন ১৯৭১ সালের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে তারা মানুষের বিশ্বাস পুনর্গঠনের সুযোগ পেত। তারা যদি বলত, "আমরা যেসব ভুল করেছি, তার জন্য দুঃখিত", তাহলে অনেকে হয়তো তাদের নতুন চোখে দেখত—শত্রুও হয়তো নরম হতো। হয়তো তাদের ভোট সংখ্যা অনেক বেড়ে যেত। কিন্তু তারা তা করল না। 

বরং দেখা গেল, আন্দোলনের পরপরই তাদের কেউ কেউ অনলাইনে এমন বার্তা দিতে শুরু করল—“আমরা ছাত্রলীগকে সরাতে পারলে, ছাত্রদলকেও সরাতে পারব।” ধারণা প্রসূত হয়ে, বিএনপির সমর্থিত কুয়েটের  ভিসিকে “সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যানারে” তারা অপমান করে ক্যাম্পাস ছাড়া করলো। এই ধরনের মিথ্যা আত্মবিশ্বাসই ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক ভুল। তারা বুঝল না—রাজনীতি শুধু শক্তির খেলা না, এটি বিশ্বাস আর বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গা। জামায়াতের আমির ড. শফিকুর রহমান এক সময় বলেছিলেন, “আমরা ৭১ যদি ভুল করি, তাহলে সেটি স্বীকার করতে রাজি।” কিন্তু এই আত্মসমালোচনার ভাষা ছাত্রশিবিরের মধ্যে দেখা গেল না। বরং তারা ভবিষ্যতের পথ রচনার বদলে নিজেদের অতীতের ছায়ায় ডুবে থাকল। 

এই ভুল আচরণ শুধু তাদের দলের ক্ষতি করেনি, পুরো ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যৎকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। তারা হয়তো আজ কিছু মঞ্চে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছে, কিন্তু এই গোপন উপস্থিতি নিয়ে সন্দেহ শুরু হয়েছে। কেউ জানে না—আসলে কে কোন ব্যানারের অন্তরালে আছে। ভবিষ্যতে যদি ছাত্র সংসদ নির্বাচন আসে, তখন কি কেউ স্বচ্ছভাবে বিশ্বাস করতে পারবে—এই প্রার্থী আদৌ শিবির নয়? আমি ধারণা করছি ভবিষ্যতে কোন ইউনিভার্সিটিতে আর কখনো কোনদিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে না এই অবিশ্বাসের কারণে। কারণ কোন ভিসি কোন ছাত্রের মৃত্যু রিক্স নিবে না। এতে কার লাভ হলো? 

এমন ভুল আত্মবিশ্বাস এবং ক্ষমা না চাওয়ার উদাহরণ আমরা বিশ্ব রাজনীতিতেও দেখেছি। বেলজিয়ামের Vlaams Blok (বর্তমানে Vlaams Belang) নামের ডানপন্থী দলটি একসময় ফ্লেমিশ জাতীয়তাবাদ ও ইউরোপীয় পরিচয় নিয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু তাদের অতীতে ছিল বর্ণবাদী, অভিবাসীবিরোধী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী অবস্থান। তারা কখনোই এই ভুলগুলোর জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চায়নি বা অনুতপ্ত হয়নি। বরং ভেবেছিল, জনগণ ভুলে যাবে। এই আত্মতুষ্টি এবং অহংকার তাদের শেষ পর্যন্ত মূলধারার রাজনীতি থেকে ছিটকে দেয়। 

জামায়াত-শিবিরের অবস্থা আজ অনেকটাই এর মতো। তারা ভাবছে, "আমরা তো ৭১-এ জন্মাইনি", তাই পুরনো ইতিহাস আজ আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু মানুষ তো এখনো দেখছে তাদের বই, শুনছে তাদের বক্তব্য—গোলাম আযম, স্বাধীনতা, পাকিস্তান প্রসঙ্গে তাদের অবস্থান। তারা কি সত্যিই অতীত থেকে বের হতে পেরেছে? কেন তারা এই সুবর্ণ সুযোগটা হাতছাড়া করল? 

আত্মঘাতী অনলাইন বাশিংয়ের রাজনীতি

৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই আমরা লক্ষ্য করলাম—একটি সুপরিকল্পিত অনলাইন বাশিং শুরু হয়েছে বিএনপিকে কেন্দ্র করে। এই আক্রমণের সূচনা করে মূলত আওয়ামী লীগের ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের বি টিম হিসাবে বাম ঘরানার কিছু তরুণ, যারা পরবর্তীতে NCP-এর ছাতার নিচে ‘নিরপেক্ষতা’র মুখোশ পরে প্রবেশ করেছে। তারা মূলত সেই সংস্কৃতির ভেতরে বেড়ে উঠেছে যেখানে শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের বার্তা ছিল: "বিকল্প দেখান?" "আওয়ামী লীগ না থাকলে দুর্নীতিবাজ বিএনপি—জামায়াত আসবে।" 

এর সাথে, তরুণদের একটা বড় অংশ যারা অতীতে 'আই হেট পলিটিক্স' বলে ভোটে অংশ নেয়নি বা রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিল, তারাই আজ বিএনপির বাশিং করছে। সেই মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে যখন তারা আজ বলছে, “বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই সাপের এক বিষ।” অথচ তারাই ২০১৮ সালে হাসিমুখে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে, ‘আঙুলে কালির দাগ’ দেখিয়ে ফেসবুকে গর্ব করে পোস্ট করেছে। আজ তারা বিএনপিকে ব্যঙ্গ করে প্রশ্ন তোলে—“তুমি ১৭ বছর কোথায় ছিলে?” কিন্তু তারা কি গুম ও হত্যা শিকার বিএনপির নেতাকর্মীদের পরিবারের সামনে গিয়ে চোখে চোখ রেখে এই প্রশ্ন করতে পারবে?

এই অপপ্রচারের সময় সবচেয়ে বেশি যাকে টার্গেট করা হয়েছে তিনি হচ্ছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আসলে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের ফসল যেন বিএনপি একা না খেতে পারে—এই হিংসাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তারা ‘ভারত ও ‘র’ দালাল’, ‘সেক্যুলার’, ‘২৮ শে অক্টোবরের ১০ মিনিটে রাস্তা খালি’ ‘বালুর ট্রাক সরাতে না পারা’ -  ইত্যাদি তকমা দিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং বিএনপির বিরুদ্ধে বিষ ছড়াচ্ছে। অথচ এ ধরনের ট্যাগিং অতীতে শেখ হাসিনাও করতেন—“তুই পাকিস্তানের দালাল”, “তুই রাজাকার”—যার পরিণতি হলো, আজ এসব শব্দ জনগণের কাছে শুধু ট্রল আর হাস্যরস। এখন একই পথ যারা নিচ্ছে, তারা কি বুঝতে পারছে—এতে ‘ভারতের দালাল’ কথাটিও ধীরে ধীরে হাসির খোরাকে পরিণত হবে। 

অথচ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৮ শে অক্টোবরের বিএনপি'র আন্দোলন ব্যর্থ হবার কারণে তিনি নিজেই বলেছিলেন — যতদিন তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা রাজপথে না নামবে, বাংলাদেশে কোনো আন্দোলন সফল হবে না। তিনি একজন নীরব কৌশলী, মাঠে ছিলেন, দমন-পীড়নের শিকার হয়েছেন। তাঁকে এভাবে উপহাস করা শুধু অবিচার নয়, অকৃতজ্ঞতা। অপরদিকে, পাল্টা কাউন্টার হিসেবে বিএনপির নেতা কর্মীরা তারাও একইভাবে প্রতিপক্ষকে অনলাইন বাশিং করা শুরু করে দিয়েছে । বুঝতে পারছি না আসলে কার লাভ হচ্ছে । 

যাইহোক, তরুণ প্রজন্মের অনেকেই আজ বিএনপির বিরুদ্ধে বেসিং করছে—তাদের কেউ কেউ হয়তো রাজনীতির বাস্তবতা চোখে দেখেনি। তাই তারা আবেগতাড়িত হয়ে কিছু কিছু অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে—এটাকে কিছুটা না হয় আবেগের ভুল বলে ধরা যায়। কিন্তু মূল প্রশ্নটা তখন আরও জটিল হয়ে ওঠে—জামায়াতে ইসলাম কেন এই অপপ্রচারে নিজেকে জড়িয়ে ফেলল? একটি ইসলামি দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী তারা কীভাবে কোরআনের নিষিদ্ধ ঘোষিত গীবত, অপবাদ ও উপহাসমূলক (লুমাজা ) আচরণে জড়িয়ে পড়ছে (আল কুরআন: ২৪:৪, ২৪:১১–১৫/৪৯:৬ /৪৯:১২/ ১০৪:১)? 

এটা কি শুধুই ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার লোভ? নাকি বিএনপির সঙ্গে ২০১৮ সালের পর জোট না থাকায় একধরনের অভিমান, প্রতিশোধপরায়ণতা? তারা কি একবারও ভেবে দেখেছে—এই আচরণ বিএনপির সঙ্গে ভবিষ্যতের সব রাজনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তি পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে পারে? যে সম্পর্ক কখনো হয়তো পুনরুদ্ধার হতো, সেই সম্ভাবনাটাকেই কি তারা আজ নিজের হাতে শেষ করে দিচ্ছে? রাজনীতিতে ভুল বোঝাবুঝি, মতবিরোধ—এসব থাকতে পারে। কিন্তু যখন অপপ্রচার শুরু হয়, ‘শত্রু-তুল্য’আচরণ করা হয়, তখন সেটা আর রাজনৈতিক বিচ্যুতি নয়—তা হয়ে দাঁড়ায় বিশ্বাসঘাতকতা। 

অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, বিশেষ 'জ্ঞান চক্র গ্যাং' এবং ইসলামি রাজনীতির আত্মবিপর্যয়

এই আলোচনা অত্যন্ত সংবেদনশীল, কিন্তু সময় এসেছে আমাদের সৎভাবে কিছু প্রশ্ন তুলে ধরার। আমাদের দেশের রাজনীতিতে এখন কিছু অনলাইনভিত্তিক গোষ্ঠী এবং তথাকথিত 'জ্ঞান চক্র গ্যাং' যেভাবে নিজেদের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে বসাতে চাইছে, তা ৭৫-পরবর্তী জাসদের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের ছায়া মনে করিয়ে দেয়। যেন এই গোষ্ঠীগুলো জনগণের অভিপ্রায়কে পাশ কাটিয়ে নিজেদের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কনট্রোল করতে চায়। তারা নিজেরাই নিজেদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবান বলে দাবি করে, কারণ তারা নাকি অতীতে মাঠের রাজনীতি করেছে। 

কিন্তু আমি একজন গবেষক, আমি বিশ্বাস করব তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে—কেবল দাবির উপর নয়। যখন আমি দেখি, এই অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে এমন ভূমিকা রেখেছিল যে তার ফলে কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়, আবার হেফাজতের বহু নিরীহ ছাত্র পুলিশ গুলিতে প্রাণ হারায়। তারা আবার টিভির টকশোতে গিয়ে এ নিয়ে উল্লাস এবং এইসব মৃত্যুর জাস্টিফাই করেছে। এই অ্যাক্টিভিস্টদের তখন কোথায় ছিল তাদের  জ্ঞান যে, গণজাগরণ মঞ্চ ছিল একটা ইন্ডিয়ান প্রজেক্ট। 

এখন দেখি তাদের মুরিদরা বলছে, তারা তো ক্ষমা চেয়েছে আবার দেখি কেউ কেউ প্রকাশ্যে তাদের ক্ষমাও করে দিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—কে আপনাকে সেই ক্ষমা দেওয়ার অধিকার দিয়েছে? যদি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার মাফ না করে, তাহলে আপনি কি নিজেকে আল্লাহর সামনে জুলুমের গুনাহর ভাগীদার করে নিচ্ছেন না? কুরআনের কোথাও কি বলা আছে যে অন্যের জায়গায় আপনি ক্ষমা করতে পারেন? বরং কুরআন স্পষ্ট বলছে—‘কিসাস’-এর মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করো। কিন্তু মাফ করার এই মনোভাব কি ইসলামী ন্যায়বিচারের পরিপন্থী নয়? 

এখানে আরও চিন্তার বিষয় হচ্ছে—এই অনলাইন গোষ্ঠী যখন ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়, তখন তারা প্রথমে এটিকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’-এর ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করে। অথচ পরে যখন জনমতের ধারা বদলায়, তখন তারাও নিজেদের অবস্থান বদলায়। এখন বলুন, যাদের অবস্থান এত দ্রুত বদলায়, তাদের কি আদৌ রাজনৈতিক স্থিতি বা প্রজ্ঞা আছে? এই দ্বিচারিতার আরেকটি দৃষ্টান্ত দেখা যায় ড. ইউনুসের সরকার আসার পর। এই অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা শুরুতে ড. ইউনুস ও তার উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ, কুৎসা এবং বিদ্বেষ ছড়িয়েছিল। কিন্তু এখন তারা সেই একই ইউনুস সরকারের হয়ে দোয়া করছে, প্রার্থনা করছে এবং নতুনভাবে তার তত্ত্বকে সাদা করে দেখাতে চাইছে। প্রশ্ন হলো—এটা কি শুধুই রাজনৈতিক কৌশল? নাকি এটি আদর্শহীনতার চূড়ান্ত প্রকাশ? 

এইসব অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা আজ আবার ইতিহাস টানার চেষ্টা করছে—তারা বলছে, ফরাসি বিপ্লবের পরেও তো ক্ষমতা স্থিতিশীল হতে সময় লেগেছিল, প্রায় দশ বছর। কাজেই, আমরা ইউনুস সরকারকে আরও ১০ বছর চাই। কিন্তু এই তুলনা অর্ধসত্য এবং বিপজ্জনক। কারণ তারা এই গল্পের বাকি অংশ গোপন করছে—এই তথাকথিত দশ বছর পরে যখন নেপোলিয়ন ক্ষমতায় আসে, তখন বিপ্লবের মূল আদর্শকে গলাটিপে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্র হয়ে যায় সামরিক একনায়কতান্ত্রিক, আর পুরো ইউরোপে যুদ্ধের আগুন জ্বলে ওঠে। জনগণের স্বাধীনতার স্বপ্ন রূপ নেয় সাম্রাজ্যবাদী বিভীষিকায়। 

এখানেই বোঝা যায়, এই অনলাইন বুদ্ধিজীবীদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা কতটা গভীর। তারা ইতিহাস থেকে কেবল সুবিধাজনক অংশ তুলে এনে জনমতকে প্রভাবিত করতে চায়, অথচ ইতিহাসের পূর্ণ পরিপ্রেক্ষিত না বলেই তারা জনবোধকে বিকৃত করে। এটাই হলো ‘অর্ধসত্য’— যা অনেক সময় সরাসরি মিথ্যার চেয়েও ভয়ংকর। আপনি যদি ইতিহাসের একটা দিক বলেন, আর অন্য দিক চেপে যান, তাহলে সেটা শুধু বিভ্রান্তি নয়, বরং একটা জাতির ভবিষ্যতের সঙ্গে প্রতারণা।

 

আমার প্রশ্ন জামায়াতে ইসলাম ও অন্যান্য ইসলামি দলগুলোর প্রতি—আপনারা কীভাবে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এই 'ছোট জ্ঞান গ্যাং', অনলাইন অ্যাক্টিভিজ, শিরক কারী, ও মূর্তিপূজারী নামের সেক্যুলার-মার্কসবাদী গোষ্ঠীর সাথে নিজেকে মিলিয়ে ফেলছেন? তারা তো এমন একটি দল যারা ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাস করে না, বরং ইসলামকে তারা প্রায়শই তুচ্ছ করে। কোরআন তো বলে: "হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না; তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যারা তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই একজন হয়ে যাবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিম কৌমকে হিদায়াত দেন না।" (সূরা মায়েদা – ৫:৫১)। "তারা যখন তোমাদের কাছে আসে, তখন বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি।’ অথচ তারা ঈমান নিয়ে আসেনি। বরং তারা যখন চলে যায়, তখন নিজেদের মধ্যে বলে, ‘আমরা তো তাদেরকে ধোঁকা দিলাম।’" (সূরা আল-বাকারা-২:৮-৯)/(সূরা আল-মুনাফিকুন - ৬৩:১-২) । 

দেখুন আমি নিজেও স্বীকার করি আমি একজন খাঁটি মুসলমান নই, আমি নিজেই অনেক পাপ কাজের সাথে জড়িত । আল্লাহ যেন আমার সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেন ।  তবে আমার আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস আছে । তাহলে এখন যারা ব্যাংকিং সিস্টেম, সুদের ভিত্তিক আর্থিক চিন্তা, এবং ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা সমর্থন করে তাদের সাথে রাজনৈতিক সখ্যতা গড়ে তুলছে—তারা কিভাবে ইসলামী রাজনৈতিক আদর্শ রক্ষা করবেন? আপনারা একদিকে সুদের বিরুদ্ধে ওয়াজ শোনান, দজ্জালের ধোকার বিরুদ্ধে অন্যদের সাবধান করে দেন, অথচ এখন তারা নিজেরাই দজ্জালের সুদনির্ভর সিস্টেমের জন্য দোয়া করছেন? এ কেমন দ্বিচারিতা? এ কেমন ইসলাম পালন আপনাদের? 

রাসূল (সা.) বলেছেন: “হে লোকেরা! কিয়ামতের আগমনের আগে এমন ফিতনা আসবে, যেগুলো অন্ধকার রাতের মতো হবে। তখন মানুষ সকালে ঈমানদার থাকবে, আর রাতে কাফির হয়ে যাবে। কেউ কেউ রাতে মুমিন থাকবে, আর সকালে হয়ে যাবে কাফির। মানুষ তার দুনিয়ার লাভের বিনিময়ে তার দ্বীন বিক্রি করে দেবে।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৮, জামে তিরমিযী, হাদীস ২১৯৫)। “দজ্জালের অনুসারী হবে এমন সব লোক যারা মনে করবে তারা সৎপথে আছে।”((মুসনাদে আহমদ, হাদিস ২৩১৪৫ (মা’নাওয়ী অর্থ)) 

যারা বলছেন ' অমুক না থাকলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে'—তারা আসলে কোরআনিক ‘তাওহীদের’ ধারণাকে আঘাত করছেন। কারণ এভাবে কোনো ব্যক্তিকে অতি নির্ভরতার প্রতীক বানানোও একধরনের 'শিরকীয় প্রবণতা' (সূরা তাওবা, ৯: ৩১)। আপনারা যাঁরা এখন যাকে তাকে 'রাষ্ট্র রক্ষার' জন্য প্রার্থনা করছেন, তাদের বুঝা উচিত—রাষ্ট্র আল্লাহর হাতে, কোনো মানুষের হাতে না। যদি সত্যিই কেউ ইসলামিক রাজনীতি করেন, তাহলে আল্লাহর উপর ভরসা রাখা জরুরি, কোনো ব্যক্তির ওপর নয়। একমাত্র আল্লাহর কথা এবং রাসূলের সুন্নাহকেই আঁকড়ে ধরলেই পথভ্রষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে না: "তোমরা যতদিন কুরআন এবং আমার সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরবে, ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না।" — বিদায় হজের ভাষণ, সহীহ হাদীস। 

আসুন স্বীকার করি—এইসব তথাকথিত প্রজ্ঞাবান অনলাইন গোষ্ঠী এবং তাদের অনুসারীরা আজ একটি মূর্খ ও সুযোগসন্ধানী রাজনীতির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ইসলামি দলগুলো যদি নিজেদের আত্মপরিচয় ভুলে এদের ছায়ায় আশ্রয় নেয়, তাহলে ইসলামী রাজনীতির ভবিষ্যৎ হবে ফাঁপা খোলসে ভরা একটি প্রতিষ্ঠান—যার ভেতরে থাকবে না কোনো আত্মিক দৃঢ়তা বা মূল্যবোধ। আল্লাহ না করুন, আমরা সেই পরিণতির দিকে ধাবিত হই। 

'জ্ঞান চক্র গ্যাং' বনাম জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান

আমি কোনো পক্ষের হয়ে কথা বলছি না, কাউকে অন্ধভাবে সমর্থনও করছি না। কারণ ইসলাম আমাদের শেখায়—যাকে না চেনো, না বুঝো, তার পক্ষে দাঁড়ানো ঠিক না। আমি শুধু এক গভীর ও সংবেদনশীল বাস্তবতা তুলে ধরতে চাই, বিশেষ করে ইসলামি দলগুলো এবং জামায়াতে ইসলামী যদি বর্তমান রাজনৈতিক চিত্র ঠিকমতো না বোঝে, তাহলে কী ধরনের বিপদের মুখে পড়তে পারে—সেই বিষয়ে একটি সতর্ক আলোচনায় আসছি। 

ধরা যাক, ‘জ্ঞান চক্র গ্যাং’ জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। যদি সত্যি এ ধরনের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়, তাহলে ইতিহাস থেকে আমরা যা জানি, সেটা মনে রাখা জরুরি। ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থানে আমরা দেখেছি—আর্মির ভেতরে বিভাজন কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল। সাধারণ ও তরুণ অফিসাররা একদিকে, ক্ষমতালোভীরা আরেকদিকে। ফলে শুধু রাজনীতিবিদ নয়, অনেক আর্মি পরিবারও জীবন হারিয়েছিল। একইভাবে, বিডিআর বিদ্রোহেও আমরা দেখেছি—নিজেদের মধ্যে বিশ্বাস ভেঙে গেলে কী ভয়াবহ পরিণতি হয়। 

এখন ধরুন, জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান পক্ষে এক বাহিনী আছে। এই বাহিনীর মধ্যে হয়ত কিছু আওয়ামী ঘরানার অনুসারী থাকবে, কিছু বিএনপির ঘরানার, আবার কিছু তার ব্যক্তিগত লোকজন। আর এর বিপরীতে থাকবে সেই বাহিনী যারা বর্তমান মার্কসবাদী ‘জ্ঞান চক্র গ্যাং’- এর ধারক, যারা বিপ্লবী ঘরানার রাজনীতিকে সামনে আনছে। এরা যদি জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ক্ষমতা থেকে সরাতে চায় এবং সেই সংঘর্ষে মনে করেন উনি হার মানলেন, তাহলে প্রশ্ন হলো—তারা বিদায় নেওয়ার আগে কী করবে?

ইতিহাস বলে, পরাজিতরা অনেক সময় প্রতিশোধ নিতে চায়। যেমন ১৯৭৫ সালের ব্যর্থতা থেকে জন্ম নেয় জেল হত্যাকাণ্ড। এখন যদি পরাজিত পক্ষের হাতে কিছু ক্ষমতা থেকে যায়, তাহলে তারা চলে যাওয়ার আগে প্রতিপক্ষের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের (ড. ইউনুস, তার ছাত্রনেতা, এমনকি ইসলামী দলগুলোর শীর্ষ নেতা) লক্ষ্য করতে পারে। আওয়ামী ঘরানার বাহিনীর অনুসারী যারা থাকবে তারা জানে—বিদেশে (বিশেষ করে ভারতে) আশ্রয় পাওয়া যাবে।

অন্যদিকে, যদি ‘জ্ঞান চক্র গ্যাং’নিজেই পরাজিত হয়, এবং পালিয়ে যায়, তাহলে তার অনুসারীরাও যে চুপ থাকবে—তা নয়। তখন তাদের প্রতিশোধমূলক হামলার প্রধান লক্ষ্য হবে বিএনপির জিয়া পরিবার ও নেতৃত্ব। তারেক রহমান কেন দেশে আসছেন না—এই প্রশ্নের উত্তর এখানেই লুকিয়ে থাকতে পারে। তিনি জানেন, তাকে নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এখনো প্রবল। তার অনুপস্থিতিতে যদি খালেদা জিয়া নিজে বা পরিবারের অন্য সদস্যরা নিশানায় পরিণত হন, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আবার আওয়ামী ঘরানার বাহিনীর অনুসারীদের টার্গেটে তারা পড়তে পারেন ।

এই পুরো সংঘাত যদি সেনাবাহিনীর ভেতরে ঢুকে পড়ে, তাহলে আমাদের উচিত হবে একবার চোখ বন্ধ করে ভাবা—এই দেশের কী পরিণতি হবে? আপনি কি কল্পনা করতে পারেন, যদি আর্মির ভেতরে গোপনে বা খোলাখুলি ইন-ফাইটিং শুরু হয়ে যায়? আমরা কি প্রস্তুত, যদি এই সুযোগে প্রতিবেশী রাষ্ট্র আমাদের সার্বভৌমত্ব হস্তগত করার চেষ্টা করে?

আমি বলছি না এসব নিশ্চয় ঘটবেই। কিন্তু ইতিহাস, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং আমাদের ভেতরের বিভাজন যদি কেউ ঠান্ডা মাথায় বিশ্লেষণ করে, তাহলে এটুকু বলা যায়—আমরা আজ একটা আগুনের সঙ্গে খেলছি, যে আগুন কারো পক্ষ-বিপক্ষে না; সে পুড়িয়ে দেবে সবাইকে। 

আলোচনাটিকে আর দীর্ঘায়িত না করে আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপসংহারে পৌঁছাতে চাই। আমরা যারা ১৯৭৫-এর পরে জন্মগ্রহণ করেছি, তারা এই বাংলাদেশের রাজনীতির নানা ওঠানামা, সংঘাত ও সম্ভাবনা চোখের সামনে দেখেছি। আমরা দেখেছি কিভাবে ভুল সিদ্ধান্ত, দলীয় গোঁড়ামি কিংবা সময়োপযোগী কৌশলের অভাব একটি রাজনৈতিক শক্তিকে কীভাবে মূল স্রোত থেকে ছিটকে দিতে পারে।

জামায়াতে ইসলামী—ইতিহাস যাই বলুক, কারণ যাই হোক, একটি বাস্তব সত্য হলো—তারা বহুবার মোক্ষম সময় রাজনৈতিকভাবে ভুল করেছে। এটাও সত্য যে, জামায়াতের রাজনীতি বোঝার সক্ষমতা আছে, কৌশল আছে, সংগঠন আছে । ভোটব্যাংকে হয়তো ১০–১২% এর মতো সমর্থন আছে, তবুও তারা এখনও এই রাষ্ট্রের একটি ভাইটাল স্টেকহোল্ডার।

এই লেখায় আমি কোনো পক্ষ-বিপক্ষ নই, বরং ইতিহাসের আলোকে একটি সতর্ক বার্তা দিতে চেয়েছি—যাতে জামায়াত বা যেকোনো ইসলামপন্থী রাজনৈতিক শক্তি ভবিষ্যতে আর কোনো ভুল চক্রে না ঘোরে। প্রশ্ন এখন একটাই—আপনারা কি আবারো সেই পুরনো চক্রে আবর্তিত হবেন? নাকি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে এই মোক্ষম সুযোগটি কাজে লাগিয়ে নিজেদের ‘গুড ইমেজ’ নিয়ে সামনে উপস্থাপন করবেন? সিদ্ধান্ত আপনাদের হাতে। কিন্তু সময় এখন খুবই স্পর্শকাতর। ভুল আর একবার ক্ষমা করবে না—ইতিহাস যেমন কাউকে ক্ষমা করেনি।

 

মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়